|
|
|
|
|
|
|
দেখা হল নীহারিকার সঙ্গে |
‘আমি তাকাই নীহারিকার চোখের দিকে, আমি দেখি এক অন্য আমিকে।’
জীবন আর
চলচ্চিত্রের দ্বৈত পরিসরে মুক্তির সন্ধানকে এগিয়ে নিয়ে চলার
এক নিজস্ব
অনুভূতিঋদ্ধ কাহিনি লিখেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত |
জীবন যখন নাটক হয়ে যায়, আর নাটক জীবন হয়ে ওঠে? এই কথাটার কী অর্থ, কখনও কি ঠাহর করতে পেরেছি আমরা? পেরেছি কি জানতে বা পরখ করতে, জীবনের অমোঘ সত্যকে? সত্যি কি পেরেছি আমরা সেই উপলব্ধিতে পৌঁছতে? জানি না, পেরেছি কি না! পারলেও পেরেছি অনেকটা ফিকে ভাবে। অনেকটা কাছাকাছি হয়তো পৌঁছেছি আন্তরিকতা দিয়ে। কিন্তু সেই পৌঁছনোটা বোধ হয় আজও অসম্পূর্ণ, অসমাপ্ত।
কেন আমাদের জীবনে এত অসমাপ্তি? প্রাপ্তির খোঁজে আমরা জীবনের সন্ধানের ব্যাপ্তি অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছি। চেয়েছি সন্ধানের অন্য মানে দিতে, তাই প্রাপ্তির খোঁজে দৌড়তে দৌড়তে আমরা কখন কেমন যেন প্রাপ্তির ক্রীতদাস হয়ে গিয়েছি। আমরা যেন হাল্কা করে দিয়েছি আমাদের মূল্যবোধ। হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছি আমাদের সংরক্ষণ করে রাখা অনেক কিছু, এক সময় যাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ মনে হত। মানুষের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে যেন আমাদের কষ্ট হয়। আমরা আসলে অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক, অনুশোচনাপ্রবণ, নিজেকে দুঃখিত দেখতেই বোধ হয় আমাদের ভাল লাগে। এই পৃথিবীতে আমরা হাতড়ে বেড়াই আক্ষেপভরা আমাদের নিজেদের।
আবার আমরাই আমাদের অনাবৃত করি নিজেদের বিবেকের কাছে, নানা ভাবে সুখে, দুঃখে সন্ধানে, বিধানে, মানবিকতায়। আমরা কোনও প্রশ্নের উত্তর খুঁজি জীবনে, যে-প্রশ্নের উত্তরে আমাদের মন ভরে না, প্রাণ ভরে না, যে উত্তরে সন্তুষ্টির ছায়া নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই হিসেবনিকেশ করতে অনেক জমানো সত্তা হারিয়ে যায়নি তো?
তখনই খুলে যায় শৈশবের দরজা। ফিরে যাই আমাদের শিশুমনের অন্তরালে, যেখানে ছিল শুধুই সারল্যভরা প্রশ্ন আর অনেক অনেক স্বপ্ন। শৈশবের দরজায় হাত বাড়ালেই দরজাটা খুলে যায়।
সেই দরজা পেরিয়ে স্কুলে যেতাম। প্রাইমারি স্কুলের ঢং ঢং আর হাই স্কুলের ইলেকট্রনিক বেল। প্রত্যেক পিরিয়ডের মাঝে মাঝেই। এখনও কানে সাইরেনের মতোই বাজে। নাটকের দৃশ্যের মতো ভেসে ওঠে সেই দৃশ্যগুলো, যেখানে জীবন সাড়া দিত আমাদের ভালবাসায়, আমাদের আনন্দে আর আমাদের খেলাধুলোয়।
