ফড়েরা সব্জির ‘ন্যায্য দর’ দিতে না চাওয়ায় মারমুখী হয়ে উঠলেন চাষিরা। এবং রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, চাষিদের এই ‘প্রতিবাদ’ তাঁরা সমর্থন করেন।
রাজ্য সরকার সব্জির দামের উপর নজরদারি শুরু করার পর থেকেই বিভিন্ন জেলায় চাষিরা অভিযোগ করছিলেন, ফড়েরা যথেষ্ট দাম দিচ্ছেন না। তাঁদের হয় জলের দরে সব্জি বিক্রি করতে হচ্ছে অথবা ফেলে দিতে হচ্ছে। এর আগে রাস্তায় সব্জি ফেলে অবরোধ থেকে ফড়েদের ঘেরাও করে রাখা, সবই ঘটেছে।
বৃহস্পতিবার সব্জির দাম নির্দিষ্ট করা নিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরে চারঘাট হাটে চাষি ও ফড়েদের মধ্যে ঝামেলা বেধে যায়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দফায়-দফায় মারপিট, ভাঙচুর, পথ অবরোধ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। দু’পক্ষের পাঁচ জন জখম হন। নষ্ট হয় বেশ কয়েক লক্ষ টাকার সব্জি। বিশাল পুলিশবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে। তবে কেউ গ্রেফতার হয়নি। |
বিকেলে রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “স্বরূপনগরে চাষিরা যে ভাবে প্রতিবাদ করেছেন, তা আমি সমর্থন করি। ফড়েরা অন্যায় ভাবে চাষিদের কম দামে কাঁকরোল বিক্রি করতে বাধ্য করছিলেন। ঘটনাটি জানতে পেরে আমি জেলাশাসককে ব্যবস্থা নিতে বলি। জেলাশাসকের নির্দেশে বিডিও এবং পুলিশ সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করে কাঁকরোলের দাম বেঁধে দেয়। রাজ্যের যেখানে অশান্তি হবে, সেখানেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
গত ২০ জুলাই চারঘাটের পাশে বাদুড়িয়ার রামচন্দ্রপুর হাটে চাষি ও ফড়েদের গণ্ডগোলের জেরে পথ অবরোধ হয়েছিল। এর পরে সব পক্ষের বৈঠকে ঠিক হয়,
স্থানীয় যুবকদের নিয়ে ‘হাট কমিটি’ গড়া
হবে। তারাই ব্যবসায়ী ও চাষিদের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলবে। স্থানীয় বিভিন্ন হাটে মাইকে তা প্রচারও করা হয়। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। এ দিন সকাল ৮টা নাগাদ চারঘাটে গোলমাল শুরু হয়। চাষিদের অভিযোগ, ভোরে পটল ১৪ টাকা ও কাঁকরোল ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও বেলা বাড়তেই দাম অর্ধেকে নেমে যায়।
ক্ষুব্ধ চাষিদের একাংশ রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ শুরু করেন। ফড়েদের সব্জির গাড়ি আটকে যায়। দু’পক্ষে হাতাহাতি বাধে।
খবর পেয়ে স্বরূপনগর থানা থেকে পুলিশ গিয়ে হাট কমিটি, চাষিদের প্রতিনিধি ও সব্জি ব্যবসায়ী ইউনিয়নের সম্পাদককে নিয়ে বৈঠক করে। দুপুর ১টা নাগাদ সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়, অন্য সব্জির দাম অপরিবর্তিত রেখে শুধু কাঁকরোল সাড়ে ৮ টাকা ও পটল ৮ টাকা কেজি দরে কিনবেন ফড়েরা। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ বেশ কিছু ফড়ে হাট ছেড়ে চলে যান। এর পরেই চাষিরা ফের খেপে ওঠেন। কিছু ব্যবয়াসী ও চাষিদের মারামারি বেধে যায়। পুলিশের সামনেই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় ব্যবসায়ীদের বস্তা ও ঝুড়িতে। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় হাটের দু’টি চালা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নষ্ট করা হয় সব্জি। দু’টি গাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হয়। পুলিশ বাধা দিতে গেলে তাদেরও হেনস্থা করা হয় বলে অভিযোগ। স্বরূপনগরের বিডিও অরুণাভ পাল এবং এসডিপিও (বসিরহাট) আনন্দ সরকার বাহিনী নিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। |
স্বরূপনগর ও বাদুড়িয়ার হাটগুলিতে সব্জি বেচাকেনা নিয়ন্ত্রণ করে মছলন্দপুর বাজার সমিতি। সেই সমিতির সম্পাদক পরিমল ঘোষের বক্তব্য, “অতিরিক্ত ফলন হওয়ায় দাম বেশি ওঠানামা করছে। জ্বালানির দাম বাড়া এবং ট্রাকে ওভারলোডিং নিয়ে প্রশাসনের কড়াকড়িতেও সমস্যা হচ্ছে। এ দিন সকলের সঙ্গে কথা বলে আমি দাম ঘোষণা করেছিলাম। কিন্তু ওই সময়ে কিছু চাষি আমার উপরে চড়াও হওয়ায় অন্যেরা ভয়ে পালান। সেই সুযোগে কয়েক জন ব্যবসায়ীদের কেনা ফসলের ক্ষতি করে।” ব্যবসায়ী শুভঙ্কর পোদ্দারের দাবি, “ভোরে ও বেলায় সব্জির দাম ওঠানামা নতুন কিছু নয়। আমার কেনা প্রায় দু’লাখ টাকার ফসল নষ্ট করা হয়েছে।”
স্থানীয় চাষি সুশান্ত মণ্ডল, প্রশান্ত ঘোষরা পাল্টা বলেন, “যে ভাবে সার ও কীটনাশকের দাম বেড়েছে সেই অনুপাতে সব্জির দাম বাড়ছে না। ফড়েরা দরে ব্যাপক হেরফের করাচ্ছে। এ দিন ওরা দাম ঠিক করেও পরে তা দিতে না চাওয়াতেই চাষিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। কারণ ফসল আর বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না।’’ তাঁদেরও বেশ কয়েক লক্ষ টাকার সব্জি নষ্ট হয়েছে বলে চাষিদের দাবি। পরে সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করে বিডিও বলেন, “আপাতত একটি কমিটি গড়া হবে, যারা হাটবারে ব্যবসায়ী ও চাষিদের সঙ্গে কথা বলে বোর্ডে ফসলের দাম লিখে টাঙিয়ে দেবে।” তবে ব্যবসায়ীদের অনেকেরই দাবি, এই ব্যবস্থা চলতে পারে না। কৃষি বিপণন মন্ত্রী বলেন, “ফড়েদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে রাজ্য সরকার শীঘ্রই সর্বজনগ্রাহ্য নীতি নেবে।” |