দু’বছরে ৬ শিশুর হদিস
লাঙ্গুল-পুরাণ, আবার সে এসেছে ফিরে
খুশি হলেই ছোট্ট মেয়েটা টুকটুক করে লেজ নাড়ত। বাবার ভালই লাগত। কিন্তু লোকলজ্জা ও মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে হাসপাতালে গিয়ে লেজটা কাটিয়ে আসতে হল।
পূর্ব মেদিনীপুরের ওই তিন মাসের মেয়েটিই শুধু নয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি, বাঁকুড়ার দু’টি এবং হাওড়ার এক পুঁচকেরও লেজ ছিল। বিহারের গোপালগঞ্জের এক খুদেও জন্মেছিল লেজ নিয়ে। এই পাঁচ জনই ছেলে। বয়স তিন দিন থেকে দু’বছর। তবে এই ছেলেরা লেজ নাড়াতে পারত না।
‘ককসিক্স’ বা ‘টেলবোন’
জেমস ক্যামেরনের ‘অবতার’রাও লম্বা লেজ দুলিয়ে ঘুরে বেড়াত কল্পদুনিয়ায়। কিন্তু এই ছয় শিশু মোটেই কল্পনা নয়, বাস্তব। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বকে একটু পাশ কাটিয়ে তারা পৃথিবীতে এসে পড়েছে মানবশরীর থেকে লুপ্ত হওয়া এক অঙ্গ নিয়ে। গত দুই বছরে লেজযুক্ত এই ছয় শিশুকে খুঁজে পেয়েছেন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা। এদের মধ্যে পাঁচ জনের শরীরে অস্ত্রোপচার করে লেজ বাদ দেওয়া হয়েছে। একটি শিশুর বাড়ির লোক অস্ত্রোপচারে রাজি হননি। তাঁদের কাছে, লেজওয়ালা শিশু মানে সাক্ষাৎ হনুমানের অবতার! তাকে বিভিন্ন মেলায় দেখিয়ে তাঁরা টাকা রোজগার করেন।
১৮৮৪ সালের পর থেকে ‘ওয়র্ল্ড মেডিক্যাল লিটারেচার’-এ লেজযুক্ত ২৩টি শিশুর কথা লেখা ছিল। কিছু দিন আগেই ‘জার্নাল অফ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ পেডিয়াট্রিক সার্জেনস’-এ এই ছয় শিশুকে নিয়ে লেখা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা করেছেন নীলরতনের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের প্রধান বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়, চিকিৎসক রামমোহন শুক্ল, কার্তিকচন্দ্র মণ্ডল এবং এসএসকেএম হাসপাতালের প্যাথোলজি বিভাগের মধুমিতা মুখোপাধ্যায়। তার পরই লন্ডনের ‘ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ’ থেকে ওই গবেষণার রিপোর্ট এবং ছয় শিশুর লেজের ছবি চেয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই সংস্থার মলিকিউলার ও ক্লিনিক্যাল জেনেটিক্স বিভাগের প্রধান মাইকেল ডেরাইটসার জানান, মানবদেহে ভ্রূণ অবস্থায় প্রথম কয়েক দিন লেজের অস্তিত্ব থাকলেও তার পর তা আর দেখা যায় না। কিন্তু হাতে গোনা কিছু মানুষের শরীরে গঠনগত অসঙ্গতি হিসাবে তা থেকে যায়। এই বিরল ছবিগুলি তাঁরা লাইব্রেরিতে রেখে দিতে চান। কী করে এই ‘লেজবিশিষ্ট’ শিশুরা এল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে? পেডিয়াট্রিক সার্জারির ব্যাপারে গোটা রাজ্যের রেফারেল সেন্টার হল নীলরতন। হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় জানান, বছর দু’য়েক আগে লেজ নিয়ে হাসপাতালে পরপর দু’টি শিশু জন্মায়। তার পরই তাঁরা এ ধরনের শিশুদের একটা ‘ডেটাবেস’ তৈরির কাজ শুরু করেন। লেজ কাটানোরও ব্যবস্থা করা হয়। বিশ্বনাথবাবুর কথায়, “বাবা-মায়েরা কেউ সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েছেন, কেউ সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিয়েছেন। কারণ এঁরা সকলেই নিম্নবিত্ত পরিবারের। অল্পশিক্ষিত। লেজের সঙ্গে কিছু বিশ্বাস বা ধারণাও জড়িয়ে ছিল।”