কিন্তু সে দিনও, এত আনন্দের মধ্যেও আমাদের মনে হত, স্কুলের উঁচু উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল ঘেরা চার দেওয়ালের মধ্যে আমরা বন্দি, শিক্ষকদের চোখ রাঙানোতে বন্দি, আর তারই পাশাপাশি বাবার শাসন, মায়ের সিনেমা না দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অভিমান, প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া হলে নিজেকে অসহায়, পরাস্ত বন্দি মনে হওয়া। আমরাও সে দিন খুঁজতাম মুক্তি, আমাদের মতো করে। কিন্তু সেই মুক্তির অর্থ কী? আমরা জানতামই না, বুঝতামই না। নিরাশা ঘিরে ধরত আমাদের, জীবন যেন থমকে দাঁড়াত। বিদ্রুপের দৃষ্টিতে নিজেই নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আয়নাতে। শুধু আমি না, আমার মতো আরও অনেকে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। মুক্তির সংজ্ঞা খুঁজতে মনে তখন অনেক যুদ্ধের উদ্রেক, অনেক তোলপাড়। অনেক না পাওয়া প্রশ্নের উত্তর আমরা শৈশব থেকে কৈশোরে পাই। কৈশোর থেকে যৌবনে পাই। বা পাওয়ার আয়োজন করি।
আর এ রকমই যুদ্ধে শরিক হয়ে চলে আসি চলচ্চিত্র নামক প্রতিযোগিতায়। ‘প্রতিযোগিতা’ কথাটা ব্যবহার করে কি ঠিক করলাম? প্রতিযোগিতা কথাটার ভার অনেক। অনেক প্রভাব তার। সে প্রভাব ভালও হয়, আবার মন্দও হয়। আমি প্রতিযোগিতা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি। আমি এই ভার থেকে মুক্ত হতে চেয়েছি সব সময়। আমার মধ্যে এই ধারণাটা ইম্বাইব করানো হয়েছে।
তবু, কথাটার গুরুত্ব বুঝতে বুঝতে পদার্পণ করলাম সাফল্য অর্জনের যুদ্ধে। বহু সিনেমার দরজা পেরিয়ে, চালচিত্রে চলচ্চিত্র আঁকার সন্ধান পেয়েছিলাম, পরতে পরতে ছিল নিজেকে পরখ করার ভয়। উঁচু সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে নীরবে নিজেকে একা করে নেওয়ার ভয়। সেখানেই চেয়েছিলাম মুক্তি। সেখানেই চেয়েছিলাম স্বাচ্ছন্দ্য। পুরনো থেকে নতুন জীবন আমাকে দেখাচ্ছিল এক নতুন পথ। বাবা-মায়ের সময়ের চাহিদার থেকে অনেক দূরে, অনেকখানি বাইরে সে এক অন্য জগৎ সিনেমা।
সেই নতুন জগতে আমি এক অসাধারণ মুক্তির সন্ধান করেছি, যা আমাকে সমৃদ্ধ করবে, নিজেকে জানতে সাহায্য করবে সত্যি আমি কে? আমি কী? যা আমাকে দেবে শান্তির সন্ধান।
সে রকম ভাবেই মুক্তির সন্ধান বহন করে এনেছিল তরুণ মজুমদারের ‘আলো’ ছবিটি। সেই ছবি বলেছিল মেয়েদেরমুক্তির কথা, হয়তো পথ দেখিয়েছিল অনেক মানুষকে, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে। সন্ধান চলেছিল আমার তার পরেও। সে এমনই এক সন্ধান, যা মুক্তির পথ দেখায় ‘দহন’-এর রমিতা আর ‘পারমিতার এক দিন’-এর পারমিতাদের, বা ‘চারুলতা ২০১১’-র রমণী চারুকে।
|
|
‘মুক্তধারা’। নৃত্যের ছন্দের মধ্য দিয়েই যখন মুক্তির পথ খোঁজে, খুঁজতে শেখায় নীহারিকা। |
সেই সন্ধানের শরিক হয় বহু নারী, যারা তাদের ব্যথা প্রকাশ করতে পারে না। তারা কখনও শহুরে অশান্তি আর প্রাচুর্যের জেলে বদ্ধ, কখনও বা দূর গণ্ডগ্রামে শুধুমাত্র একটু জলের জন্যে সংগ্রাম করছে। খাবার জল। কে মুক্তি দেবে এদের? সন্ধান চলে, আরও প্রবল হয় মুক্তির সন্ধান। মুক্তি কাকে বলে, তার অন্বেষণ। মান-অভিমানে জর্জরিত নারী চায় তার সত্তার মুক্তি, তার প্রেরণার রসদ। আর ঠিক সেই সময় নীহারিকা চ্যাটার্জির সঙ্গে পরিচয় হয় আমার, বাচ্চু বিশ্বাস ও অতনু রায়চৌধুরী প্রযোজিত ‘মুক্তধারা’ ছবিতে। মুক্তির খোঁজে চিরন্তন সত্য বহন করা এক নারী। যার জীবনযাপন এক নিয়মে আবদ্ধ। যে নিয়ম তার মহীয়সী বিলাসে, তার অনাবিল ছন্দে, তার সুচারু ভঙ্গিমায় প্রকাশ পায়। প্রকাশ পায় তার সৌন্দর্য বিন্যাসে।
