বন্য জীবনে পর্যটকদের অবাধ প্রবেশ রুখতে কড়া পদক্ষেপ করল সুপ্রিম কোর্ট। দেশের সমস্ত ব্যাঘ্র প্রকল্পের ‘কোর’ অঞ্চলে সব রকমের পর্যটন বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন শীর্ষ আদালতের বিচারপতিরা। পর্যটনের নামে বাঘের ডেরায় বেআইনি ভাবে হোটেল, রিসর্ট নির্মাণ হচ্ছে, সম্প্রতি এই মর্মে একটি জনস্বার্থ মামলা হয়। সেই মামলার শুনানিতেই আজ এই নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালতের বেঞ্চ। নির্দেশটি দ্রুত কার্যকর করতে বলে বিচারপতিরা জানিয়েছেন, মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পর্যটন বন্ধ রাখতে হবে।
একই সঙ্গে, ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পে ‘কোর’ অঞ্চল-এর পাশে ‘বাফার এলাকা’ চিহ্নিত না করলে বিভিন্ন রাজ্যের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা শুরু করা হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। কারণ তিন মাস আগে ওই দুই এলাকা চিহ্নিত করে বিজ্ঞপ্তি জারির নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও রাজস্থান ছাড়া অন্য কোনও রাজ্য তা পালন করেনি।
সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশকে স্বাগত জানিয়েছেন পরিবেশমন্ত্রী জয়ন্তী নটরাজন। তাঁর দাবি, ব্যাঘ্র প্রকল্পের ‘কোর’ অঞ্চলে পর্যটন বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্রও। এই বিষয়ে তিনি সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লিখবেন বলেও জানান জয়ন্তী। প্রসঙ্গত, বাঘ বাঁচাতে বছর পাঁচেক আগেই ব্যাঘ্র সংরক্ষণ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় আইন সংশোধন করা হয়। তার পরে ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি (এনটিসিএ)-এর সুপারিশ মেনে প্রকল্পের ‘বাফার’ এলাকা চিহ্নিত করে ‘কোর’ অঞ্চলটিকে ‘ক্রিটিক্যাল টাইগার হ্যাবিট্যাট’ ঘোষণার জন্য সমস্ত ব্যাঘ্র প্রকল্প ও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয় বন মন্ত্রক। শীর্ষ আদালতের এ দিনের নির্দেশ ওই সংশোধনীকেই আরও পূর্ণতা দিল বলে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে যুক্ত বিজ্ঞানী ও কর্তাদের মত।
বাঘের অবাধ বিচরণের জন্য ব্যাঘ্র প্রকল্পের যে অংশ নির্দিষ্ট করা হয় তাকেই বলে ‘কোর’ অঞ্চল। অনেক ক্ষেত্রে অরণ্যবাসীদেরও সেই অঞ্চলেই বাস। কিন্তু সংশোধিত আইন বলছে, বাঘ বাঁচাতে এবং তাদের জীবন নিরুপদ্রব করতে হলে ‘কোর’ এলাকায় মানুষের আনাগোনা সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করতে হবে। কোনও গ্রাম বা জনপদ থাকবে না। ওই ‘কোর’ অঞ্চল ঘিরেই তৈরি করতে হবে ‘বাফার’ এলাকা, যাতে বাঘ কোনও ভাবে ছিটকে বেরিয়ে এলেও জঙ্গলের বাইরে না যায়। স্থানীয় তফসিলি জাতি-উপজাতি বা অরণ্যবাসীরা ওই ‘বাফার’ এলাকায় থাকতে পারবেন। কিন্তু এই নিয়মের তোয়াক্কা না করে ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের গা ঘেঁষেই হোটেল, রিসর্ট ও অন্য পর্যটন প্রকল্প গড়া হচ্ছে বলে শীর্ষ আদালতে মামলা করেন সংরক্ষণ আন্দোলনের কর্মী অজয় দুবে।
ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই ৪ এপ্রিল ন’টি রাজ্যকে ‘কোর’ অঞ্চল ও ‘বাফার এলাকা’ চিহ্নিত করে বিজ্ঞপ্তি জারি করার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। সেই নির্দেশ মেনে বিজ্ঞপ্তি জারির কথা জানিয়েছে একমাত্র রাজস্থান। ফলে, রীতিমতো ক্ষুব্ধ কোর্ট। বিচারপতি স্বতন্ত্র কুমার ও বিচারপতি ইব্রাহিম কলিফুল্লার বেঞ্চ জানিয়েছে, নির্দেশ না মানলে রাজ্যগুলির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হবে। ইতিমধ্যেই অন্ধ্রপ্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, তামিলনাড়ু, বিহার, মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ‘কোর’ অঞ্চল ও ‘বাফার এলাকা’ চিহ্নিত না করলে প্রতি রাজ্যকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে বলে জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
দেশে ৪১টি ব্যাঘ্র প্রকল্প রয়েছে। সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, সেখানে বাঘের সংখ্যা ১৭০০। যদিও উপদ্রুত ও দুর্গম হওয়ায় কিছু ব্যাঘ্র প্রকল্প এখনও সুমারির আওতায় আসেনি। তার সঙ্গেই রয়েছে চোরাশিকারির দৌরাত্ম্য। এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে স্বাগত জানিয়ে এনটিসিএ-র সদস্য সচিব রাজেশ গোপাল বলছেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলছি বিভিন্ন ব্যাঘ্র প্রকল্পে পর্যটকদের গতিবিধি বাঘের ব্যক্তিগত জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।” ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার বিজ্ঞানী ওয়াই ভি ঝালার কথায়, “এখন পর্যটন হয় ওই ক্রিটিক্যাল টাইগার হ্যাবিট্যাট-এরই একটি ছোট অংশে। তা বন্ধ হলে বাঘেদের মঙ্গলই হবে।”
এ রাজ্যের প্রধান মুখ্য বনপাল অতনু রাহা জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের কোনও ব্যাঘ্র প্রকল্পে ‘কোর’ অঞ্চলে পর্যটকদের যাওয়ার অনুমতি নেই। তাঁর কথায়, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আমাদের হাত আরও শক্ত হল।” |