নেহাতই অব্যবস্থা নাকি অন্তর্ঘাত, এসএসসি-বিভ্রাট ঘিরে উঠছে প্রশ্ন
শুধু পাঁচ কেন্দ্রেই ফের পরীক্ষার সিদ্ধান্ত মানল কমিটি
রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত মেনে নিল স্কুল সার্ভিস কমিশন। সোমবার কমিশনের চেয়ারম্যান চিত্তরঞ্জন মণ্ডল জানিয়েছেন, অঞ্চল ধরে নয়, যে পাঁচটি কেন্দ্রে পরীক্ষা হয়নি, শুধু মাত্র সেখানকার পরীক্ষার্থীদেরই ফের পরীক্ষা হবে। যে পাঁচটি কেন্দ্রে ফের পরীক্ষা হবে, সেগুলি হল বাগনানের আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়, চুঁচুড়া দেশবন্ধু মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়, বর্ধমানের রাইপুর কাশিয়াড়া হাইস্কুল এবং রসুলপুর ভুবনমোহন হাইস্কুল এবং মালদহ মহিলা মহাবিদ্যালয়। চিত্তরঞ্জনবাবু বলেন, “২ সেপ্টেম্বর সেই পরীক্ষা হবে। পরীক্ষার্থীদের রোল নম্বর ও পরীক্ষাকেন্দ্রের নাম পরে তাঁদের জানানো হবে।” ওই সব কেন্দ্রে যাঁদের যে পত্রের পরীক্ষা হয়নি, তাঁদের নতুন করে কেবল সেই পত্রের পরীক্ষাই দিতে হবে বলে জানান তিনি।
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এ দিন জানান, পরীক্ষার দিন বিভিন্ন কেন্দ্রে কেন দেরিতে প্রশ্নপত্র পৌঁছেছে, কমিশনের চেয়ারম্যানকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তা জানাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া, স্কুলশিক্ষা সচিব অর্ণব রায় পরীক্ষা-বিভ্রাটের তদন্ত করছেন এবং জেলাশাসকদের কাছ থেকে আলাদা করে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে বলে জানান ব্রাত্যবাবু। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা বাছাইয়ের জন্য পরীক্ষা নেয় স্কুল সার্ভিস কমিশন। কমিশনের পরীক্ষায় পাশ করা প্রার্থীরা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দের স্কুল বেছে নেন এবং পরে পরিচালন সমিতি মারফত স্কুলে নিযুক্ত হন। রবিবার ছিল এসএসসি-র লেখা পরীক্ষা। ৫৫ হাজার শূন্য পদের জন্য প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ পরীক্ষার্থী ওই দিন পরীক্ষায় বসেন।
মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র।
রবিবার রাজ্যের বহু পরীক্ষাকেন্দ্রে গোলমাল হয়। কোথাও দেরিতে পরীক্ষা শুরু হয়, যার জেরে পরীক্ষার্থীরা সময় মতো লেখা শেষ করতে পারেননি। কোথাও পরীক্ষা বাতিল হয়ে যায়, কোথাও প্রশ্নপত্র ফটোকপি করে পরীক্ষার্থীদের দেওয়া হয়। রবিবার বিকেলে সাংবাদিকদের চিত্তরঞ্জনবাবু জানান, কমিশনের উত্তরাঞ্চলের বাংলা পাশ ও উর্দু পাশ এবং পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষা ফের নেওয়া হবে। তার কিছু পরেই শিক্ষামন্ত্রী জানান, ফের পরীক্ষা হবে কেবল পাঁচটি পরীক্ষাকেন্দ্রে। যদিও কেন্দ্রগুলির নাম স্পষ্ট করেননি ব্রাত্যবাবু। পরীক্ষা দিতে গিয়ে নাকাল হওয়া পরীক্ষার্থীরা পরস্পরবিরোধী এই মন্তব্যে ফের বিভ্রান্ত হয়েছিলেন।
সোমবার চিত্তরঞ্জনবাবু বলেন, “আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়েছে, পাঁচটি কেন্দ্রে ফের পরীক্ষা হবে।” সেই সঙ্গে তিনি বলেন, “সব আঞ্চলিক অফিসের চেয়ারম্যানদের থেকে বিস্তারিত রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে।” বুধবার ওই চেয়ারম্যানরা কমিশনের কেন্দ্রীয় অফিসে রিপোর্ট জমা দেবেন। পরে কমিশনের তরফে স্কুলশিক্ষা দফতরে সামগ্রিক রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে। এ দিন