নীহারিকা তার লুকোনো অভিব্যক্তিকে তার নিজের তাপে আর নিজের তালে মৃদুমন্দ ভাবে দোলায়। সংসারকে অনেক কাছ থেকে ভালবাসে সে। এই ভালবাসার মধ্য দিয়েই জীবনের আর এক দরজা অতিক্রম করে নীহারিকা, যার নাম সংশোধনাগার, যাকে মানুষ চেনে তার পুরনো নামে জেলখানা নামে। সংশোধনাগারের নিরিখে সে মুক্ত করে, আবিষ্কার করে এক অন্য নারীকে, যার নাম ম্যাডাম। নীহারিকার এই ‘ম্যাডাম’ শব্দটি অনেক অনেক অনেক বার শুনতে ইচ্ছে করে, এই শব্দটিতে কোথাও যেন একটা শক্তি খুঁজে পায় সে।
আমিও কি ম্যাডাম হতে পেরেছি? কে না চায় সেই স্বীকৃতি? সবাই চায়। সবাই। অনেক সাফল্য আর সংগ্রামের পর, অনেক তিরস্কার, বঞ্চনা, উপেক্ষার পর মুক্তি চেয়েছি, মনের মুক্তি। অনেক ভাল কাজ আর অনেক বঞ্চনা আর গোষ্ঠীগত দলগত স্বার্থপরতা আমাকে খানখান করে দিয়েছে। কিন্তু আমি মুক্ত হয়েছি সেই আর এক জন ম্যাডামের কথা ভেবে, যিনি অনাবিল আনন্দে তাঁর পরিধিতে বিরাজ করেন। যাঁর নেই কোনও সমালোচনার ভয়, নেই কোনও আকাঙ্ক্ষা, নেই কোনও স্বীকৃতির অপেক্ষা, কোনও অস্থির তাগিদ। আছে শুধু শান্তির মুক্তি। সবার উপরে মুক্তির মণিকোঠায় বিরাজিতা অপরাজিতা ম্যাডাম সুচিত্রা সেন, যাঁর কাছে আজ তাঁর সম্বন্ধে আলোচনা শুধু অনাগ্রহের বিষয়।
নীহারিকার ব্যস্ত দৃষ্টি অনেক নতুন মানুষের প্রতিভা আবিষ্কার করে। জীবনে এমন এক সময় সে এমন মানুষদের সামনে এসে দাঁড়ায়, যারা তার থেকে একেবারে ভিন্ন, একদম আলাদা। মানুষ তাদের চেনে ক্রিমিনাল হিসেবে, সংশোধনাগারের আবাসিক নামে। এই মানুষগুলোর নিজেদের চেনা নামগুলোই অচেনা হয়ে গিয়েছিল তাদের নিজেদের জীবন থেকে, নীহারিকা চ্যাটার্জি সেই নামের গুরুত্ব ফিরিয়ে দেয় তাদের প্রত্যেককে। মুক্তি না পাওয়ার যন্ত্রণাকে মুক্তির প্রেমে নিয়োজিত করে এই নারী, যার কাছে ‘বন্দি’ শব্দটা ঘৃণার রূপ পায়। মুক্তির আলো দেখায় সে ওই ঘৃণিত সত্তাদের, ভালবাসতে শেখায় সেই মানুষগুলিকে ইউসুফ, বাবু, হ্যাপি, কালুয়া শেখ... সমস্ত চরিত্রগুলোকে।
এই ভালবাসাই হয়ে ওঠে নীহারিকার অস্তিত্বের অবলম্বন। নৃত্যশিল্পী, সংসারে আবদ্ধ, জীবনের অভ্যাসে অভ্যস্ত, সংসার নামক রোমান্টিসিজম-এ আবিষ্ট নীহারিকা। এ রকমই তো বহু সংসারের জালে আবদ্ধ নারীরা, যারা জানে তাদের প্রেম নির্ভেজাল, নিখাদ, অথচ সেই প্রেমের পরিবর্তে তারা পায় অনেক উপেক্ষা, অনেক ব্যভিচারিতা আর অনেক দুঃখের নির্বাসন। তারা কোথায় যায়, কোন এন জি ও-তে? মুক্তির কোন রূপ দেখে তারা, সন্তানের মাধ্যমে না টেলিভিশনে? কে মুক্তি দেবে তাদের? ‘সত্যমেব জয়তে’র আমির খান?
