|
|
|
|
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি |
‘পেয়েছি, যা খুঁজছিলাম’
পথিক গুহ • কলকাতা |
|
|
ইউরেকা! একবিংশ শতাব্দীর।
বুধবার সার্ন গবেষণাগারের ভিড়ে ঠাসা অডিটোরিয়ামে সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল রল্ফ হয়ের ঘোষণা করলেন, “পেয়েছি। যা খুঁজছিলাম, তা পেয়েছি।” আর ওই মন্তব্যের সঙ্গে সঙ্গেই জানা গেল, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সব চেয়ে ব্যয়বহুল, সব চেয়ে প্রতীক্ষিত পরীক্ষার ফল। জানা গেল, ‘ঈশ্বর কণা’ সত্যি সত্যিই আছে।
সেই সঙ্গে শুরু হল গবেষণার নতুন অধ্যায়। কারণ, যে কণাটির খোঁজ মিলেছে, তা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কল্পিত ‘বোসন’ গোত্রের হলেও, পিটার হিগস কল্পিত কণার সঙ্গে হবহু এক নয়। তবে, তার খুব কাছাকাছি। নতুন কণার আবিষ্কারে বিজ্ঞানীরা উল্লসিত। কারণ, হিগস-কল্পিত কণা যেখানে ব্যাখ্যা করত শুধু পদার্থের ভর, সেখানে নতুন কণাটি সমাধান করতে পারে ব্রহ্মাণ্ডের আরও বহু রহস্যও।
জেনিভার অদূরে সার্ন-এর বিশাল অডিটোরিয়ামে দু’দল বিজ্ঞানী যখন ঘোষণা করছিলেন তাঁদের পরীক্ষার ফল, তখন সেখানে হাজির থাকতে এডিনবরা থেকে উড়ে এসেছিলেন স্বয়ং হিগস। আবিষ্কৃত কণা না-ই বা হল তাঁর কল্পনার সঙ্গে হুবহু এক, পদার্থের ভর ব্যাখ্যা করার মতো কণার অস্তিত্ব যে আছে, তাতেই খুশিতে আপ্লুত হিগস। এবং তাঁর চোখে জল। বললেন, “অবিশ্বাস্য, আমার জীবদ্দশাতেই এটা ঘটল। আজ আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত।”
সার্ন-এর ঘোষণার দিকে তাকিয়ে ছিলেন সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা। আগ্রহ তুঙ্গে উঠেছিল সার্ন-এর নিজস্ব গবেষকদেরও। সকাল ন’টার সভায় হাজির থাকতে তাই সেমিনার রুমের সামনে লাইন পড়েছিল ভোর পাঁচটা থেকে। হলের বাইরে ভিড় দেখে সার্ন-এর এক কর্তার মন্তব্য, “আমাদের সেমিনার রুম পাল্টাতে হবে।” |
|
হিগস বোসন কণার খোঁজে প্রোটন কণার সংঘর্ষ। সার্ন-এর লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে। |
ওঁদের অধীর প্রতীক্ষা সহজেই অনুমেয়। বস্তুর ভর এই ব্রহ্মাণ্ডে প্রায় সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। কণার ভর না থাকলে তা ছোটে আলোর বেগে। জোট বাঁধে না কারও সঙ্গে। অথচ এই ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে বস্তুর পাহাড়। গ্যালাক্সি, গ্রহ-নক্ষত্র। পৃথিবী নামে এক গ্রহে আবার নদী-নালা গাছপালা। এবং মানুষ। সবই বস্তু। কণার ভর না থাকলে, থাকে না এ সব কিছুই। পদার্থের ভর, সুতরাং, অনেক কিছুর সঙ্গে মানুষেরও অস্তিত্বের মূলে। ভর-রহস্যের সমাধান মানে, মানুষের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা। এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে পারে যে কণা, তার নাম তাই সংবাদ মাধ্যমে হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘গড পার্টিকল’। ‘ঈশ্বর কণা’।
‘ঈশ্বর কণা’ গুরুত্বপূর্ণ আরও এক কারণে। ব্রহ্মাণ্ড ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানীদের সব চেয়ে সফল তত্ত্বের নাম স্ট্যান্ডার্ড মডেল। ওই তত্ত্বে বলা হয়েছে যতগুলি কণার কথা, তাদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি কেবল ওই ‘ঈশ্বর কণা’। অথচ, তা কি না অন্য কণাদের ভর জোগায়। এ হেন কণার খোঁজ না মিললে স্ট্যান্ডার্ড মডেল যেন মুণ্ডহীন ধড়। অনাবিষ্কৃত কণাটির গুরুত্ব সাধারণ মানুষকে বোঝাতে ১৯৯৩ সালে কলম ধরেছেন লিও লেডারম্যান। বইয়ের নাম কী হবে? লেডারম্যান বললেন, “নাম হোক হিগস বোসন।” ঘোর আপত্তি প্রকাশকের। বললেন।, “এমন নামের বই বিক্রি হবে না। ভাবা হোক জুতসই কোনও নাম।” বিরক্ত লেডারম্যান বললেন, “তা হলে নাম থাক গডড্যাম পার্টিক্যাল।” অর্থাৎ, দূর-ছাই কণা। প্রকাশক একটু ছেঁটে নিলেন সেটা। বইয়ের নাম হল ‘দ্য গড পার্টিকল’। নামের মধ্যে ঈশ্বর! বই বিক্রি হল হু হু করে।
