গঙ্গাতীরের সৌন্দর্যায়ন মানেই কি ওই নদীকে দূষণমুক্ত করা? গঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতীয় গঙ্গা অববাহিকা কর্তৃপক্ষের (ন্যাশনাল গঙ্গা রিভার বেসিন অথরিটি) দেওয়া টাকা রাজ্যের সংশ্লিষ্ট পুরসভাগুলি মূলত গঙ্গাপাড়ের সৌন্দর্যায়নের কাজে ব্যয় করায় এই প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞেরা।
এ রাজ্যে গঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় গঙ্গা অববাহিকা কর্তৃপক্ষ গত আর্থিক বছরে ২৫৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। গঙ্গার দু’পাশে কল্যাণী থেকে বজবজ পর্যন্ত ২৯টি শহরে ওই টাকা খরচ করার কথা। কিন্তু ভাটপাড়া, গয়েশপুর ও কল্যাণীতে নিকাশি বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা তৈরির প্রকল্প বাদ দিলে গঙ্গা-দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বরাদ্দ প্রায় পুরো টাকাটাই খরচ করা হচ্ছে নদীর পাড়ের উন্নয়নে। তার মানে কি শুধুই পুরনো কিছু ঘাটের সংস্কার আর গঙ্গাপাড়ের সৌন্দর্যায়ন? এ প্রশ্ন তুলেছেন নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র। তাঁর মতে, জাতীয় গঙ্গা অববাহিকা কর্তৃপক্ষের মূল লক্ষ্য, গঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু গঙ্গার পাড় সাজিয়ে তো সেই লক্ষ্য পূরণ হবে না। তাঁর কথায়, “গঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণে মূল কাজ তিনটি।
১) শহরের যে সব নিকাশি নর্দমা গঙ্গায় পড়ছে, সেগুলির মুখ বন্ধ করা।
২) নর্দমার মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া এবং
৩) নর্দমা-বাহিত তরল বর্জ্য পরিশোধন করে তাতে মাছ চাষ করা বা অন্য কাজে ব্যবহার করা। এর কোনওটা না-করে কেবল গঙ্গার পাড় সাজানো হচ্ছে।” |
প্রতিদিন এ ভাবেই আরও দূষিত হচ্ছে গঙ্গার জল। —ফাইল চিত্র |
অথচ, কল্যাণী থেকে বজবজ পর্যন্ত বিভিন্ন পুরসভা ও কারখানার অন্তত ৩০০টি নিকাশি নর্দমা গঙ্গায় পড়েছে। কলকাতার আদিগঙ্গা এবং হাওড়ার নাজিরগঞ্জ খাল থেকে সব চেয়ে বেশি পরিমাণ নিকাশি বর্জ্য গঙ্গায় গিয়ে পড়ে। কেবল আদিগঙ্গা দিয়েই প্রতিদিন ২৬ কোটি লিটার নিকাশি বর্জ্য গঙ্গায় পড়ছে। দূষণের আরও একটি উৎস বালি খাল।
কেন্দ্রের পরিবেশ ও বন মন্ত্রক নদীর জলের নিরাপদ-মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, প্রতি ১০০ মিলিলিটার জলে ‘কলিফর্ম’ থাকতে পারে ৫০০ পর্যন্ত। তার বেশি থাকলে সেই জল স্নানেরও অযোগ্য। কলিফর্ম এক ধরনের মারাত্মক ব্যাক্টেরিয়া। ২০০৩ সালে ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (নিরি)-এর সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছিল, গঙ্গার জলে কলিফর্ম আছে ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার পর্যন্ত। গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান শুরু হওয়ার আড়াই দশক পরে গঙ্গার জল আরও দূষিত হয়েছে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের গত এপ্রিলের রিপোর্টে বলা হয়েছে, দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গার জলে কলিফর্ম রয়েছে ৮ লক্ষ ৫০ হাজার আর গার্ডেনরিচে তার পরিমাণ ৪ লক্ষ।
নদীর পাড় সাজানোতেই যে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তা স্বীকার করে নিয়ে পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের প্রধান সচিব দেবাশিস সেন বলেন, “জাতীয় গঙ্গা অববাহিকা কর্তৃপক্ষের নির্দেশিকা মেনেই কাজ করছি। গঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণে ওরা চারটি বিষয়ের উপরে গুরুত্ব দিয়েছে।
১) নিকাশি গঙ্গায় না ফেলে তা পরিশোধন করা
২) কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
৩) নদীর পাড়ের উন্নয়ন এবং
৪) জন-সচেতনতা।
সুন্দর করে সাজালে মানুষ নদীর পাড় নোংরা করবে না এবং সচেতনতা বাড়বে।” তবে কলকাতার কয়েকটি খাল সংস্কার করা হবে জানিয়েছেন দেবাশিসবাবু।
গঙ্গার দূষণ রোধে ব্যবস্থা চেয়ে পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছেন। সেই মামলায় গত ১৫ বছরে অন্তত ৬০টি নির্দেশ দিয়েছে আদালত। একটি কমিটিও তৈরি করেছে। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। সুভাষবাবু বলেন, “পাড় সাজানোর সঙ্গে দূষণ নিয়ন্ত্রণের কোনও সম্পর্ক নেই। গঙ্গার জলের মান উন্নত করতে গেলে নিকাশি নালাগুলির মুখ বন্ধ করতে হবে। সেটাই গঙ্গার আসল ব্যাধি।” কল্যাণ রুদ্র বলেন, “গঙ্গার কী ব্যাধি, তা আমরা জানি। ওষুধও আমাদের জানা। কিন্তু সেই ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে না। ফলে ১৯৮৫ সালের পর থেকে দু’দফায় গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানের কাজের পরেও গঙ্গার দূষণ এতটুকু কমেনি।” |