|
|
|
|
ধুতি ছেড়ে শেরওয়ানি, পোশাকি চমক প্রণবের |
অগ্নি রায় • নয়াদিল্লি |
গলাবন্ধ কোট নয়, ধুতি-পাঞ্জাবিও নয়। শপথ নিলেন শেরওয়ানি পরে। ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতির প্রথম ‘চমক’ এল পোশাকে!
প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি! শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রণব মুখোপাধ্যায় ধুতি পরেন কি না, তাই নিয়ে যথেষ্ট কৌতূহল ছিল। অনেকে আবার ভেবেছিলেন, প্রণব হয়তো হাজির হবেন সেই চেনা কোট পরেই! কিন্তু গত কালই পোশাকের জন্য মহড়া দেওয়ার সময় প্রণববাবু বলে দিয়েছিলেন, “আমি শেরওয়ানি পরব। কারণ, এটি আনুষ্ঠানিক (সেরিমোনিয়াল) পোশাক। রাধাকৃষ্ণন শেরওয়ানি পরতেন, নেহরুও তা-ই।”
বাঙালিয়ানার সিলমোহর, ধুতি নয় কেন? প্রণববাবুর মতে, ধুতি-পাঞ্জাবি একটি ‘সামাজিক পোশাক’। ‘সরকারি’ বা ‘জাতীয়’ পোশাক নয়। গলাবন্ধ কোট ‘সরকারি পোশাক’ হিসেবে ভাল। কিন্তু রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণের মতো ‘অনুষ্ঠানের জন্য মানানসই হল শেরওয়ানি।’ মুম্বইয়ের বিশেষ দর্জিকে দিয়ে আজকের এই কালো শেরওয়ানিটি তৈরি করান প্রণববাবুর ছোট ছেলে ইন্দ্রজিৎ মুখোপাধ্যায়।
আলাদা করে খুব ফ্যাশনদুরস্ত না হলেও পোশাকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সংস্কৃতির দিকটি প্রণববাবু মাথায় রাখেন বরাবর। তাঁর সংগ্রহে বেশ কয়েক সেট শেরওয়ানি আগেও ছিল। রাজধানী তাঁকে সেই পোশাকে বিশেষ দেখেনি বটে। কিন্তু যখনই পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে গিয়েছেন, প্রণব শেরওয়ানি পরেছেন। এক বার প্যারিস যাওয়ার পথে ‘রি-ফুয়েল’ করার জন্য দাঁড়াতে হয়েছিল তেহরানে। সেখানে ইরানের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকেও শেরওয়ানি পরেছিলেন প্রণব। |
|
|
‘পরিচিত’ প্রণববাবু। |
অভিষেকের দিনে। ছবি: এএফপি। |
|
কিন্তু সে তো বিদেশে! এমনিতে সাধারণত সরকারি অনুষ্ঠান মানেই তাঁর পরনে থাকত গলাবন্ধ কোট। আবার দলীয় বা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে, নিজের রাজ্যে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন চিরাচরিত ধুতি-পাঞ্জাবিতে। পোশাকের এই নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভাষার খাতিরেই কি বাঙালি আবেগের বড় অংশ আজ প্রণববাবুকে ধুতি-পাঞ্জাবিতে দেখতে চাইছিল না? জ্যোতি বসুকে যেমন বাঙালি চিরকাল ধুতি আর পাম শু পরতেই দেখেছে। ঠান্ডার দেশে গেলে আলাদা কথা। নচেৎ রাজধানীতে সর্বদলীয় বৈঠকের ক্ষেত্রেও তার নড়চড় হয়নি। দল তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হতে দিলে কি পোশাক বদলাতেন জ্যোতিবাবু? তর্কবিতর্ক চলছেই।
প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের (রাষ্ট্রপতি পদে যাঁর নাম এ বার প্রস্তাব করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) কথাই ধরা যাক! সোমনাথ জানাচ্ছেন, “প্রণববাবু আজ শেরওয়ানি পরেছেন। পোশাকটি যথেষ্ট সম্মানজনক সন্দেহ নেই। তবে বঙ্গসন্তান হিসেবে যদি তিনি ধুতি পরতেন, তা হলে এক অন্য দর্শন তৈরি হত।” দক্ষিণের নেতারা যেমন নিজেদের রীতি অনুযায়ী লুঙ্গির মতো করে ধুতি পরে থাকেন। সর্বোচ্চ সরকারি অনুষ্ঠানেও তার ব্যত্যয় হয় না। করুণানিধি থেকে দেবগৌড়া, মায় পি চিদম্বরম পর্যন্ত ওই পোশাকে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত কাল রাতে প্রণবকে উপহার দিয়েছেন তসরের ধুতি-পাঞ্জাবি। তৃণমূলের মন্ত্রীরা যখনই শপথ নিয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা পরেছেন ধুতি-পাঞ্জাবি। ফিকি-র কর্তা হিসেবে যে অমিত মিত্রকে দিল্লি কোট-প্যান্টালুন ছাড়া কখনও দেখেনি, সেই তিনিও এখন সদাসর্বদা ধুতিতে স্বচ্ছন্দ। তৃণমূলের আর এক ধুতি-পরিহিত নেতা-মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বললেন, “শেরওয়ানি জাতীয় পোশাক। প্রণববাবু সেটা পরতেই পারেন। কিন্তু