এ হেন কণার খোঁজে সার্ন গবেষণাগারের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে চার বছর ধরে চলেছে খোঁজ। সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে আলোর বেগে ধাবমান বিপরীতমুখী প্রোটন কণা। মুখোমুখি ঠোকাঠুকিতে ধ্বংস হয়েছে তারা। মিলেছে অকল্পনীয় পরিমাণ ‘এনার্জি’। সৃষ্টি হয়েছে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড জন্মের এক সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়ের পরের অবস্থা। আর সংঘর্ষের বিপুল এনার্জি থেকে আলবার্ট আইনস্টাইন-আবিষ্কৃত নিয়ম অনুযায়ী তৈরি হয়েছে কোটি কোটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা। যারা আবার জন্মের পর সেকেন্ডের কোটি কোটি ভাগের কম সময়ের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে জন্ম দিয়েছে আরও নতুন কণার। বিজ্ঞানের হিসেব বলছে, প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষের এনার্জি থেকে জন্মাবে পদার্থের ভর ব্যাখ্যাকারী ‘ঈশ্বর কণা’। যারা আবার জন্মেই ধ্বংস হবে নতুন কণার জন্ম দিয়ে। সত্যিই ‘ঈশ্বর কণা’ জন্মেছে কি? |
বাজি হারলেন হকিং |
বাজি ধরার জন্য বিখ্যাত স্টিফেন হকিং। অবশ্যই বিজ্ঞানের বিষয়ে। ঈশ্বর কণা নিয়েও ধরেছিলেন একশো ডলারের বাজি। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী গর্ডন কেন-এর সঙ্গে। বলেছিলেন, পাওয়া যাবে না ওই কণা। সার্ন-এ আজকের ঘোষণার পর তাঁর মন্তব্য, পিটার হিগস নোবেল প্রাইজ পাওয়ার যোগ্য। ঠাট্টা করে হকিং বলেছেন, আবিষ্কৃত নতুন কণা তাঁর কাছে ‘দামি’ হয়ে ধরা দিল। “মনে হচ্ছে একশো ডলার হারলাম!” |
|
প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষ ঘটেছে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের অ্যাটলাস এবং সিএমএস নামে দুই যন্ত্রে। সেখানে ধ্বংসস্তূপ বিশ্লেষণ করে ‘ঈশ্বর কণা’র জন্মের খোঁজ নিয়েছেন ওই দুই যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত দু’দল বিজ্ঞানী। যাঁরা আজ পেশ করলেন তাঁদের বিশ্লেষণের ফলাফল। স্পষ্ট জানা গেল, দু’দলই পাচ্ছেন নতুন একটি কণার চিহ্ন। যে কণার ভর ১৩৩টি প্রোটনের মোট ভরের সমান।
তিল ধারণের জায়গা-শূন্য সেমিনার রুমে অ্যাটলাস-দলের মুখপাত্র ফ্যাবিওলা গিয়ানোত্তি ঘোষণা করলেন, “আমাদের তথ্য ইঙ্গিত দিচ্ছে নতুন এক কণার।” তাঁর মতে, এই শনাক্তকরণ এতটাই নিখুঁত যে, তাতে ভুলের সম্ভাবনা ৩৫ লক্ষে ১। গিয়ানোত্তি জানান, ফলাফল প্রকাশে শীঘ্রই পেপার ছাপাচ্ছেন তাঁরা। সিএমএস দলের মুখপাত্র জো ইনকান্ডেলা ঘোষণা করলেন, একই রকম ভরের কণার সন্ধান তাঁরাও পেয়েছেন। তাঁর মন্তব্য, “আমরা যা দেখেছি তা নাটকীয়। আমরা খুঁজে পেয়েছি নতুন এক কণা। এটা যে ‘বোসন’, সে বিষয়ে আমাদের কোনও সন্দেহ নেই। এটা আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সব চেয়ে ভারী ‘বোসন’। এমন ‘বোসন’ খুঁজে পাওয়ার তাৎপর্য গভীর। আমাদের খুব ভেবেচিন্তে কথা বলতে হচ্ছে।” “এটা এমন এক মুহূর্ত যে উত্তেজিত না হয়ে পারছি না,” বললেন সার্ন-এর রিসার্চ ডিরেক্টর সার্জিও বার্তোলুচি, “গত বছর আমরা বলেছিলাম, ২০১২ সালে হয় খুঁজে পাব হিগস-এর কাছাকাছি নতুন কোনও কণা, অথবা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বাইরের হিগস বোসন। ঠিক তাই হল। যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করেও বলতে পারি, আমরা গবেষণার পথে নতুন এক বাঁকের সামনে দাঁড়িয়ে। আমাদের এ বার নতুন কণা সম্পর্কে গভীরে জানতে হবে।” অতঃপর? এ বার এই নতুন কণার চরিত্র অনুধাবনের লক্ষ্যে এগোবে এই গবেষণা। এর ধর্ম হিগস-কল্পিত কণার থেকে কতটা আলাদা? অনেকটা আলাদা কি? তেমন সম্ভাবনার কথা ভেবেই মহা উল্লসিত পদার্থবিজ্ঞানীরা। কারণ, স্ট্যান্ডার্ড মডেল ব্যাখ্যা দিতে পারেনি ব্রহ্মাণ্ডের মোট পদার্থের। খোঁজ মিলেছে মাত্র ৪ শতাংশ বস্তুর। বাকি ৯৬ শতাংশ গেল কোথায়? বিজ্ঞানীদের আশা, আবিষ্কৃত নতুন কণা সন্ধান দেবে সেই নিখোঁজ ৯৬ শতাংশের। |
|
|
|
|
|