এক-দু’সপ্তাহ নয়। বর্ষাকাল বলতে যা বোঝায়, তা যেন পাক্কা দেড় মাস পিছু হেঁটেছে! মেয়াদও সাড়ে তিন থেকে কমে দাঁড়িয়েছে কার্যত তিন মাসে।
এবং পশ্চিমবঙ্গে এই ‘পরিবর্তনের’ জের সামলাতে গত ক’বছর ধরে হিমসিম খাচ্ছেন কৃষকেরা। কারণ, ‘সনাতনী’ বর্ষা-সূচি অনুযায়ী এ রাজ্যে ধানচাষের যে বরাবরের নির্ঘণ্ট, বর্ষাবদলের ধাক্কায় তা ভেস্তে যাওয়ার জোগাড়! বীজতলা তৈরি থেকে ধান রোয়ার মধ্যে অনেকটা সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। সেই বেশি বয়সের চারা থেকে যে ধান উঠছে, তার অনেকটাই অপুষ্ট। এতে ফলন কমছে। আবার দেরিতে রোয়া ধান যখন পাকছে, তখন দেখা যাচ্ছে সেপ্টেম্বরের অতিবৃষ্টির জলে খেত টইটম্বুর। কেটে তোলার সময়ে বিস্তর পাকা ধান স্রেফ ঝরে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। প্রভাব পড়ছে সার্বিক উৎপাদনে।
বর্ষার খামখেয়ালিপনায় ধানের উৎপাদন যে বেশ ক’বছর ধরে মার খাচ্ছে, রাজ্যের রিপোর্টেও তা স্পষ্ট। ‘অ্যাকশন প্ল্যান অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শীর্ষক ওই রিপোর্ট মোতাবেক, ২০০৮-০৯ অর্থবর্ষের তুলনায় ২০০৯-১০ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গে আউস ধানের উৎপাদন কমেছে ১ লক্ষ টনের বেশি। আমনের ফলন কমেছে প্রায় ৬০ লক্ষ টন। যে রাজ্যে প্রধান খাদ্য ভাত এবং প্রধান ফসল ধান, সেখানে এ হেন পরিস্থিতিতে সরকার ও কৃষি-মহল স্বভাবতই উদ্বিগ্ন। |
বর্ষার ‘ক্যালেন্ডার’টাই যে হেতু পিছিয়ে গিয়েছে, সেই মতো ধানচাষের সময়টাও পিছিয়ে দেওয়া যায় না?
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, না। কারণ ধান একটা নির্দিষ্ট সময়ের ফসল। বীজতলা থেকে চাষির গোলায় উঠতে ধানের মোটামুটি ১০০-১৬০ দিন লাগে। পিছিয়ে-যাওয়া ও মেয়াদ-ছাঁটা বর্ষায় ওই সময়টা পাওয়া কঠিন। উপরন্তু ‘নতুন ধারা’র বর্ষাকালের শেষ দিকটায় অতিবৃষ্টির বিপদ রয়েছে। আরও বড় সমস্যা, ধানকে ঠেলে পিছনে নিয়ে গেলে পরের দফার আলু-কপি-লঙ্কার মতো সব্জির চাষ কখন হবে? কোথায়ই বা হবে? ধান উঠে যাওয়ার পরে ওই জমিতেই তো শীতের ফসল ফলানোর কথা!
সঙ্কট সমাধানের অন্য উপায় নিয়ে তাই চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে বিজ্ঞানীমহলে। যেমন, চুচুঁড়া ধান গবেষণাকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা বর্ষাবদলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কম জলে ধান চাষের বিকল্প পদ্ধতির কথা ভাবছেন। কী রকম?
ওখানকার বিজ্ঞানী বিজন অধিকারীর দাওয়াই, “ধানের গোড়া সব সময় জলে ডুবিয়ে রাখতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। বরং জমি এক বার ভিজিয়ে-এক বার শুকিয়ে ভাল ফলন সম্ভব। এতে রোগ-পোকার উপদ্রবও কমে।” এ ছাড়া কম জলে ধান চাষের একটি পদ্ধতি (সিস্টেম অফ রাইস ইন্টেনসিফিকেশন, সংক্ষেপে এসআরআই বা শ্রী) পশ্চিমবঙ্গে দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে বলে বিজ্ঞানীদের দাবি। তাঁদের বক্তব্য: এতে জল ও বীজ লাগে যথেষ্ট কম। তুলনায় কমবয়সী চারা রোয়া সম্ভব, রাসায়নিক সারের দরকার নেই। এবং শ্রী চাষে মাঠে ঘাস-আগাছা ও রোগ-পোকার আক্রমণও নগণ্য।
পাশাপাশি ‘জিরো টিলেজ’ বা বিনা কর্ষণের ধান জনপ্রিয় করতে বিভিন্ন ব্লকে চাষিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কৃষি দফতর। ওই পদ্ধতির বিরাট সুবিধা, বীজতলা লাগে না। অর্থাৎ ধানের চারা না-বানিয়ে বীজ সরাসরি খেতে পুঁতে দিলেই চলে। জমিতে সঞ্চিত জলীয় বাষ্পে, প্রয়োজনে অতি সামান্য সেচের সাহায্যে তা অঙ্কুুরিত হতে পারে। বীজ বুনতে হয় একটা যন্ত্র মারফত, যা জোড়া থাকে ট্র্যাক্টর বা পাওয়ার টিলারের পিছনে। জিরো টিলেজেও জল ও সারের প্রয়োজন অল্প। বাঁকুড়া ধান গবেষণাকেন্দ্র জোর দিচ্ছে ‘অ্যারোবিক রাইস’ নামে একটা জাতের ধানে। ওখানকার বিশেষজ্ঞদের দাবি, কম বৃষ্টির খরাপ্রবণ এলাকায় অ্যারোবিকের চাষ খুবই ফলপ্রসূ। এতেও বীজতলা তৈরির ঝামেলা নেই। জল যেমন কম লাগে, বীজও লাগে কম। আরও উল্লেখযোগ্য, অ্যারোবিকের চাষ
প্রভূত পরিবেশ-বান্ধব। তা জমি থেকে মিথেন গ্যাস নির্গমনের সম্ভাবনা কমায়।
বর্ষার ‘পশ্চাদপসরণে’ উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কারিগরি সহায়তা চেয়েছে। এ কথা জানিয়ে শুক্রবার রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “জলবায়ু যে ভাবে বদলে যাচ্ছে, তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে আমাদের চাষের পদ্ধতি বদলাতে হবে। বিকল্প পদ্ধতিতে অন্তত ৩০% জমিতেও চাষ করা গেলে সঙ্কট অনেকটা সামাল দেওয়া সম্ভব।” তবে কৃষি-বিজ্ঞানীদের একাংশ শ্রী ছাড়া অন্যান্য পদ্ধতির সাফল্য সম্পর্কে এখনও নিঃসংশয় নন। কেন?