এক জন বাঙালি হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ পদে শপথ নেওয়ার সময় যদি তাঁকে ধুতিতে দেখতাম, ব্যক্তিগত ভাবে গর্বিত হতাম।”
অন্য দিকে আর একটা যুক্তিও রয়েছে। সেই যুক্তি বলছে, প্রণববাবু মনেপ্রাণে বাঙালি হয়েও কি রাজনীতিতে, কি প্রশাসনে বরাবর সর্বভারতীয়তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নেওয়ার সময় সেই জন্যই কি রাখতে চাইলেন না প্রাদেশিকতার ছোঁয়া? ধুতি-পাঞ্জাবিতেই অভ্যস্ত সিপিএম নেতা বিমান বসু সেই দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, প্রণব মুখোপাধ্যায় কিন্তু শুধু বাঙালি বা বাংলার নন। তিনি গোটা দেশের রাষ্ট্রপতি।”
বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি রাজনাথ সিংহেরও একই মত। নিজে বরাবর ধুতি পরেন। তাঁর কথায়, ধুতি-শেরওয়ানি দু’টোই আদ্যন্ত ভারতীয় পোশাক। “এ দেশের নেতা থেকে সাধারণ মানুষ, দীর্ঘদিন ধরে এই
দু’টো পোশাকই পরে আসছেন। প্রণববাবুর আজকের পোশাকে ভারতীয়ত্বই ফুটে বেরিয়েছে।”
ঘটনা হল, সংবিধানে কোনও একটি পোশাককে জাতীয় পোশাক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়নি। বহুল ব্যবহৃত হওয়ার কারণে গলাবন্ধ কোট-প্যান্টকে ‘সরকারি পোশাক’ হিসাবে গণ্য করা হয়। রেওয়াজ অনুসারে শেরওয়ানি অথবা গলাবন্ধ কোট, দুটোই আনুষ্ঠানিক পোশাকও বটে। স্বাধীন ভারতে এই পোশাককে সরকারি পোশাক হিসেবে চালু করেছিলেন জওহরলাল নেহরুই। উত্তর ভারতীয় আচকানের ধাঁচে তৈরি গলাবন্ধ এই ‘নেহরু-কোট’কে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ফ্যাশন-তালিকায় সর্বকালীন সেরা দশের মধ্যে ধরা হয়।
ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর সরকারি পোশাকের ক্ষেত্রেও এক ‘নৈরাজ্য’ শুরু হয়েছিল। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর কথায়, ‘‘মহিলা কর্মচারীরা আপিসে আসতেন এমন সেজে, মনে হত যেন ভরতনাট্যমের অনুষ্ঠান করবেন! পুরুষেরাও যা-ইচ্ছে-তাই পরতেন (‘কালচার ইন দ্য ভ্যানিটি ব্যাগ’)।” বারবার ‘নোট’ পাঠিয়ে নেহরু তখন উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের শেরওয়ানি পরে আসার পরামর্শ দেন।
শুধু আধিকারিক নয়, নেহরু ‘বিপদে’ পড়েছিলেন বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদকে নিয়েও! লর্ড মাউন্টব্যাটেনের বিদায়-অনুষ্ঠানে জওহরলাল চেয়েছিলেন, স্বাধীন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ কোনও একটি বিশিষ্ট পোশাকে সাজুন। চিরকেলে ধুতি-কুর্তায় স্বচ্ছন্দ রাজেন্দ্রপ্রসাদ জানান, তা হলে গায়ে তিনি একটি কালো চাদর দিয়ে নেবেন! আঁতকে ওঠেন নেহরু! পরে চিঠি লিখে রাজেন্দ্রপ্রসাদকে সাদা চুড়িদার আর শেরওয়ানি পরার কথা বলেন!
নেহরু থেকে প্রণব, ট্র্যাডিশন বজায় রইল। কেমন লাগল শেরওয়ানি-পরিহিত প্রণবকে? পুরুষের ফ্যাশন ডিজাইনার শর্বরী দত্ত বললেন, “আজ নতুন পদমর্যাদার সঙ্গে ওঁর এই নতুন ‘লুক’ বেশ মানিয়ে গেল।” |
|
|
|
|
|