হরিয়ানার মানেসরে মারুতি-সুজুকি কোম্পানির কারখানায় যে হিংসাত্মক হামলার ঘটনা ঘটিয়া গেল, যে ভাবে সেখানে মারমুখী শ্রমিকদের হাতে ম্যানেজমেন্টের বহুসংখ্যক সদস্য নির্মম ভাবে প্রহৃত হইলেন, এক জন এমনকী নিহতও হইলেন, তাহা এক কথায় ভয়ঙ্কর এবং উদ্বেগজনক। শ্রমিকরা হাতের কাছে যাহা পাইয়াছেন, তাহা দিয়াই ম্যানেজারদের উপর চড়াও হন। কোনও এক জন ম্যানেজারের আচরণ কিংবা উক্তিতে প্ররোচিত হইয়া এমন ঘটনা ঘটিয়াছে, ইহা বিশ্বাস করা কঠিন। তাৎক্ষণিক কোনও উস্কানি কিংবা আকস্মিক কোনও ক্ষোভও এত বড় ঘটনা ঘটাইত না, যদি না শ্রমিকদের সহিত ম্যানেজমেন্টের সম্পর্ক আগে হইতেই বিদ্বেষ, ঘৃণা ও উত্তেজনায় ভরপুর থাকিত। ইহা দুর্ভাগ্যজনক, কেননা মানেসরের কারখানায় গত বছরেও দফায় দফায় যে শ্রমিক-অসন্তোষ ঘটিয়াছে, তাহা মাথায় রাখিয়া কারখানা পরিচালকদের আগাম সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত ছিল।
এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, মানেসরে যে আক্রমণ ও ম্যানেজার নিধনের ঘটনা ঘটিয়াছে, হামলাকারীরা তাহার দায় এড়াইতে পারিবে। অসন্তোষ কিংবা ক্ষোভের কারণ শ্রমিক-কর্মচারীদের নিশ্চয় থাকিতে পারে। কিন্তু তাহা নিরসনের পন্থা ম্যানেজার-হত্যা নয়। অভাব-অভিযোগ কর্তৃপক্ষ সমীপে পেশ করা, তাহার প্রতিবিধানের জন্য আলাপ-আলোচনা চালানো, সর্বোপরি একটা মীমাংসায় পৌঁছানো ইহার জন্যই ট্রেড ইউনিয়ন কারখানায় গড়িয়া ওঠে। ইউনিয়ন নেতৃত্বের দায়িত্ব থাকে শ্রমিক অসন্তোষকে গণতান্ত্রিক পরিসর অতিক্রম করিতে না দেওয়া এবং শান্তিপূর্ণ রাখা। মানেসরে সমস্যাটির মূলে কী ছিল, স্থায়ী শ্রমিক বনাম অস্থায়ী শ্রমিকদের বেতন-কাঠামো ও অন্যান্য প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত বিরোধ সমস্যাটিকে জটিল করিয়া তুলিয়াছিল কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। আসল কথা, ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব তাঁহাদের দায়িত্ব পালন করেন নাই। শুনা যাইতেছে, কারখানার বাহিরের, কারখানার সহিত যুক্ত নয়, এমন দুর্বৃত্তরাও কারখানা চত্বরে প্রবেশ করিয়াছিল এবং ম্যানেজারদের নিগ্রহে তাহারাও হাত লাগায়। কোনও কোনও রিপোর্টে এমনকী মাওবাদী জঙ্গিদের ট্রেড ইউনিয়নে অনুপ্রবেশের ইঙ্গিতও করা হইয়াছে। বাস্তবে তেমন কিছু সত্যই ঘটিয়া থাকিলে, তাহার দায়ও কিন্তু ইউনিয়ন নেতৃত্বের উপর বর্তায়। দায়িত্বজ্ঞানহীন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন দীর্ঘ কাল ধরিয়া এ দেশের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উজ্জীবনের গতি রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। জঙ্গি ইউনিয়নের হঠকারী তাণ্ডবকে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলিয়া চালানো যায় না। মানেসরে শতাধিক শ্রমিক ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হইয়াছেন। তাঁহাদের একটা বড় অংশ ছাঁটাই হইলে তাহার দায় ম্যানেজমেন্টের উপর বর্তাইবে না।
ম্যানেজমেন্ট যে শ্রমিক-অসন্তোষের আগাম আঁচ পায় নাই, সে কথা আগেই বলা হইয়াছে। ইহা খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে, মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের এ হেন অবনতি ম্যানেজারদের সম্পূর্ণ অগোচরেই ঘটিয়া গিয়াছে। ম্যানেজারদের প্রতি যে পরিমাণ বিরূপতা, বিদ্বেষ, এমনকী ঘৃণা জমা হইলে আক্রমণের চেহারা এত নিষ্ঠুর হয় এবং তাহাতে এত অধিকসংখ্যক শ্রমিক সক্রিয় ভাবে যোগ দিতে পারে, তাহার কোনও পূর্বাভাসই ম্যানেজাররা পান নাই? যদি পাইয়া থাকেন, তবে সময় থাকিতে ব্যবস্থা লন নাই কেন? নিজেরা অপারগ হইলে সরকারকেই বা জানান নাই কেন? হরিয়ানা সরকারেরও দায়িত্ব আছে রাজ্যে আইনের শাসন বলবৎ রাখার পাশাপাশি কারখানা চত্বরের আশেপাশেও নিরাপত্তা বলয় নিশ্ছিদ্র করা। মারুতি সুজুকি ভারতের একটি সফল শিল্পোদ্যোগ। এই সংস্থা দেশের বৃহত্তম মোটরগাড়ি নির্মাতা। দেশি-বিদেশি যৌথ অংশীদারির অন্যতম সফল উদ্যোগও এই সংস্থা। ইহার সুষ্ঠু অগ্রগতির উপর দেশে বিদেশি বিনিয়োগ ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি হস্তান্তরের ভবিষ্যৎও বহুলাংশে নির্ভরশীল। হরিয়ানা সরকার যদি সংস্থার নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে না পারে, তবে রাজ্যের শিল্প-ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হইয়া পড়িবে। |