দল এবং প্রশাসনে তাঁর পরিচয় ‘কড়া বস্’ বলে। তিনি যে কতটা ‘কড়া’, মঙ্গলবার হাতেনাতে তার প্রমাণ পেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার সদস্যরা। তাঁর সরকারের উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির অগ্রগতি এবং সেগুলি কবে শেষ হবে, তা এক সপ্তাহের মধ্যে জানতে চেয়ে সব মন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রকল্পের অগ্রগতির হিসেব কী ভাবে জানাতে হবে, তা জানাতে চিঠির সঙ্গে একটি ‘ফর্ম’ও মন্ত্রীদের দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক।
এ দিন রাতে মমতা সংক্ষিপ্ত-সফরে দিল্লি গিয়েছেন। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আজ, বুধবারই তাঁর ফেরার কথা। কিন্তু সাধারণত মুখ্যমন্ত্রী শহরে না-থাকলে মন্ত্রীদের একাংশের মধ্যে যে খানিকটা ‘ঢিলেঢালা’ ভাব থাকে, এ দিন তা উধাও! বিভাগীয় সচিবদের জরুরি তলব করে তাঁরা বসে পড়েছেন ‘রিপোর্ট-কার্ড’ তৈরি করতে।
এর আগেও মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে দফতর ধরে ধরে মন্ত্রীদের কাজের খতিয়ান নিয়েছেন মমতা। মৌখিক ভাবে কিছু কিছু মন্ত্রীকে সেই সব বৈঠকে ‘ধমক’ও দিয়েছেন। কিন্তু একেবারে চিঠি লিখে কাজের খতিয়ান চাওয়া তাঁর জমানায় এই প্রথম। এর আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা তাঁর সরকারের একবছর পূর্তিতে সমস্ত দফতরের কাছ থেকে তাদের ‘সাফল্যে’র খতিয়ান চেয়েছিলেন। কিন্তু এই চিঠি তা নয়। যে চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ‘এ রাজ্যের মানুষের উন্নয়নে আমাদের সরকার একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। আমি গভীর ভাবে বিশ্বাস করি, মানুষকে বহু প্রত্যাশিত উন্নয়নের স্বাদ দিতে যে সব প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়েছি, তা পূরণ করতে আমাদের সবরকম চেষ্টা করতে হবে। তাই, সরকারের প্রকল্পগুলি রূপায়ণের পথে কতদূর এগিয়েছে, তা জানতে চাই’।কেন এই চিঠি?
প্রশাসনিক-রাজনৈতিক মহলের অভিমত, এই পদক্ষেপ মমতা করেছেন আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিকে লক্ষ্য রেখে। গত শনিবার ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ মঞ্চে মমতা ঘোষণা করেছিলেন, পুজোর পরে পঞ্চায়েত ভোট হবে। তার আগে সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলি দ্রুত শেষ করতে চান তিনি। সে কারণেই দফতরওয়াড়ি প্রকল্পের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চেয়ে ওই চিঠি। রাজ্যের এক মন্ত্রীর কথায়, “এটা ঠিকই যে, আমরা মানুষের জন্য কাজ করছি ৩৪ বছরের বোঝা মাথায় নিয়ে। কিন্তু একবছর কেটে গিয়েছে। মানুষ এখন জানতে চাইবেন, আমরা কতটা এগোলাম।”
তাঁর চিঠিতেও মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ‘মনে রাখা উচিত, পশ্চিমবঙ্গের বিপুল মানুষের সমর্থন এবং আমাদের উপরে তাঁদের বিশ্বাস ও ভরসার ভিত্তিতেই গত বছর আমরা নতুন সরকার গড়েছি। আমরা তাঁদের প্রত্যাশা পূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’।
তৃণমূলের এক প্রথমসারির নেতার কথায়, “২০০৮ সালে এই পঞ্চায়েত ভোট থেকেই আমাদের রাজনৈতিক জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই রাজ্যের দু’টি জেলা পরিষদ আমাদের দখলে। তারপর একে একে লোকসভা এবং তারপর বিধানসভা নির্বাচনে আমরা ব্যাপক ভাবে জিতেছি। যে জনতা আমাদের জিতিয়েছে, এবার পালা তাদের প্রতিদান দেওয়ার। সরকারে থাকলে সেটাই শেষ কথা।” তৃণমূল শিবিরের আরও বক্তব্য, এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল ‘শাসক’ হিসেবে ময়দানে নামবে। গত এক বছরে সরকারের কাজকর্মের ছাপ এই ভোটে যেমন পড়বে, তেমনই ভবিষ্যতের ধারণাও পাওয়া যাবে। তা বুঝেই কোমর বেঁধেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। পঞ্চায়েত ভোট এমনিতে নির্দিষ্ট আছে ২০১৩ সালের মে-জুন মাসে। কিন্তু ভোট এগিয়ে এলে সরকারের হাতে সময় যথেষ্ট কম। তবে মন্ত্রিসভার এক সদস্যের কথায়, “এমন নয় যে, পঞ্চায়েতের আগে শুধুমাত্র কাজের অগ্রগতিই এর মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী বুঝে নিতে চাইছেন। এর মাধ্যমে মন্ত্রীদের কাজের বিচারও করে নিতে চাইছেন তিনি।” ওই মন্ত্রীর মতে, এর ‘প্রভাব’ পরবর্তী কালে মন্ত্রিসভার রদবদলেও পড়ার সম্ভাবনা।
প্রকল্পের অগ্রগতির হিসেব দেওয়ার জন্য যে ‘ফর্ম’ মন্ত্রীদের কাছে পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী, সেখানে প্রকল্পের নামের পাশাপাশি জানতে চাওয়া হয়েছে, ওই প্রকল্পের ফলে কারা উপকৃত হবেন, কবে ওই প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে, তখন খরচ কত ধরা হয়েছিল, শেষ করার সময়কাল কী ধরা হয়েছিল, কবে তা শেষ করা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে, ৩০ জুন পর্যন্ত শতকরা কত ভাগ কাজ শেষ হয়েছে এবং বরাদ্দ অর্থের শতকরা কত ভাগ পাওয়া গিয়েছে। নির্দিষ্ট প্রকল্প শেষ করতে অন্য দফতরের সঙ্গে কোনও সমন্বয় প্রয়োজন কিনা বা কোনও সাহায্যের প্রয়োজন কি না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে চিঠিতে। একই সঙ্গে জানতে চাওয়া হয়েছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রকল্প শেষ করতে গেলে খরচ কত বাড়তে পারে, তার হিসেবও।
প্রকল্পের অগ্রগতি সংক্রান্ত রিপোর্টে যাতে কোনও ‘ভুল না-থাকে, সেজন্য মন্ত্রীদের ‘ব্যক্তিগত’ ভাবেও বিষয়টি তদারক করার পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তা উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘প্রকল্পগুলি শেষ করার সময় এবং রোডম্যাপ-সহ দয়া করে প্রথম ধাপের তথ্য এক সপ্তাহের মধ্যে জমা দিন। আমি চাই, ব্যক্তিগত স্তরে প্রকল্পগুলির বিস্তারিত পুনর্মূল্যায়ন করে ওই তথ্য দিন’। মহাকরণ সূত্রের খবর, ৩০ জুন পর্যন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পরেই থামতে চান না মুখ্যমন্ত্রী। নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রকল্পের অগ্রগতি জানতে প্রতি তিন মাস অন্তর সব মন্ত্রীকে এমনই রিপোর্ট দিয়ে যেতে হবে। |