প্রবন্ধ...
‘তাই সমস্যা, যা দেখিবে তুমি’
বেশ কয়েক বছর আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু লোককে বেছে নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল: দেশে দক্ষিণ প্রান্ত যে মাঝেমাঝেই সামুদ্রিক ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়, সেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ত্রাণে কত ডলার দিতে রাজি আছেন? আর এক দল লোকের কাছে জানতে চাওয়া হল: আফ্রিকায় যে শিশুরা চরম অপুষ্টিতে ভুগছে, তাদের খাদ্যের জন্য, চিকিৎসার জন্য কত ডলার দিতে পারবেন তাঁরা? দেখা গেল, আফ্রিকার শিশুদের খাবারের ব্যবস্থা করতে মানুষ যত ডলার দিতে রাজি, তার চেয়ে ঢের বেশি দিতে তৈরি লুইজিয়ানার ঝড়বিধ্বস্ত অঞ্চলের মানুষদের জন্য।
এক জন সাধারণ মার্কিন নাগরিকের কাছে সাব-সাহারান আফ্রিকার খেতে না পাওয়া, অসুখে ভোগা বাচ্চারা আসলে ভিন্ গ্রহের প্রাণী তাদের সমস্যাটা এত দূরের, এত অচেনা যে তার আঁচ লাগে না ওয়াশিংটন ডি সি বা নিউ ইয়র্কের কোনও নাগরিকের গায়ে। না খেতে পেয়ে তাঁর সন্তানের হাত পা কাঠির মতো সরু হয়ে যাবে আর পেটটা ফুলে থাকবে, এমন হওয়ার সম্ভাবনা এতই কম যে কোনও মার্কিন নাগরিক নিজেকে ওই জায়গায় বসিয়ে দেখতেই পারেন না। লুইজিয়ানায় যাঁরা থাকেন, ঝড়ে যাঁদের বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, তাঁরা কিন্তু চেনা মানুষ এবং, তার চেয়েও বড় কথা, সমস্যাটা চেনা। ওই মার্কিন নাগরিক জানেন, তাঁর শহরেও এক দিন বয়ে যেতে পারে ওই সামুদ্রিক ঘুর্ণিঝড়। এক দিন তাঁকেও এমন বিপর্যস্ত দেখাতে পারে। এই যে একটা সমস্যার মধ্যে নিজেকে বসিয়ে দেখতে পারা, আর একটা সমস্যায় না পারা এতেই ফারাক হয়ে যায় সাহায্যের ইচ্ছেয়। তাই, সমস্যা তীব্রতর এবং দীর্ঘমেয়াদি হলেও আফ্রিকার বাচ্চাদের জন্য ত্রাণ ঢের কম ওঠে। কথাটা শুধু ত্রাণের ক্ষেত্রে নয়, সমস্ত সমস্যার ক্ষেত্রেই সত্যি।
যে বিপদ আমাদের যত কাছাকাছি, সে বিপদ আমাদের তত বিচলিত করে এটা অবাক হওয়ার মতো কোনও কথা নয়। কিন্তু, নীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে কথাটি কতটা তাৎপর্যপূর্ণ, তা ভেবে দেখার মতো। কোন সমস্যা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, বা আরও স্পষ্ট করে বললে, কোনটা সমস্যা আর কোনটা সমস্যা নয় সেটা সমস্যার নিজস্ব গুরুত্ব অনুযায়ী স্থির হয় না বেশির ভাগ সময়। যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁদের চোখ যেটাকে সমস্যা হিসেবে দেখে, সেটাই ‘সমস্যা’র স্বীকৃতি পায়। যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁদের চোখ স্বভাবতই সব সমস্যাকে দেখতে পায় না। যে সমস্যা তাঁদের ছুঁতে পারে, সেটুকুই তাঁদের সমস্যা। বেশির ভাগ মানুষের কাছেও সেটাই সমস্যা কি না, এই আম আদমির জীবনকে অন্য কোনও সমস্যা কুরে কুরে খাচ্ছে কি না এই সব প্রশ্ন তোলার সুযোগ, এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাহসও, থাকে না। ফলে, ক্ষমতাবান ও সমস্যার সম্পর্ক একটি বাক্যে গুছিয়ে বলে দেওয়া যায় তাই সমস্যা, যা দেখিবে তুমি।
এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ পরিবেশ দূষণ। দেশে বায়ুদূষণ নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, যতখানি চিন্তা হয়, জলদূষণ নিয়ে চিন্তা সেই অনুপাতে অতি সামান্য। কারণ, বায়ু দূষিত হলে তার থেকে কারও নিস্তার নেই। আমি-আপনি যে হাওয়ায় শ্বাস নেব, সনিয়া গাঁধী-সচিন তেন্ডুলকর-শাহরুখ খানও সেই হাওয়াতেই শ্বাস নেবেন। (সব বিত্তবান অবশ্য সনিয়া-সচিন-শাহরুখদের মতো দুর্ভাগা নন। তাঁদের জনসভায় যেতে হয় না, খেলার মাঠে নামতে হয় না, শুটিং করতে হয় না। বাতানুকূল ঘরের বর্ম তাঁদের চব্বিশ ঘণ্টা আড়াল করে রাখতে পারে তাঁরা বায়ুদূষণের শিকার হন না।) তাই, যাঁরা নীতিনির্ধারণ করেন, বায়ুদূষণ তাঁদেরও সমস্যা। তাঁদের সমস্যা বলেই সেটা ‘আসল সমস্যা’। ফলে, সেই সমস্যার সমাধান খোঁজার রাষ্ট্রীয়, সামাজিক তাগিদ থাকে।