ওঁদের ব্যাখ্যা, এ রাজ্যে মোট জমির ৪৩% নাবাল। অর্থাৎ নিচু জমি। সেখানে জিরো টিলেজ বা অ্যারোবিকের মতো ‘শুখা’ পদ্ধতির চাষের ঝুঁকি নেওয়া মুশকিল। কেননা নাবাল জমির বহু জায়গায় দু’দিনের বৃষ্টিতেই জল জমে যায়। শ্রী চাষে অবশ্য অল্প সময় জল জমে থাকলেও ফলনে ইতরবিশেষ হয় না।
অর্থাৎ সমস্যার নিশ্চিত সমাধানের উপায় এখনও নেই। এই অনিশ্চয়তাই কি চাষিদের ভবিতব্য হয়ে থাকবে? অনিশ্চয়তা কাটাতে বিজনবাবু জোর দিচ্ছেন দেশি ধানেই। তাঁর কথায়, “প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা সহ্য করার ঐতিহ্যগত ক্ষমতা এগুলোর রয়েছে। বেশ কিছু জাতের দেশি ধান খরা-পরিস্থিতি বা হঠাৎ প্রবল বৃষ্টিপাতের ধাক্কা সামাল দিতে সক্ষম।” বিজনবাবুর দাবি: কয়েকটি দ্রুত ফলনশীল (জলদি জাতের) ধান চাষ করলেও বিলম্বিত বৃষ্টিপাতের মোকাবিলা সম্ভব। কারণ, ওগুলো ৯০-৯৫ দিনে পেকে যায়। যাদবপুরের অর্থনীতির শিক্ষক তথা বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির ব্যবস্থাপক জয়শ্রী রায়ও মনে করছেন, অল্প দিনে ফলন দেয়, এমন ‘জলদি’ জাতের ধান চাষ করা ছাড়া বিশেষ উপায় নেই।
বস্তুত বর্ষার মতিবদলের জেরে তাতে অদূর ভবিষ্যতে সেচের জন্য খাল-বিলের জল তো নয়ই, মাটির নীচের জলও মিলবে না বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন নদী ও ভূ-জল বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র। তাঁর ব্যাখ্যা, “এত কাল নিয়ম ছিল, জুন মাসে প্রথম বৃষ্টির জল পড়তেই শুকনো মাটি ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নেবে। তা মাটিতে রস জোগাবে, ভূগর্ভের জলস্তরকে সমৃদ্ধ করবে। ইদানীং তা হচ্ছে না।” অল্প সময়ে অনেক বৃষ্টিও কাজে লাগছে না। কারণ, অতিবৃষ্টির বেশিটাই গড়িয়ে নদীতে চলে যায়, কিংবা বন্যা ডেকে আনে। মাটির নীচে যায় সামান্য।
ফলে চাষ-আবাদ ভূগর্ভস্থ জলের উপরে অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে বলে কল্যাণবাবুর দাবি। অথচ সেচের তাগিদে মাটির তলা থেকে তুলে নেওয়া জলের ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না। এতে আর্সেনিক দূষণ বাড়ছে।
এ যেন এক দুষ্টচক্র।
|
পিছোচ্ছে বৃষ্টি |
সাবেকি ধারা |
নতুন ধারা |
আষাঢ়ের শুরু থেকে ভাদ্রের গোড়া
(মাঝ জুন থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ) |
শ্রাবণের শেষ থেকে আশ্বিনের গোড়া
(অগস্টের শুরু থেকে অক্টোবরের শেষ) |
|
বিকল্প-সন্ধান |
শ্রী পদ্ধতির চাষ
কমবয়সী চারা রোয়া যায়, ফলন বেশি
জিরো টিলেজ
বীজতলার দরকার নেই, খরচ নগণ্য
অ্যারোবিক ধান
খরাপ্রবণ অঞ্চলেও সরাসরি বীজ বোনা যায়
নষ্ট সময়ে অন্য ফসল
কম সার ও জলে ভুট্টা-ডাল-বাজরা, স্বল্পমেয়াদি সব্জি |
|