মহাকরণে এসএসসি-বিভ্রাট নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবদের সঙ্গে আলোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও সাংবাদিকদের তিনি নিজে এ ব্যাপারে কিছু জানাতে চাননি। মমতা বলেন, “এ নিয়ে যা বলার উনি (শিক্ষামন্ত্রী) বলবেন।” ব্রাত্যবাবু বলেন, “কী হয়েছে, কোথায় খামতি থেকে গিয়েছে, তা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। এখনই এ ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না।”
১৯৯৮ সালে স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের জন্য এসএসসি গঠিত হয়। তার আগে শিক্ষক নিয়োগের কাজটি করত সংশ্লিষ্ট স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি। এসএসসি শুরুর পর থেকে এমন গোলমাল কার্যত নজিরবিহীন। রবিবার চিত্তরঞ্জনবাবু জানিয়েছিলেন, পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে গণ্ডগোল করা হয়েছে। এ দিন ব্রাত্যবাবু বলেন, “এই মুহূর্তে সেটা বলা ঝুঁকিবহুল হয়ে যাবে। আগে তদন্ত রিপোর্ট পাই, তা দেখে যা বলার বলব।”
ব্রাত্যবাবু সরাসরি না বললেও এসএসসি-বিভ্রাটের নেপথ্যে কিন্তু ‘অন্তর্ঘাত’-এরই সন্দেহ তৃণমূলের একাংশের। দলের এক নেতার কথায়, “বাম আমলে এসএসসি-র মতো বহু কমিশনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সিপিএমের অনুগত লোকজনকে বসানো হয়েছিল। সরকার পরিবর্তনের পরেও পুরো ব্যবস্থাটা বদলানো যায়নি। অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”
কেন বিভ্রাট
প্রশ্ন দেরিতে পৌঁছল কেন?
সাধারণত প্রশ্নপত্র রাখা হয় সরকারি ট্রেজারিতে। ট্রেজারি থেকে সর্বাধিক তিন কিলোমিটারের দূরত্বে থাকা কেন্দ্রে পরীক্ষা হয়। এ বছর অনেক ক্ষেত্রে ওই সীমা মানা হয়নি। ফলে সময় বেশি লেগেছে। অনেক ক্ষেত্রে ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করতেও দেরি হয়েছে।

ভুল বিষয়ের প্রশ্ন বা কম প্রশ্নপত্র পৌঁছল কেন?
কেন্দ্রওয়াড়ি পরীক্ষার্থী ও তাঁদের বিষয় অনুযায়ী ট্রেজারিতে প্রশ্নপত্র পাঠানোর হিসেবে গোলমাল। সাধারণত পরীক্ষাকেন্দ্রে মোট পরীক্ষার্থীর ৫ শতাংশ এবং ট্রেজারিতে ২০ শতাংশ বেশি প্রশ্নপত্র ‘রিজার্ভ’ রাখা হয়। এ বার অনেক ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। পরীক্ষা

নেওয়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের বিচ্যুতি ঘটেছে?
কোথাও প্রশ্নপত্র কম থাকায় তা ফটোকপি করে দেওয়া হয়েছে পরীক্ষার্থীদের। কোথাও পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে আশপাশের কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র এনে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। কোথাও দেরিতে প্রশ্ন আসায় পরীক্ষা শুরু হতে বিলম্ব হলেও পরীক্ষার্থীদের বাড়তি সময় দেওয়া হয়নি।

এতে কী সমস্যা হতে পারে?
ফটোকপি করা প্রশ্নপত্র (যার মধ্যেই উত্তর লিখতে হয়) দেওয়ায় দু’জন পরীক্ষার্থীর প্রশ্নপত্রের সিরিয়াল নম্বর এক হবে। এতে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপবে এবং প্রভাব পড়বে ফলাফলে। সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে পরীক্ষা হওয়া মানে আগে বেরিয়ে যাওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা হওয়া। এর ফলে পরীক্ষার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেবে।

শুধু পাঁচ কেন্দ্রে ফের পরীক্ষা হলে কী সমস্যা হতে পারে?