জলের দূষণ বিত্তবানদের ছোঁয় না। তাঁরা দুনিয়ার সবচেয়ে শুদ্ধ জলের অধিকারী তার জন্য শুধু টাকা খরচ করতে পারলেই হয়। ফলে, দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে জলের দূষণ হল মার্কিন নাগরিকের কাছে সোমালিয়ার না খেতে পাওয়া বাচ্চাদের মতো অনেক দূরবর্তী, সুতরাং অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রশ্ন তুলে লাভ নেই যে দেশের ১২০ কোটি মানুষের জল পরিস্রুত করে নেওয়ার সাধ্য নেই, কিনে খাওয়া তো স্বপ্নের অতীত। তাঁরা যে পুকুর থেকে পানীয় জল নিয়ে যান প্রত্যহ, সেই পুকুর নীতিনির্ধারকদের দুনিয়া থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে। কোনও কারণে ক্ষমতাবানরা সেই পুকুরের বাস্তবের কাছাকাছি চলে এলে কী মারাত্মক কাণ্ড হয়, কিছু দিন আগে টের পেয়েছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের বিধায়ক তজমুল হোসেন। বিধায়ক তৃষ্ণা বোধ করায় মালদহের মসানন্দপুর অঞ্চলের বাসিন্দারা তাঁকে পুকুরের জল খাইয়েছিলেন। যে জল তাঁরা প্রত্যহ পান করেন, সেই জল। নেতাদের ভাগ্য ভাল, ঘটনাটি সংক্রামক হয়নি। হলে, হয়তো গ্রামে গ্রামে পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা হত।
কোনও একটি সমস্যাকে ‘সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করা আসলে একটা ক্ষমতার প্রশ্ন। যার হাতে ক্ষমতা, সে নিজের জায়গা থেকে সমস্যাকে চিহ্নিত করবে, শুধু এইটুকু নয়। ক্ষমতা একটা হেজিমনি, আধিপত্য তৈরি করে বিত্তবানদের সমস্যাই যে একমাত্র সমস্যা, এই কথাটা বিশ্বাস করতে বাধ্য করায়। জেনে, না-জেনে আমরাও সেই আধিপত্য তৈরির চেষ্টায় হাত মিলিয়ে ফেলি। কোনও একটি সমস্যা অন্য পাঁচটির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেতে থাকে। তাকে নিয়ে গণমাধ্যমে বেশি লেখালেখি হয়। খবরের কাগজের পাতায় যে সমস্যা জায়গা পায়, স্বভাবতই তাকে নিয়ে আলোচনাও বেশি হয়। আর, যাকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল, খবরের কাগজ, টেলিভিশনও তার কথাই বলে। একটা বৃত্ত তৈরি হয় আর সেই বৃত্ত তৈরি করে দেয় এক অমোঘ আধিপত্য। যে স্কুলপড়ুয়া মেয়েটিকে প্রতি দিন দূষিত পানীয় জলের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, সেও সম্ভবত বলবে, বায়ুদূষণ অনেক বড় সমস্যা।
শুধু এই স্কুলপড়ুয়া ছেলেটিই নয়, আমরা সবাই এই ভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছি। এই আধিপত্য তৈরি করে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতে তখন আর কেউ জলদূষণ নিয়ে তেমন মাথা ঘামানোর দাবি করবে না। তখন আর চোখ রাঙিয়ে বলতে হবে না ‘এ সব প্রশ্ন কখনও কোরো না, বোবা-কালা হয়ে থাকো’ মানুষ নিজে থেকেই আর প্রশ্ন করবে না। ক্ষমতাবানদের সমস্যাকেই সবাই নিজের সমস্যা হিসেবে মেনে নেবে, বিনা প্রশ্নে। এই হেজিমনিকে প্রশ্ন করা দরকার। জোর দিয়ে বলা দরকার, বিশ্ব উষ্ণায়ন এক বিপুল সমস্যা ঠিকই, কিন্তু সেটাই একমাত্র সমস্যা নয়। গ্লোবাল বনাম লোকালের দ্বন্দ্বে হয়তো লোকাল সমস্যা খুব ছোট জায়গায় সীমাবদ্ধ, কিন্তু সমস্যাটা যাঁদের কাছে ভয়ঙ্কর বাস্তব, তাঁদের সমস্যাকে তুচ্ছ করে দেখার অধিকার কারও নেই।