তাদের মুক্তি দেয় নীহারিকার মতো উদার মন, যে হতাশ আত্মাদের আশার হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু পারে কি সেই মেয়েরা অস্বীকার করতে তাদের অবিবেকী স্বামীকে? তাকে ছেড়ে দিতে? মুক্তি কি তারা দেখে সেই পথে? হাঁটতে পারে ন্যায়ের সন্ধানে, আপসহীন? মার্টিন লুথার কিং-এর কথায়, ‘until justice rolls down like waters and righteousness like a mighty stream’. এই প্রতিজ্ঞা কি আমরা দিতে পারি? এর পরিণামের মোকাবিলা কি করতে পারি আমরা?
নীহারিকা বোঝে, সংসারের জেলে সে সত্যি সত্যি বন্দি। বন্দি তার জীবনের অন্যতম অমূল্য ভালবাসা স্নেহ মমতা জড়ানো শিশুর প্রেমের স্বাধীনতা বিস্তারে, যে শিশুর আঁখিপল্লবে শুধুই জিজ্ঞাসা। শুধুই প্রশ্ন, তার সন্তান ‘স্পেশাল চাইল্ড’, মূকবধির বলে কি সে তার মায়ের কাছে প্রিয় নয়? তার স্তনের দুধ খেয়েই তো সে বড় হয়েছে।
এই রকমই নিরুপায়রা তো মুক্তি খুঁজছে, আমাদের সো কল্ড মুক্ত ডেমোক্রেটিক সমাজে খুঁজে চলেছে একটা লুকোনোর আস্তানা। কন্যাসন্তান হলে তার পিতার ঘৃণিত দৃষ্টি থেকে মুক্তি চাইছে। পত্রপত্রিকা খুললেই দেখা যায় শুধু এই সব শিশুর প্রতি বিদ্বেষ। অত্যাচার আর মৃত্যুর কাহিনি। ওরা বলছে আমরা মুক্তি চাই। হরিয়ানাতে ভ্রূণহত্যার জন্য আজ নারীসংখ্যা এতটাই কমে গিয়েছে যে, মা হওয়ার বাসনা মুছে যাচ্ছে নারীজাতির অন্তর থেকে। কোন তীব্র প্রতিবাদ মুক্ত করবে এদের? সে রকমই এক মুক্তির শরিক হয়ে ক’জন পারবে হেলেন কেলারের মতো জীবনের উত্তরণ ঘটাতে?
নারী স্বল্পভাষী, স্মিত। নারী পরিমিত, কিন্তু নারী যখন তার দুর্বার রূপ ধারণ করে? যেমন ‘তিন কন্যা’ নামে যে চলচ্চিত্রটি আসছে, সেখানে আমি অপর্ণা, যার ভাষা স্মিত কিন্তু তার তেজ দুর্বার, তার দৃষ্টি স্থির, অথচ চিত্ত চঞ্চল। কেমন মুক্তির পথে চলতে চাইছে সে? যা যুক্তি তক্ক গল্পের বাইরে? পুড়তে পুড়তে জ্বলতে জ্বলতে সে শান্ত হয়ে গিয়েছে। হয়তো তার হৃদয়ের মুক্তি হবে। বা অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায়ের ‘তিন কন্যা’র ন্যান্সি, যে পীড়া নামক বস্তুটির সঙ্গে বাঁচতে বাঁচতে কষ্টের মুক্তিকেই আপন করে নিয়েছে।
আমরা আসলে যে মুক্তির কথা বলছি, সেই মুক্তি কি দেশের, পরিবারের, সমাজের না আমাদের ভেতরের মানুষদের? মৃত্যুই কি মানুষকে একমাত্র অসীম মুক্তি দিতে পারে? আমার বাবার মর্মান্তিক মৃত্যু আমাকে অসম্ভব পীড়া দিয়েছিল, কেন আমার মনে হয় না, সেই মৃত্যু মুক্তির?
