বর্তমানে ‘লিঙ্গসাম্য’ নামক ধারণাটি সমাজে যথেষ্ট মান্যতা লাভ করিয়াছে। দলমতনির্বিশেষে সমস্ত শিবিরই মানিয়া লইয়াছে, পুরুষের সমান অধিকার নারীরও প্রাপ্য। নারীর বিভিন্ন সংকটের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া উচিত। এবং পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ হইতে নহে, বরং মুক্তচক্ষুতে নারীর সমস্যাগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করাই বিধেয়। এই পর্যন্ত কোনও সমস্যা নাই, ভাবনায় ‘আমরা-ওরা’ নাই, ঐকমত্য কার্যত নজিরবিহীন। প্রশ্ন হইল, এই ভাবনার ছাপ কার্যকলাপে পড়িতেছে কি? ভাবনার যে পুরুষতান্ত্রিক প্রচলগুলি সমাজের হাড়েমজ্জায় নিহিত, সেগুলির কী হইল? প্রশাসন কি যথার্থই অন্য ভাবে ভাবিতে শিখিয়াছে? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিভিন্ন দিক হইতে আভাস মিলিতেছে, পিতৃতান্ত্রিক বৈষম্য বিভিন্ন স্তরে এখনও বিদ্যমান। খাস কলিকাতার উপরে একটি সরকারি হাসপাতালে স্ত্রী-রোগ বিভাগ চলিতেছে কার্যত উন্মুক্ত কক্ষে। সেখানে রোগিণীর আব্রু রক্ষার বন্দোবস্ত নাই বলিলেই চলে। কোনওক্রমে, সংকোচে জড়োসড়ো অবস্থায় রোগিণীরা চিকিৎসার জন্য আসিতেছেন। কেন এই দুরবস্থা, তাহার কারণ নিশ্চয়ই পরিকাঠামোগত। কারণগুলি যথেষ্টই পরিচিত। স্থানাভাব। উপযুক্ত বন্দোবস্তের অভাব। অথচ, এই সবের ভিতরেই দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখিলে শঙ্কা জাগে, গভীরে অন্য একটি বিষয় হয়তো নজরে আসিল না। সেটিও এই দুরবস্থার অন্যতম কারণ। তাহার নাম মানসিকতা। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা। সেই মানসিকতা যাহা অজস্র রোগিণীর এই ধরনের অসুবিধাকে কার্যত গণ্যই করে না। মুখে সহানুভূতির বান ডাকিতে পারে, ডাকেও, অথচ কার্যকালে সেই সহানুভূতিটি অদৃশ্য হইয়া যায়। যদি সত্যই টনকটি নড়িত, তাহা হইলে বুঝা যাইত, শুধু ঔষধ, চিকিৎসক এবং কিছু সরঞ্জাম হইলেই চলে না, একটি হাসপাতালে তাহার সহিত আরও অতিরিক্ত কিছু লাগে। সেই বস্তুটির নাম, স্বাচ্ছন্দ্য। তাহা না থাকিলে পরিষেবাটি কখনওই সার্থক এবং সম্পূর্ণ হইতে পারে না। যে হাসপাতালে অজস্র কৌতূহলী চক্ষুর সম্মুখে স্ত্রীরোগের চিকিৎসা চলে, সেই স্থানে স্বাচ্ছন্দ্য দূরস্থান, সমগ্র চিকিৎসা প্রক্রিয়াটিই এক ধরনের অত্যাচার হইয়া দাঁড়ায়। রোগিণীরা অসুখের সহিত সেই অত্যাচারটিও সহ্য করেন।
প্রশ্ন হইল, কখন ইহাকে অত্যাচার বলিয়া চিহ্নিত করা যাইবে? তখনই, যখন ইহাকে অত্যাচার বলিয়া ভাবিবার অভ্যাসটি গড়িয়া উঠিবে। অন্যথায়, কাহারও কোনও হেলদোল থাকিবার কথা নহে। থাকেও না। অথচ, সেই অভ্যাসটি নির্মিত হইলে অনেক কথাই জরুরি ঠেকিতে পারে। যেমন, সমাজে নারীর কিছু কিছু সংকটের নিরসন চাহিলে তাহার জন্য উপযুক্ত বাতাবরণ নির্মাণ করিতে হয়। পিতৃতান্ত্রিক আবহের এই ধাঁচায় তাহার সমাধান খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন। সেই সূত্রেই ‘মহিলা থানা’র কথা আসিতে পারে। সাধারণ ভাবে ‘থানা’ বলিলেই একটি পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশের ছবি ভাসিয়া উঠে। তাহার ঠিক বিপ্রতীপেই ‘মহিলা থানা’। অর্থাৎ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নিমিত্ত এমন একটি স্থান যেখানে মহিলাগণ স্বচ্ছন্দে নিজের অসুবিধার কথা, সংকটের কথা বলিতে পারেন। তাহাতে সংকট নিরসনের প্রক্রিয়াটির সুবিধা হইতে বাধ্য। মহিলাদের এই পরিসরটি দেওয়া জরুরি। মহিলাদের যে এই পরিসরটি দেওয়া প্রয়োজন, তাহা ভাবাও জরুরি। এই ভাবনাটি বিস্তৃত হউক। তাহাতে নারীর লাভ। পুরুষেরও। |