রিয়ো ডি জেনেইরোতে দিন কয়েক আগেই একটা সম্মেলন শেষ হল। রাষ্ট্রপুঞ্জের কনফারেন্স অন সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট। ডাকনাম রিয়ো প্লাস টোয়েন্টি। কুড়ি বছর আগে, ১৯৯২ সালে এই রিয়ো ডি জেনেইরো শহরেই রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রথম সুস্থায়ী উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলনটি আয়োজিত হয়েছিল। তার দু’দশক পূর্তির কথা মনে করিয়ে দিতে রিয়োতেই আয়োজিত হল দ্বিতীয় সম্মেলনটি। প্রথম রিয়ো সম্মেলনের পর পরিবেশ সচেতনতার পরিমাণ অনেক বেড়েছে। সেই সচেতনতার কেন্দ্রে রয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। এই বিপদটির আকার নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই, কিন্তু রিয়োর সম্মেলনের নামে ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট’ অর্থাৎ সুস্থায়ী উন্নয়ন নামে যে দুটো শব্দ রয়েছে, তাকে ভাঙলে কিন্তু আরও অনেক, অনেক চিন্তার কারণ দেখতে পাওয়া সম্ভব। সুস্থায়ী উন্নয়নের ধারণাটি চমৎকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজে এমন ভাবে প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষদের জন্যও ব্যবহারযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ অবশিষ্ট থাকে। তাদের জন্য যেন মাটির নীচে জল থাকে, জৈব জ্বালানি থাকে, অরণ্যে গাছ থাকে। যেন তাদের শরীরে তেজস্ক্রিয়তা প্রবেশ না করে, তাদের পানীয় জল যেন দূষণহীন থাকে। তাদের যেন খাদ্যের অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে।
হায়, সুস্থায়ী উন্নয়নের ধারণাটি খাতায় কলমেই থেকে গেল। মাঝেমধ্যে আলোচনা হয়, খাতায় কলমে, ওয়েবসাইটে লেখা হয় সুস্থায়ী উন্নয়নের কথা। কিন্তু, যতখানি আলো পড়ে বিশ্ব উষ্ণয়ানের ওপর, তার ছিটেফোঁটাও সুস্থায়ী উন্নয়নের অন্য প্রশ্নগুলোর দিকে চুঁইয়ে আসে না। বড় কর্তারা আলোচনা করে স্থির করেন, অরণ্যের ওপর আর মানুষের অধিকার থাকবে না। অরণ্যের ওপর নির্ভর করে যাদের জীবন চলে, তাদের জন্য অরণ্যের ব্যবহারকে কী ভাবে সুস্থায়ী করা যায়, সেই কথা ভাবার আর অবকাশ থাকে না। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করে আর বেশি দিন চলবে না, সেটা টের পাওয়ার পর থেকেই নজর ঘুরে যায় পারমাণবিক বিদ্যুতের দিকে। সেই বিদ্যুৎপ্রকল্পের কল্যাণে যাদের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তেজস্ক্রিয়তার আশঙ্কা নিয়ে যাদের দিন গুজরান আরম্ভ হয়, তাদের সেই সমস্যা আর ‘সমস্যা’ বলে চিহ্নিত হয় না। তাকে বড় জোর ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’-এর আখ্যা দেওয়া চলে। যে কোনও শহরের বস্তি অঞ্চলে হেঁটে দেখুন, কী ভাবে জমে আছে ফেলে দেওয়া কম্পিউটার, বিভিন্ন চিপ। তার মধ্যেই বাচ্চারা খেলছে, কিশোররা খুঁটে দেখছে এই আবর্জনার কতটুকু বিক্রি করে কিছু টাকা পাওয়া যেতে পারে। আর, মারাত্মক দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে বর্জ্য থেকে।
অনেক মানুষকে প্রতি দিনের জীবনে বিশ্ব উষ্ণায়নের চেয়ে ঢের কাছাকাছি বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, সেই বিপদগুলো অনেক কম চেষ্টায়, কম খরচে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু, তার জন্য সেই বিপদগুলোকে ‘বিপদ’ হিসেবে চিহ্নিত করা চাই। সরকার, রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংগঠন সব প্রতিষ্ঠানের চোখে সেগুলো ‘বিপদ’ হিসেবে দেখা দিলে, তবেই তার সমাধানের প্রকৃত উদ্যোগ হওয়া সম্ভব। মাটির নীচের আর্সেনিক যত ক্ষণ শুধু গ্রামের মানুষদের হাত-পায়ে ঘা তৈরি করে, তত ক্ষণ তা স্থানীয় সমস্যামাত্র। কিন্তু সবজিবাহিত হয়ে বাজার ঘুরে আর্সেনিক যখন সকলের হেঁশেলে পৌঁছয়, তখনই তার ‘বিপদ’ বোঝা যায়।
মুশকিল হল, সব ক’টা স্থানীয় বিপদ আর্সেনিকের মতো গতিশীল নয়। হলে, হয়তো ক্ষমতাবানরা সেগুলো নিয়েও বিচলিত হতেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.