ফের বিয়ের পিঁড়িতে নাবালিকা। এবং খবর পেয়ে ছাদনাতলায় গিয়ে সে বিয়ে রুখল জেলা প্রশাসন।
পাত্রীর মা অবশ্য কেঁদে ভাসালেন, ফুঁপিয়ে কাঁদল পাত্রীও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থানার বড়বাবুর কড়া ধমক এবং ধৈর্য্যের কাছে হার মানলেন মেয়ের বাবা। কাচুমাচু মুখে জানালেন “আসলে লোভে পড়ে গিয়েছিলাম!’’ কেন? “এমন বিনা যৌতুকে পাত্র পাব তো ভাবিনি তাই...”
আর তাই, শুক্রবার দুপুরে কৃষ্ণনগরের বসাকপাড়ার মনোরঞ্জন কর্মকার তাঁর বছর ষোলোর মেয়ে অনিতার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলেন পাশের গ্রাম সেনপুরের উত্তম ঘোষের সঙ্গে। বয়সের ফারাক দেদার। রোজগারপাতিও তেমন নয়। কিন্তু ‘নিখরচায়’ বিয়ের প্রস্তাব ভ্যানচালক মনোরঞ্জনবাবুর কাছে ছিল হাতে সোনা পাওয়ার মতো। মেয়ে অনিতাও জানাচ্ছে, বাবা-মা’র মুখ চেয়ে বিয়েতে রাজিও হয়ে গিয়েছিল সে। তার ভয়, “বিয়ে তো ভেঙে গেল। এ বার বিয়ে না হলে!” পুলিশ মধ্য ত্রিশের উত্তমকে আটক করেছে। পেশায় সে রিকশাচালক। উত্তমের এটা দ্বিতীয় বিয়ে। বছরখানেক আগে প্রথম পক্ষের স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে, এমনই দাবি। হতাশ উত্তম বলেন, ‘‘বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছিলাম। মেয়েটিকে পছন্দ হওয়ায় রাজি হয়েছিলাম।” কিন্তু নাবালিকাকে বিয়ে করা আইন বিরুদ্ধ জানেন না? উত্তমের সটান উত্তর, “জানব না কেন, তবে আমাদের গ্রামে-গঞ্জে এ সব হয়।” সমস্যাটা এখানেই। মনে করছেন, সমাজ বিজ্ঞানী মণিকুন্তলা সেন। তিনি বলেন, “অভাব এবং অশিক্ষা মানুষকে এভাবেই পিছিয়ে রেখেছে। নাবালিকা মেয়েটিও বুঝতে পারছে না এ বিয়ে হলে তার কতটা ক্ষতি হত। এ সবই অজ্ঞতার কারণে। |
মেয়েটি যদি স্কুলে পড়ত তাহলে কিন্তু এত সহজে বিয়েতে রাজি হত কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।” পাশাপাশি তিনি জানান, ‘পাত্র’ জেনেবুঝেও বিয়েতে রাজি হয়েছিল। কারণ আইন মানার মতো সচেতনতাই তার তৈরি হয়নি। কারণ সেই অশিক্ষা। এবং, সমাজে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের এখনও এ কথাই বোঝানো হয় যে, বিয়েটাই ‘মোক্ষ’। তাই পাত্র ভাল না মন্দ, বিয়ের বয়স হয়েছে কী হয়নি তাই নিয়ে ভাবার অবকাশই পায় না তারা। এ ক্ষেত্রেও অনিতার ‘রোগ’টা সেখানেই লুকিয়ে বলে মন্তব্য মণিকুন্তলাদেবীর। এ দিন গ্রামেরই কোনও সূত্র থেকে পুলিশ জানতে পেরেছিল গ্রামে এক নাবালিকার বিয়ে হতে চলেছে। এসে গিয়েছে বরও। খবর পেয়েই ভাতজংলা এলাকায় ছুটে গিয়েছিলেন থানার আইসি সুনীল সিকদার। গিয়ে দেখেন টিনের চাল দেওয়া ঝুপড়ি বাড়ির সামনে এক চিলতে উঠোনে প্রস্তুতি প্রায় সারা। বেশ কয়েকজন অতিথিও হাজির। পুলিশ বাড়িতে পা রাখতেই উঠেছিল কান্নার রোল। সুনীলবাবু বলেন, “ওঁরা বুঝতে পেরেছিলেন আমরা খবর পেয়ে বিয়ে রুখতে এসেছি।” অনিতার মা সুষমাদেবী পুলিশ কর্তাদের পায়ে পড়ে কাকুতি মিনতি করতে থাকেন, ‘‘আমরা ভীষণ গরিব, এ পাত্রের কোন দাবিদাওয়া ছিল না। এই সুযোগটা নষ্ট করতে দেবেন না।’’ অনিতার বয়স সবে ১৩ বছর। অনাদিনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। তারপর ‘অভাবের’ জন্য দাঁড়ি পড়ে গিয়েছিল তার শিক্ষায়। বাড়ির চৌহদ্দিতেই দিন কাটত তার। কৃষ্ণনগর (সদর) মহকুমাশাসক পূর্ণেন্দু মাজী বলেন, ‘‘মেয়েটি যাতে আবার পড়তে পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।’ কিন্তু আদৌ বাড়ির লোক কী তাকে পড়াতে রাজি হবে? সরকারি তথ্যই বলছে, অনেক সময়েই দেখা গিয়েছে পুলিশ বা প্রশান নাবালিকা বিয়ে রুখলেও দিন কয়েকের মধ্যেই সে বিয়ে হয়ে গিয়েছে চুপিসারে। এ বারও তা হবে নাতো? |