কলকাতায় ম্যালেরিয়ার কোনও ভয় নেই, এই ঘোষণা করার সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) পর্যটন গাইডের উল্লেখ করেছিলেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু শহরে আর্সেনিক দূষণের প্রশ্নে সেই হু-র নির্দেশিকাকেই বেমালুম উড়িয়ে দিলেন তিনি।
হু-র নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, আর্সেনিকের সহনমাত্রা প্রতি লিটার জলে ০.০১ মিলিগ্রাম। বিশেষ করে, আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় কোনও মতেই এর নড়চড় হওয়া উচিত নয়। কিন্তু সোমবার মেয়র বলেন, “ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড এ দেশে আর্সেনিকের সহনমাত্রা প্রতি লিটারে ০.০৫ মিলিগ্রাম বেঁধে দিয়েছে। আমরা সেটাই মেনে চলছি।” মেয়রের দাবি, কলকাতায় কোথাও অনুমোদিত সীমার বেশি আর্সেনিক নেই।
আর্সেনিকের সহনমাত্রা নিয়ে মেয়রের সঙ্গে পুরোপুরি সহমত নন রাজ্যের আর্সেনিক টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান কুমারজ্যোতি নাথও। তাঁর কথায়, “ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডও সাধারণ ক্ষেত্রে আর্সেনিকের সহনমাত্রা প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম বেঁধে দিয়েছে। যেখানে পানীয় জলের বিকল্প উৎস নেই, সেখানেই শুধু সহনমাত্রা নামিয়ে প্রতি লিটারে ০.০৫ মিলিগ্রাম করা হয়েছে।” কিন্তু কলকাতা এই বিশেষ ক্ষেত্রে পড়ে না বলে জানাচ্ছেন আর্সেনিক বিশেষজ্ঞেরা। রাজ্যে জলের গুণমান দেখার দায়িত্ব রাজ্য জল অনুসন্ধান দফতরের (সুইড)। সুইডের অধিকর্তা সুরজিৎ দাস জানান, তাঁরা হু-র নির্দেশিকা মেনেই জল পরীক্ষা করেন। তার ভিত্তিতেই কোন কোন ওয়ার্ড আর্সেনিকপ্রবণ, তা পরীক্ষা করে পুরসভায় রিপোর্ট দিয়েছে সুইড।
কিন্তু মেয়র বলেন, “সুইড যে ক’টি নলকূপের কথা বলেছে, তার কোনওটিই কলকাতা পুরসভার মধ্যে নেই। তবু আমরা নতুন করে ১৩টি জায়গা থেকে জলের নমুনা নিয়েছি। সেগুলি সুইড, জনস্বাস্থ্য ইঞ্জিনিয়ারিং দফতর, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পুরসভার নিজস্ব পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে পুরসভা পরবর্তী পদক্ষেপ করবে।”
কলকাতা, রাজপুর-সোনারপুর, রাজারহাট, দক্ষিণ দমদম, বরাহনগর ও কামারহাটি পুরসভা এলাকার বিভিন্ন নলকূপ থেকে মোট ৯৬টি জলের নমুনা সংগ্রহ করেছিল সুইড। তার মধ্যে ৩৭টি নমুনায় আর্সেনিক মিলেছে। সুইডের এক ইঞ্জিনিয়ার জানাচ্ছেন, কুঁদঘাটের একটি নলকূপে প্রতি লিটার জলে ০.৫৫ মিলিগ্রাম এবং বিবেকানন্দ রোডের একটি নলকূপে প্রতি লিটারে ০.৪৯ মিলিগ্রাম আর্সেনিক মিলেছে। দরগা রোডের একটি নলকূপে আর্সেনিকের মাত্রা প্রতি লিটারে ০.৪৭ মিলিগ্রাম। ওই ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, “এর পরেও যদি কেউ কলকাতায় নলকূপের জলে আর্সেনিকের উপস্থিতি অস্বীকার করতে চান, তা হলে আর জলের গুণাগুণ পরীক্ষা করে কী লাভ? আমরা পরীক্ষা করে আবার একই রিপোর্ট দেব। মেয়র ফের বাতিলের ঝুড়িতে ফেলবেন।”
এ ছাড়া, কলকাতার লাগোয়া রাজপুর-সোনারপুরে দু’টি, বরাহনগরে একটি, দক্ষিণ দমদমে তিনটি ও রাজারহাটে তিনটি ওয়ার্ডে সহনমাত্রার বেশি আর্সেনিক পেয়েছে সুইড।
যে সব নলকূপের জলে সহনমাত্রার বেশি আর্সেনিক মিলেছে, সেগুলি কি পুরসভা বন্ধ করে দেবে? মেয়র জানান, যত দিন না মানুষ প্রয়োজনীয় জল পাচ্ছেন, তত দিন সেগুলি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে কোথাও আর্সেনিকের মাত্রা সহনসীমার বেশি হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেই হবে।
মেয়র ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের বিপজ্জনক উপস্থিতি না মানলেও মেয়র পারিষদ (নলকূপ) তারক সিংহ এ দিন বলেন, “আমরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রযুক্তির সাহায্যে কলকাতার সব এলাকা আর্সেনিকমুক্ত করা সম্ভব। প্রয়োজনে সেই ব্যবস্থা নেবে পুরসভা। শহরের মানুষকে আর্সেনিক পান করিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না আমরা।”
অন্য দিকে, কলকাতার ৭০ ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কিছু অংশে দুর্গন্ধময় ও কালো পানীয় জল সরবরাহ হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সোমবার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় জানান, অভিযোগ পেয়ে জলের নমুনা সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে এবং ওই দুই এলাকায় ভাল পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মেয়র বলেন, “মনে হচ্ছে, এলগিন রোডে ভারী গাড়ি যাওয়ার ফলে কোথাও পানীয় জলের পাইপ ফেটে গিয়ে নোংরা জল ঢুকে পড়ছে। তাই ওই অবস্থা।” |