ফিরে আসি মুক্তধারায়। এক ছোট্ট প্রাণের কথায়, যে মুক্তি নামক বিস্ময়ে একেবারে সম্মোহিত। নাচ তার প্রিয়, তার ভালবাসা। সেই ছোট্ট নারী, কিশোরী, নাম: স্পৃহাদিদিমণি। নীহারিকার একমাত্র সন্তান। সেও এই ‘মুক্তধারা’য় অপূর্ব নারী আন্দোলনের শরিক। কিশোরী স্পৃহাও কোথাও বিদ্রোহ অনুভব করে। সে তার নিজের মুষ্টিমেয় শিশুশক্তি দিয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে তার অতি প্রিয় কালুয়ামামাকে, যে তার শিশুমনের কাছে ক্রিমিনাল নয়। সে ওই মানুষগুলোকে ভালবাসে, তাদের আর একটি সুযোগ দিতে চায়।
সুযোগ দিতে চায় নীহারিকাও। আমরা তো সবাই ছোট বড় অপরাধ করি, কিন্তু আমরা কি একটা দ্বিতীয় চান্স পেতে পারি না? তা না হলে মুক্তির পথ আমরা কী ভাবে নির্ণয় করব? কী ভাবে?
|
|
ছোট্ট শিশুও এনে দেয় মুক্তি, সেও তার মতো অন্য পাঁচটা শিশুর মুখে ভাষার সন্ধান দেয়। আর সেই ভাষা সঞ্চার করে নীহারিকা চ্যাটার্জি। সে মনে করে জীবনটা অনেক সুন্দর অনেক বড়, অনেকটা আয়তন জুড়ে, যা আমাদের সন্ধানের বাইরে। আমিও ঠিক তাই মনে করি। জীবনটা বড় আকাঙ্ক্ষিত, জীবনে বাঁচার অধিকার সবার আছে। ভুল সংশোধনের সুযোগ পেতে হবে। নেগেটিভ এনার্জিকে দূরে ঠেলতে হবে। নতুন সূর্য দেখতে হবে। জীবনের সমস্ত বাধার পরেও, নানা বঞ্চনার পরেও সেই সাবকনসাস লেভেল, কিংবা হয়তো তারও নীচে যে এক্সট্রাসেনসরি পারসেপশন, সেখান থেকেই আমার মুক্তির বোধ আসে।
আমি সেই অবচেতনের, সেই চেতনা-অতিক্রমী অনুভূতির খোঁজ করব। আমার মুক্তি আছে কর্মে, মুক্তি আছে ক্ষমায়। নীহারিকা সংগ্রামে মুক্তি দেখে, মুক্তির সংজ্ঞা সে নিজে ঠিক করে, মুক্তিকে দেখে শ্রদ্ধায়।
আজকের চলচ্চিত্রে আমি মুক্তি খুঁজে পাই। কখনও চারুলতার মতো এক ব্যতিক্রমী নারী হয়ে, কখনও নীহারিকা, কখনও অপর্ণা, কখনও আলো, কখনও রমিতা, কখনও ‘আরোহণ’-এর দেহাতি মেয়ে হয়ে। কখনও আরও অনেকে। সিনেমাকে সাধারণ থেকে অসাধারণত্বের জায়গায় নিয়ে যায় সেই অনেক নারী। সাধারণ থেকে অসাধারণ সব চরিত্র হয়ে ওঠে সিনেমার ভাষা। সিনেমার ভাষাকে আন্দোলনের পথ দেখায় সেই নারীরা, যারা মুক্তি খোঁজে প্রতিবাদে, আন্দোলনে।
প্রতিবাদী নারীকণ্ঠ আজ আমাদের চলচ্চিত্রে নারীকে দিচ্ছে সেরার শিরোপা। ‘ডার্টি পিকচার’-এ সিল্ক আজ প্রতিবাদ করে নাচের মাধ্যমে। নাচে আছে তার প্রতিবাদী মুক্তি। কখনও বিদ্যা হয়ে সে মুক্তি খোঁজে কলকাতার রাস্তায়। তখনই কি জীবন নাটক হয়ে ওঠে আর নাটক জীবন? নীহারিকার সেই নাচই কি প্রতিবাদ এনে দেয়? নৃত্যশৈলী কি এক নারীকে দেখায় জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দ, শ্রেষ্ঠ মুক্তি? কী আছে মুক্তির মতে, কী আছে মুক্তির পথে? না কি জীবননাট্যমঞ্চে এটা শুধুই একটা হ্যালুসিনেশন? বিভ্রম?
