অলিম্পিকস চলকালীন বেশ কিছু বিশ্বরেকর্ড ভাঙা-গড়ার সংবাদ পাওয়া যাইবে, স্বাভাবিক। কিন্তু, তাহার পূর্বেই কলিকাতা একটি বিশ্বরেকর্ড গড়িল। উদ্বোধনের পর সর্বাপেক্ষা কম সময়ে একটি রাস্তার ‘রাস্তা’ নামে পরিচিত হইবার অধিকার হারাইবার রেকর্ড। কলিকাতার পাতিপুকুর অঞ্চলে যশোহর রোডের উপর প্রবল যানজট হইত বলিয়া ২০০১ সালে একটি আন্ডারপাস তৈরির পরিকল্পনা হয়, তাহার শিলান্যাসও হয়। শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালের জুন মাসে সেই রাস্তাটি জনগণের ব্যবহারার্থে খুলিয়া দেওয়া হয়। তাহার পর মাত্র ১১ দিন অতিক্রান্ত হইয়াছে এবং এক ঘণ্টা বৃষ্টি পড়িয়াছে। তাহাতে রাস্তার পিচের ম্যাসটিক অ্যাসফল্ট প্রায় সম্পূর্ণত ধুইয়া মুছিয়া সাফ হইয়া গিয়াছে। আন্ডারপাসটির এখন যে অবস্থা, তাহাতে তাহাকে পাকা রাস্তা বলিতে বিস্তর কল্পনাশক্তির প্রয়োজন। জন্মিলে যেমন মৃত্যু ধ্রুব, তেমনই রাস্তা তৈরি হইলে তাহা অনতিভবিষ্যতেই খানাখন্দময় হইয়া উঠিবে, এই কথাটি পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলের মানুষ মানিয়া লইয়াছেন। গ্রামের লোককে মানিতে হয় নাই, কারণ সেখানে কালেভদ্রেও পাকা রাস্তা হয় না। কিন্তু, এই পশ্চিমবঙ্গেও মাত্র এগারো দিনে রাস্তার মৃত্যু রীতিমত অস্বাভাবিক বোধ হইতেছে। একটি সংবাদে রাজ্যবাসী কিঞ্চিৎ আমোদ পাইতে পারেন আন্ডারপাসের উদ্বোধন উপলক্ষে রাজ্যের বর্তমান ও প্রাক্তন পুরমন্ত্রীর একটি তরজা হইয়াছিল। উভয়েই এই আন্ডারপাসের কৃতিত্বের সিংহভাগ দাবি করিয়াছিলেন। রাস্তাটির অপমৃত্যুর পর অপর পক্ষের স্কন্ধে দায় চাপাইবার চেষ্টা চলিতেছে। গৌরবের অনেক জনক, কিন্তু কলঙ্ক চিরকালই অনাথ।
অপরাধ অনাথ নহে। কেহ না কেহ এই মৃত্যুর জন্য দায়ী। কিন্তু, দায়ী কে, পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা তাহা বুঝিবার উপায় রাখে নাই। কথাটি কেবল পাতিপুকুর আন্ডারপাসের জন্য নহে, রাজ্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমান সত্য। যে কোনও প্রকল্পেই এক জন বা কয়েক জনের একটি গোষ্ঠী শীর্ষ দায়িত্বে থাকিবেন, তাহা বিধেয়। প্রকল্পে কোনও সমস্যা সৃষ্টি হইলে, বা বর্তমান উদাহরণটির ন্যায় ঘটনা ঘটিলে তাঁহারা দায়বদ্ধ থাকিবেন। তাঁহাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হইবে। এই সামান্য ব্যবস্থাটি যথাবিধি চালু রাখা গেলেই সরকারি কাজে অকুশলতা বহুলাংশে দূর করা সম্ভব। বস্তুত, কোনও প্রকল্পের সাফল্য-ব্যর্থতার দায় কাহার, এই কথাটি সাধারণেরও জানিবার অধিকার রহিয়াছে। পাতিপুকুরের রাস্তাটি নির্মাণ করিতে যে ১৯ কোটি টাকা ব্যয় হইয়াছে, প্রকৃত প্রস্তাবে তাহা জনগণেরই অর্থ। কেন এই স্বচ্ছতা থাকে না, তাহার কারণ অবশ্য অনুমানের অতীত নহে। প্রকল্পের খরচ বাবদ যে অর্থ বরাদ্দ হয়, তাহার কত শতাংশ প্রকল্প পর্যন্ত পৌঁছায়, আর কতখানি মাঝপথেই হাতবদল হইয়া যায়, সে বিষয়ে রাজ্যবাসীর কিঞ্চিৎ ধারণা আছে। দুর্জনে বলিবে, সেই বাঁটোয়ারায় পার্টির তহবিলও বাদ পড়ে না। বিলিব্যবস্থা হইবার পরে যাহা পড়িয়া থাকে, তাহাতে সম্ভবত চিরস্থায়ী রাস্তা নির্মাণ সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় কোনও এক জনকে দস্যু রত্মাকরের ভূমিকায় খাড়া করিবার বিপদ আছে তাহাতে আরও অনেক নাম জড়াইয়া যাইবে। তাহার অপেক্ষা অস্বচ্ছতাই শ্রেয়। এই ব্যবস্থাটি ভাঙা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের অর্থের এই অপব্যয়ের জন্য যাঁহারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দায়ী, তাঁহাদের প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। শাস্তিবিধানের দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রীর। ঠগ বাছিতে যদি পার্টি অফিস উজাড় হইয়া যায়, তবুও এই কর্তব্য সাধনে পিছপা হইলে চলিবে না। তাহাই রাজধর্মের প্রাথমিক শর্ত। |