কলকাতা পুর-এলাকায় কতগুলি পুকুর বা জলাশয় আছে, আদালতকে তা জানাতে পারলেন না পুর-কর্তৃপক্ষ। কলকাতার পুকুর ও জলাশয়ের অবস্থা নিয়ে পুরসভার পক্ষ থেকে সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টে যে রিপোর্ট হলফনামা আকারে পেশ করা হয়েছে, তাতেই এই স্বীকারোক্তি মিলেছে। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, পুর-এলাকার পুকুরের যে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে, তা নানা কারণে চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না। পুকুরগুলি সরেজমিন দেখে তালিকাটি সংশোধন এবং পরিবর্তনের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে। পুকুরের তালিকায় পুরসভা কোনও রকম ভুল রাখতে চায় না বলেও জানানো হয়েছে ওই হলফনামায়।
হলফনামায় পুরসভা কবুল করেছে, কলকাতা পুর-এলাকায় গত কয়েক বছরে বহু পুকুর এবং জলাশয় ভরাট হয়ে গিয়েছে। এখনও মাঝেমধ্যেই জলাশয় এবং পুকুর ভরাটের ঘটনা ঘটছে। ফলে, পুকুরের তালিকা কোনও ভাবেই চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না। রিপোর্টে বলা হয়েছে, এটা সত্যি যে, বাড়ি এবং আবাসন তৈরির জন্য বহু পুকুর ও জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। সেই জলাশয়গুলি পুনরুদ্ধারের জন্য সম্ভবত কোনও ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। পুকুর বা জলাশয় ভরাট বন্ধ করার জন্য হয় কোনও আইন ছিল না, বা আইন কঠোর ভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। তবে এখন জলাশয় সংরক্ষণ ও বাঁচিয়ে রাখাটা নাগরিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
ওই রিপোর্টে কলকাতায় ২৬৬টি পুকুরের হিসেব পাওয়া যাচ্ছে। ৪২টি পুকুর সংস্কার করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আটটি পুকুরে সংস্কারের কাজ চলছে। ২৫টি পুকুর নিয়ে মামলা আদালতে ঝুলে থাকায় সেখানে সংস্কার বা সংরক্ষণের কাজে হাত দিতে পারছে না পুরসভা। আরও ১৮১টি পুকুরের পাড় এবং জলের কচুরিপানা ১০০ দিনের কাজের আওতায় সাফ করা হয়েছে।
পুকুর ভরাট নিয়ে আইনি এবং অন্যান্য জটিলতার সুরাহা করার ব্যাপারে পরামর্শ নেওয়ার জন্য হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি গীতেশরঞ্জন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ‘ওয়াটারবডি ম্যানেজমেন্ট বোর্ড’ গঠন করে পুরসভা। সেই বোর্ডের সদস্য ছিলেন দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তদানীন্তন চিফ ল’ অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়। পর্ষদ থেকে অবসর নেওয়ায় তিনি আর ওই বোর্ডেও নেই। বিশ্বজিৎবাবু বললেন, “যে পুকুরগুলি ইতিমধ্যে ভরাট করা হয়ে গিয়েছে, সেখানে জমির চরিত্র বদলে আইনি অনুমোদনের জন্যই বোর্ডকে কার্যত ব্যবহার করা হয়।”
ইতিমধ্যে বোর্ডে মৎস্য দফতরের প্রতিনিধি জানিয়ে দিয়েছেন, জলা বা পুকুর ভরাট নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলবে কেবল মৎস্য দফতর। এই ধরনের কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার পুরসভার নেই। কারণ, মৎস্য দফতরের আইনেই জলা ভরাট সংক্রান্ত বিবাদের মীমাংসা হয়। মৎস্য দফতরের প্রতিনিধি এই প্রশ্ন তোলার পর থেকে বোর্ডের কাজকর্ম মোটামুটি বন্ধই রয়েছে। কিন্তু পুকুর ভরাটের ঘটনা বেড়েই চলেছে।
বোর্ডের সদস্য এবং নদী ও ভূ-জল বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র জানান, ১৮৫ বর্গকিলোমিটারের শহরে ৫১ লক্ষেরও বেশি মানুষের বাস। কলকাতার বাসিন্দাদের প্রতিদিন মাথাপিছু জল লাগে ২২৫ লিটার। সেই চাহিদার পুরোটা জোগান দিতে পারে না পলতা বা গার্ডেনরিচের জল। যে জলের অন্তত ৩৫ শতাংশ নষ্ট হয় সরবরাহ করতে গিয়ে। তার ফলে জলের ঘাটতি মেটাতে হয় মাটির নীচ থেকে বিপুল পরিমাণ জল তুলে। কল্যাণবাবুর কথায়, “মাটির নীচ থেকে যথেচ্ছ জল তুলে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টির জল মাটির নীচে ঢুকতে পারছে না। ফলে ভূগর্ভস্থ জলস্তর তলানিতে ঠেকেছে। কেবল বি-বা-দী বাগ অঞ্চলে মাটির নীচের জলস্তর ৪৫ ফুট নেমে গিয়েছে। ফলে শহরের পুকুরগুলিতে বছরের বেশির ভাগ সময়ে জল থাকছে না।”
পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত জানান, কলকাতা যতই কংক্রিটে ঢেকে যাচ্ছে, বৃষ্টির জল মাটির নীচে ঢোকার স্বাভাবিক পথগুলো যাচ্ছে বন্ধ হয়ে। কারণ শহরে যে ক’টি পুকুর আছে, তা-ও প্রতিদিনই চোরাগোপ্তা বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে। আর পুকুর শুকিয়ে যাওয়ায় নানা রকমের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এই বিপুল জনসংখ্যার শহরে কোথাও আগুন লাগলে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে যেটুকু জলের প্রয়োজন, তা-ও মেলে না অনেক ক্ষেত্রেই। সুভাষবাবুর আশঙ্কা, এ ভাবে বেহিসেবি জল তোলা চলতে থাকলে আগামী দিনে মাটির নীচের জলস্তর এতটাই নীচে নেমে যাবে যে, সেই জলও আর তোলা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া, এ ভাবে জলস্তর নামতে থাকলে কলকাতা শহরটাই ধীরে ধীরে বসে যেতে থাকবে। |