অবশেষে ছাত্রী-নির্যাতন কাণ্ডে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ দুঃখপ্রকাশ করিয়াছেন। এই দুঃখপ্রকাশ বিলম্বিত এবং ইহা যথেষ্ট নয়। কর্তৃপক্ষের আচরণে স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে যে, গণমাধ্যমে কেলেঙ্কারির বিষয়টি ফাঁস হইয়া যাওয়ায় এবং আচার্য প্রধানমন্ত্রীর দফতর অবধি তাহার বার্তা রটিয়া যাওয়ায় একপ্রকার বাধ্য হইয়াই এবং প্রবল চাপে পড়িয়াই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এই দুঃখপ্রকাশ করিয়াছেন। ইহা স্বতঃপ্রণোদিত নয়, অতএব আন্তরিক সদিচ্ছাপ্রসূতও নয়। ইহা দুর্ভাগ্যজনক এবং ঘোরতর নিন্দনীয়। ইহা দ্বিগুণ দুর্ভাগ্যজনক এই জন্য যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী তাহার এক পঞ্চম শ্রেণিতে পাঠরতা আবাসিক ছাত্রীর সহিত এমন অসংবেদী, নিষ্ঠুর, অমানবিক আচরণ করিতে পারিল। কর্তৃপক্ষের তরফে দ্বিগুণ ধিক্কার প্রাপ্য এই কারণে যে, তাঁহারা আচার্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো প্রাথমিক রিপোর্টে ছাত্রী-নিবাসের ওয়ার্ডেন-এর নিষ্ঠুর আচরণের অনুকূলে সাফাই গাহিয়াছিলেন এবং নিগৃহীত ছাত্রী বা তাহার মা-বাবার বক্তব্য জানিবার কোনও চেষ্টা না করিয়াই আচার্য সমীপে রিপোর্ট পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।
ছাত্রী-নিবাসের ওয়ার্ডেন এবং তাঁহার অবস্থান সমর্থনকারী বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের অপযুক্তি ছিল, ছাত্রীটির বিছানা ভিজাইয়া ফেলার অসুখের দাওয়াই হিসাবে তাহাকে নিজের প্রস্রাব খাইতে বাধ্য করার পরামর্শটি নাকি ছাত্রীর মায়েরই দেওয়া। বলা নিষ্প্রয়োজন, ছাত্রীর মা এই ‘যুক্তি’কে ‘বানানো গল্প’ আখ্যা দিয়াছেন। এ ভাবে যে কোনও অসুখ সারিতে পারে না, উপরন্তু এ ধরনের ‘বন্দোবস্ত’কে যে অসুস্থ ছাত্রীটি তাহার কৃতকর্মের কঠোর শাস্তি বলিয়াই গণ্য করিতে পারে, যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরই সে কথা মনে হওয়া উচিত। ছাত্রী-নিবাসের ওয়ার্ডেন তথা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কেন তাহা মনে হয় নাই, সেটা রহস্যময়। দ্বিতীয়ত, যদি তর্কের খাতিরে ধরিয়া লওয়া যায় যে, ছাত্রীর মা-ই এই টোটকা দাওয়াই বাতলাইয়াছিলেন, তাহা হইলেও একবিংশ শতাব্দীতে একটি আধুনিক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কি অসুখ সারাইতে এ হেন গ্রাম্য, অবৈজ্ঞানিক টোটকা প্রয়োগ করা যায়? যাঁহারা মনে করেন যায়, তাঁহারা আর যাহাই হউক, কোনও ছাত্রী-নিবাসের ওয়ার্ডেন থাকার কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালাইবার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি নহেন। তাঁহাদের অবিলম্বে বিদায় করা দরকার।
বিশ্বভারতী হ্যামলেট-এর ডেনমার্ক রাজ্যের মতো ভিতরে-ভিতরে পচিয়া গিয়াছে কি না, জানা নাই। তবে যে ওয়ার্ডেন পঞ্চম শ্রেণির বালিকাকে নিজের প্রস্রাব চাটিয়া খাইতে বাধ্য করেন, তাঁহার ওই শ্লাঘনীয় কীর্তির সমর্থনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক স্থানে পোস্টার পড়িয়াছে। শুধু তাহাই নহে, পাঠভবনের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী বলিয়া নিজেদের দাবি করা কিছু ছেলেমেয়ে সন্ধ্যায় ওয়ার্ডেনের ওই ন্যক্কারজনক অপকর্মের সমর্থনে বিশ্বভারতী চত্বরে মৌনী মিছিলও বাহির করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহান ঐতিহ্য ও উচ্চ আদর্শবাদের সার্থক উত্তরাধিকারী বটে। বস্তুত, এই ঘটনা দেখাইয়া দিতেছে, একটি সর্বজনীন নিন্দার বিষয়ও বিশ্বভারতীর ছাত্রসমাজ ও পরিচালন কর্তৃপক্ষকে বিভাজিত করিয়া দিতে পারে। ধিক্কারজনক অপকর্মের সমর্থনে দাঁড়াইবার, পোস্টার লিখিবার, এমনকী শোভাযাত্রা বাহির করিবার মানসিকতার পিছনে যে সম্ভবত দলীয় রাজনীতির কায়েমি স্বার্থের ক্রিয়া আছে, তাহা অনুমান করা অবশ্য কঠিন নয়। এমন প্রতিষ্ঠান সুকুমারমতি বালক-বালিকাদের অধ্যয়নের উপযুক্ত পরিবেশ দিতে পারিবে, এমত বোধ হয় না। |