এসএসসি-র মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় একাধিক প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হলে বৈষম্যের অভিযোগ উঠতে পারে। নির্দিষ্ট কিছু কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীদের ফের পরীক্ষা নিলে আইনি জটিলতার সম্ভাবনাও থাকে।
তৃণমূল নেতৃত্বের অনেকের মতে, অনিল বিশ্বাসের হাত ধরে এসএসসি-র মাধ্যমে রাজ্যের স্কুলগুলিতে সিপিএমের ক্যাডার বা অনুগত লোকজনকে চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। তাই এর অবসান হওয়া উচিত। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রেও ‘অনিলায়তন’ ভাঙতে চায় তারা। তবে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশের কাছেই এসএসসি যে হেতু চাকরির ছাড়পত্র, তাই রাজ্য সরকার তাড়াহুড়ো করতে চায় না বলে তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য। এ নিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ্যে ঘোষণাও করেনি তারা।
প্রাক্তন শিক্ষক তথা প্রদেশ কংগ্রেসের এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, “নয়ের দশকের শেষ দিকে স্কুলগুলির ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে সিপিএম হারছিল। কোথাও নবগঠিত তৃণমূল, কোথাও কংগ্রেস, কোথাও বাম শরিক দলগুলি জিতছিল। ম্যানেজিং কমিটিতে সিপিএমের প্রভাব কমে আসায় ওই কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগে তাদের কর্তৃত্বও কমে আসছিল। এই পরিস্থিতিতে এসএসসি-র সূত্রপাত। এই কমিশনের মাধ্যমে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তেই স্থানীয় স্তরে সিপিএম নিজেদের লোক ঢুকিয়েছে। সাধারণ ছেলেমেয়েরা অবশ্যই চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু সূক্ষ্ম ভাবে সিপিএম-ও লোক ঢুকিয়েছে।” কিন্তু এসএসসি-র মাধ্যমে চাকরি পেতে গেলে পরীক্ষায় উতরোতে হয়। শুধু ‘নিজেদের লোক’ বেছে বসানো সেখানে কী ভাবে সম্ভব? ওই নেতার কথায়, “বেশ কিছু বিষয় আছে, যেখানে যোগ্য শিক্ষকরাই শুধু সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু কিছু বিষয়ে আবার রাজনৈতিক কর্তৃত্বে লোক ঢোকানো হয়েছে। কে কেমন পরীক্ষা দিল, খাতা কেমন দেখা হল, এগুলো তো কেউ জানতে পারত না। তবে এমন ভাবে এই প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে, যা প্রমাণ করা খুব কঠিন!”
এর পাল্টা যুক্তিও উঠছে। এসএসসি চালু হওয়ার আগে স্কুলগুলি নিজেদের মতো শিক্ষক নিয়োগ করত এবং তাতে টাকাপয়সা নেওয়া-সহ বহু অনিয়মের অভিযোগ আসত। এসএসসি চালু হয়ে বরং সাধারণ ঘরের ‘যোগ্য’ ছেলেমেয়েরা বেশি সুযোগ পেয়েছেন বলে শিক্ষক মহলেরই অনেকের বক্তব্য। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, সিপিএম নেতা কান্তি বিশ্বাসও এসএসসি-র বিরুদ্ধে ‘অস্বচ্ছতা’র অভিযোগ মানতে নারাজ। কান্তিবাবুর কথায়, “১৯৯৭-এ এসএসসি বিল পাশ হয়। তার আগে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিগুলিই ইন্টারভিউ নিত, নিজেরাই নিয়োগ করত। নানা অভিযোগ আসত। এসএসসি চালু হওয়ার পরে ২০১০ পর্যন্ত ১৩ লক্ষ ৩৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। কোনও অভিযোগ ওঠেনি।” কান্তিবাবু বলেন, “যদি সত্যিই অস্বচ্ছতা থাকত, এত বছরে বিধানসভায় কোনও বিধায়ক সরব হলেন না কেন? সংবাদমাধ্যমে হইচই হল না কেন?” এসএসসি-বিভ্রাটের জন্য উষ্মা প্রকাশ করে বিধানসভার স্কুলশিক্ষা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি স্কুলশিক্ষা সচিবের কাছে সুপারিশ করেছে, বিভ্রাটের জেরে যাঁরা পরীক্ষা দিতে পারেননি, তাঁদের সকলের পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.