উত্তর আমাদের জানা নেই। নীহারিকা ছৌ নৃত্য আর কালারিপাইটু (কেরলের এক যুদ্ধ-নৃত্য) দিয়ে তার জীবনদৃষ্টি আবাসিক ভাই-বন্ধুদের শিরায় ধমনীতে ধাবিত করেছিল। সে বিশ্বাস করেছিল, কালচারাল থেরাপি সবার মধ্যে পরিবর্তন আনবে। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে এই মানুষগুলির মধ্যে হয়তো এ রকমই নীহারিকারা কাজ করছে। তার বিশ্বাসে আমার বিশ্বাস এ বার মিলে মিশে একাকার। সে অনুভব করিয়েছিল, ভালবাসার বন্ধন হচ্ছে মুক্তিকে খোঁজার মূল মন্ত্র। ঘৃণার দেশে বাস করে করে যারা আত্মমর্যাদা আর আত্মবিশ্বাস কথাগুলো ভুলতে বসেছিল, নীহারিকা তাদের মজ্জাগত করিয়েছিল ভালবাসার বাঁধন। ঘৃণাকে আর ঘৃণিত না করে, নিশ্বাসে আর বিষ না দিয়ে, জিহ্বাতে আর গরল না ঢেলে, তাদের অধর দিয়ে বেরোল ‘মা নিষাদ...’ আদিকবির সেই প্রথম দুই পঙ্ক্তি। নীহারিকা পেল তার সৃষ্টির অন্তিম সুখ, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বেজে উঠল জীবন। আমি ব্যতিক্রমী, আমি সারল্যে মুক্তি খুঁজি, যে রকম ছোট্ট স্পৃহা মুক্তির আলো দেখায়, তার মতো আর সবাইকে আলোকেরই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দিয়ে, এমনকী রাশভারী রক্ষণশীল তার পিতাকেও। নীহারিকা এক আত্মদহন থেকে আত্মশুদ্ধির পথ নির্ধারণ করে, সবার জন্যে। দশ ফুট বাই দশ ফুট জেলের দগ্ধানো মানুষগুলিকে মুক্তধারা দান করে। নিজেও সে সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়, শিবপ্রসাদ-নন্দিতার সৃষ্টি এই ‘মুক্তধারা’য় এক তৃপ্তির মুক্তি অনুভব করে।
সংসার থেকে সংশোধনাগার, এক লম্বা জীবনের দৌড়। উপেক্ষা আর সমাদরকে যে একই ভাবে আত্মস্থ করতে হয়, নীহারিকা শেখায় আমাকে। আমি তাকাই নীহারিকার চোখের দিকে, আমি দেখি নীহারিকার চোখে কোনও দ্বিধা নেই, নেই কোনও কম্পন, তার দৃষ্টি বলিষ্ঠ। নারীশক্তি দেখি, এই পৃথিবীর, আমি দেখি এক অন্য আমিকে।
মুক্ত, ইমানসিপেটেড, স্পিরিটেড মুক্তির পথপ্রদর্শক এক অন্য মানুষ। এক অন্য নারী। |
|
|
|
|
|