১৯৯১ সালে পশ্চিমবঙ্গেরই বাঁকুড়ায় লেজযুক্ত এক শিশুর খোঁজ মিলেছিল বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা। ২০০১-এ আলিপুরদুয়ারে চান্দ্রে ওঁরাও নামে এক যুবকের দেহে প্রায় এক হাত লম্বা লেজ পাওয়া যায়। ২০০৮ সালে জয়পুর মেডিক্যাল কলেজের পেডিয়াট্রিক সার্জারির কয়েক জন চিকিৎসক একটি লেজওয়ালা শিশুকে নিয়ে আমেরিকার ‘জার্নাল অফ পেডিয়াট্রিক সার্জারি’তে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। পেডিয়াট্রিক সার্জন পার্থপ্রতিম গুপ্ত জানিয়েছেন, ২৩ বছরের কেরিয়ারে তিনি দু’টো ‘কেস’ পেয়েছিলেন। “আমি একে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট’ই বলব। ওই দু’জনের লেজে নার্ভ টিস্যু ছিল না।”
পুচ্ছ রহস্য
• স্পাইনাল কর্ডের একেবারে শেষ হাড়টিকে ‘ককসিক্স’ বা ‘টেলবোন’ বলে। বানরদের দেহে ওই জায়গা থেকেই লেজ তৈরি হয়।
• বিবর্তনের পথ ধরে বানর থেকে মানুষ হওয়ার পরে লেজের প্রয়োজন ফুরোল। হাত দু’টো খালি হল। গাছে ঝোলার সময় ভারসাম্য রাখার কাজে লেজের দরকার থাকল না।
• মানুষের ভ্রূণে প্রথম ৩১-৩৫ দিন লেজের অস্তিত্ব থাকে। তার পর অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে তা অদৃশ্য না-ও হতে পারে। আবার, অনেক সময় গঠনগত বিচ্যুতিতে লেজের মতো দেখতে কোনও অঙ্গ তৈরি হয়ে থাকতে পারে।

বিবর্তনের গতিতেই মানবদেহ থেকে হারিয়ে গিয়েছে লেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিভাগের শুভ রায়ের ব্যাখ্যায়, বানরের দেহে ‘টেলবোন’ থেকেই স্পাইনাল কর্ড প্রলম্বিত হয়ে লেজ তৈরি হত। কিন্তু মানুষ দু’পায়ে দাঁড়াতে শেখায় হাত দু’টো খালি হল। গাছে ঝোলার সময় ভারসাম্য রাখতে লেজের প্রয়োজন আর রইল না।
তা হলে এই শিশুদের দেহে লেজ ফিরে এল কী করে? ওয়েস্টবেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির অধিকর্তা, হিউম্যান জেনেটিক্স বিশেষজ্ঞ সুব্রতকুমার দে-র কথায়, “জেনেটিক্সে ‘অ্যাটাভিজম’ বলে একটা কথা আছে। এর অর্থ, প্রাণীর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া জিন-চরিত্র বহু বছর পরে আবার ফিরে আসে।” তিনি জানান, এক বার এক মা ও তাঁর মেয়ে তাঁদের কাছে এসেছিলেন। দু’জনের মুখের আদলই হুবহু বাঁদরের মুখের মতো। আবার রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের অধ্যাপক তুষারকান্তি ঘোষের ব্যাখ্যা, মানুষের ভ্রূণের মধ্যেও বিবর্তনের অনেকগুলি ধাপ রয়েছে। যেমন, ভ্রূণ অবস্থায় মানব হৃদপিণ্ড প্রথমে উভচরের মতো, তার পর সরীসৃপের মতো হয়। তার পর সেটা মানুষের হৃদপিণ্ডের রূপ নেয়। সেই রূপ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা থাকলে অনেকের ভেন্ট্রিকিউলে ফুটো থেকে যায়। একই রকম ভাবে অনেকের হাতের আঙুল জোড়া থাকে বা বেশি আঙুল থাকে। লেজও সেই রকম একটা বিচ্যুতি।
বানরের মতোই কোনও কোনও মানুষেরও ককসিক্স থেকে স্পাইনাল কর্ডের একটা অংশ প্রলম্বিত হয়। এতে তরণাস্থি এবং ‘নার্ভ টিস্যু’ থাকে। এমন উদাহরণ অবশ্য অত্যন্ত বিরল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানবশরীরে যেটা দেখা যায়, তাকে বলা হয়, ‘সিউডো টেল’ বা ‘ছদ্ম-লেজ’। এর মধ্যে স্পাইনাল কর্ডের একটা অংশ সরাসরি জুড়ে থাকে না। এতে তরুণাস্থি এবং ‘নার্ভ টিস্যু’ থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে। অনেক সময় শুধু মাংস-চামড়া-লোম আর কিছু ‘ফ্যাটি টিস্যু’ নিয়েই লেজের মতো একটা অঙ্গ তৈরি হয়। এখানে হদিস মেলা ছ’টি শিশুর এক জনের লেজে ‘নার্ভ টিস্যু’ ছিল। সে লেজ নাড়তে পারত। বাকিদের শুধু মাংস-চামড়া-রক্ত ছিল, কিন্তু নার্ভ ছিল না। তাই তারা লেজ নাড়তে পারত না।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.