এই একটি ব্যাপারে বোধহয় দেশের মধ্যে প্রথম স্থানাধিকারী না হইলেই ভাল হইত। মহিলাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ যে দেশের সকল রাজ্যকে পিছনে ফেলিয়া দিয়াছে, জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর এই পরিসংখ্যান কোনও শ্লাঘনীয় শংসাপত্র নয়। বরং ইহা এমন একটি পরিসংখ্যান, যাহার জন্য রামমোহন-বিদ্যাসাগরের বাংলার লজ্জায় মাথা হেঁট হইয়া যাওয়া উচিত। নারীদের বিরুদ্ধে বিগত বছরে সারা দেশে মোট যত অপরাধ ঘটিয়াছে, তাহার ১২.৭ শতাংশ ঘটিয়াছে একা এই রাজ্যে! দেশের মোট ধর্ষণের ঘটনার দশ শতাংশও শুধু এই রাজ্যে! স্ত্রী নিগ্রহেও পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থানাধিকারী! আরও দুইটি রোমহর্ষক পরিসংখ্যান এক, ২০০৬ সাল হইতে পশ্চিমবঙ্গে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের হার উত্তরোত্তর বাড়িয়াই চলিয়াছে। দুই, অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত হইয়া শাস্তি পাওয়ার দৃষ্টান্ত গোটা দেশের মধ্যে এই রাজ্যেই সবচেয়ে কম।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বিবিধ আত্মশ্লাঘা। নারীর সম্মান রক্ষায় রাজ্যের ‘ঐতিহ্য’গর্ব তাহার অন্যতম। এই গর্ব অন্তঃসারশূন্য। তাহা না হইলে কেমন করিয়া ধষর্ণ, নারী-পাচার, দাম্পত্য হিংসার ঘটনা এই হারে বাড়িতেছে! একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি, বিশেষত প্রশাসনের ত্রুটি নির্যাতিত নারীর সুবিচার পাওয়ার পথে বড় বাধা। ধর্ষণের ঘটনাকে চাপা দিবার জন্য প্রশাসকদের আকুতি, ধর্ষকের কঠোর শাস্তি দাবির পরিবর্তে মন্ত্রীদের তরফেও ধর্ষিতার ‘সতীত্ব’ লইয়া কটাক্ষ করার স্বতঃপ্রণোদিত তৎপরতা, মুখ্যমন্ত্রীর মতো শীর্ষস্থানীয় প্রশাসকের তরফে ধর্ষিতার অভিযোগের মধ্যে ‘শাসক দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’-এর ভূত দেখিয়া বেড়ানো এই সবই মহিলাদের প্রতি অপরাধকারীদের আস্কারা দেওয়ার নামান্তর। এ ধরনের আসকারার ফলেই পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের মূল অপরাধী পুলিশের চোখে ধুলা দিতে সমর্থ হয়। মহিলাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধে লিপ্তদের শাস্তি না দেওয়ার লজ্জাটি পশ্চিমবঙ্গের একান্ত নিজস্ব অর্জন। এই অর্জনের পিছনে নির্দিষ্ট ভাবে রহিয়াছে পুলিশ প্রশাসন ও তাহার নিয়ামক রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতদুষ্ট, উদাসীন, দায়সারা ভূমিকা।
পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক অধোগতির চিত্রটি অবশিষ্ট ভারতের কাছে বহু কালই স্পষ্ট। শিক্ষায় এ রাজ্য অধঃপাতে গিয়াছেঅধ্যক্ষ পেটানোয় পড়ুয়াদের কিংবা অধ্যাপিকা নিগ্রহে অর্ধশিক্ষিত স্কুল-পরিচালকদের রাজনৈতিক ভাবে প্ররোচিত করাই এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি। মহিলাদের সম্ভ্রম ও মর্যাদা রক্ষার যে ঐতিহ্য একদা নবজাগৃতির বাংলায় পুষ্টিলাভ করিয়াছিল, বহু কাল তাহাও অন্তর্হিত। রাজ্য মহিলা কমিশন সাফাই গাহিবার চেষ্টা করিয়াছে, এ রাজ্যের মহিলারা বেশি সচেতন বলিয়াই পুলিশের কাছে অধিক সংখ্যায় অভিযোগ জমা পড়ে, আর তাই মনে হয় যে এখানে মহিলারা বেশি নির্যাতিত। কিন্তু এই কৈফিয়ত ক্রাইম ব্যুরোর পরিসংখ্যানের শীতল বাস্তবতাকে চাপা দিতে পারে না। সচেতনতা সমাজে যে দায়বদ্ধতা আনে, প্রশাসনে যে সহমর্মিতা আনে, তাহা থাকিলে অপরাধীদের শাস্তি না-পাওয়ার পরিসংখ্যানেও এ ভাবে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থানে থাকিত না। ধর্ষক-নিপীড়কদের গ্রেফতার না-হওয়া কিংবা শাস্তি না-হওয়ার ঘটনা কোনও রাজ্যের মহিলাদের অসহায়তাকেই তুলিয়া ধরে, যেমন তুলিয়া ধরে সেই রাজ্যের শাসনতন্ত্রের অসংবেদী চরিত্রকেও। |