প্রবন্ধ...
বিক্ষোভ চলুক, পর্যটকের গাড়ি কেউ আটকাবে না
নেপালি? আপ নেপালি? বাসের জানালা দিয়ে রাস্তা অবরোধ করা আন্দোলনকারীদের দেখছিলাম, চমকে মুখ ঘুরিয়ে দেখি আমার দিকেই আঙুল তুলে লাঠি হাতে বলিষ্ঠ একটা লোক বাসের ভিতর দাঁড়িয়ে। না, আমি ভারতীয় জানাতে প্রশ্ন: কাঁহা সে আয়া। কোনও রকমে বললাম, কলকাতা। মুহূর্তের জন্য মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার সিনেমার দৃশ্য চোখে ভেসে উঠল। পাশের আসনে আমার কিশোর ছেলের মুখের দিকে এক বার তাকালাম। লোকটি এ বার মুখ ঘুরিয়ে বাসে জনা পনেরো ভারতীয় আর আঠারো-উনিশ জন ইউরোপ-আমেরিকা-জাপান থেকে আসা পর্যটকদের এক ঝলক দেখল। নিয়ে বাস থেকে নেমে গেল। ‘গ্রিনপ্লেট’ বাস ছাড়ল। এগিয়ে চলল পোখরা ছেড়ে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দিকে।

মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে লাগাতার ধর্মঘটের মধ্যে নেপালে পৌঁছলাম। এখানে তখন এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলটদের ধর্মঘট চলছে। কলকাতা-কাঠমান্ডু উড়ান যাবে কি না তা নিয়েই আমরা চিন্তিত নেপালের আন্দোলনের খবরে ততটা গুরুত্ব দিইনি। কাঠমান্ডুতে একটা হোটেলে চেক-ইন করে বিকেলে রাস্তায় নেমে শুনলাম নেপালে ধর্মঘট চলছে। সাতটি রাজনৈতিক দল একসঙ্গে পাঁচ দিনের লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। আমাদের কাঠমান্ডুতে দু’দিন থাকার কথা, তার পর পোখরা যাব। আমরা তীব্র হতাশ। তবে কি কাঠমান্ডু শহর আর তার আশপাশে অনিন্দ্যসুন্দর সব মন্দির-মনেস্ট্রি বা পোখরার সবুজ লেক আর মাথার উপর ঝকঝকে অন্নপূর্ণা রেঞ্জ দেখা হবে না? দোনামনা করে একটা ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে ঢুকলাম। আর ওখানেই প্রথম শুনলাম ‘গ্রিনপ্লেট’ কথাটা।
আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টা খুবই সাধারণ। নেপাল সরকার কিছু লাক্সারি বাস এবং গাড়িকে ‘গ্রিনপ্লেট’ লাইসেন্স দিয়েছে। এই গাড়িগুলির সামনের ও পিছনের নম্বর প্লেট সবুজ। তাতে সাদা হরফে গাড়ির নম্বর লেখা। এই গাড়িগুলি শুধুমাত্র নেপাল ভ্রমণে আসা পর্যটকদের নিয়ে যায়। এবং, গ্রিনপ্লেট গাড়ি সমস্ত রকম ধর্মঘট-অবরোধ-হরতালের আওতার বাইরে।
কাঠমাণ্ডুর পাটান দরবার স্কোয়্যার-এ পর্যটক ও স্থানীয় মানুষের ভিড়
এই শর্তটা দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল এক বাক্যে মেনে নিয়েছে এবং মেনে চলেছে। এই মনোভাব নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। কারণ, নেপালের মোট জিডিপি-র ৪ শতাংশ আসে পর্যটন থেকে। সে দেশে গত এক দশকেরও বেশি রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। মানুষ রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছেন। এ সব সহজে হয়নি। বহু মিছিল, সভা, অবরোধ, লাগাতার ধর্মঘট হয়েছে। ফলে এক সময় নেপালের পর্যটন শিল্পে ভাটা এসেছিল। গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকের আন্দোলন করার অধিকার প্রয়োগের সঙ্গে নেপালের মানুষ অর্থনীতির কথাটাও বুঝেছেন। বুঝতে পেরেছেন যে, বিদেশি পর্যটক না এলে অর্থনীতি আরও দুর্বল হবে। সেখান থেকেই এই গ্রিনপ্লেট গাড়ির ভাবনা। আমরাও মে মাসের ধর্মঘটের সময় নেপালে এই সুবিধাগুলো পুরো মাত্রায় পেয়েছি। সবুজ নম্বর প্লেটওয়ালা গাড়িতে কাঠমান্ডুর আশপাশের দ্রষ্টব্য স্থানগুলো দেখেছি। পোখরায় দু’দিন থেকে ধর্মঘটের মধ্যেই গ্রিনপ্লেট বাসে কাঠমান্ডু ফিরেছি। এটা ঠিক যে, রাস্তায় বহুবার আন্দোলনকারীরা বাস থামিয়ে দেখেছে আমরা সবাই বিদেশি পর্যটক কি না। কিন্তু বাস আটকে রাখেনি, যেতে দিয়েছে। রাস্তায় হোটেলে দাঁড়িয়ে মধ্যাহ্নভোজনেও কোনও ব্যাঘাত ঘটেনি। হ্যাঁ, ধর্মঘটেও নেপালে সমস্ত হোটেল ও খাবার জায়গা খোলা।

নেপাল যখন পেরেছে, আমরা কেন এ দেশে ধর্মঘট বা হরতালে পর্যটকদের বাধাহীন ভাবে যত্রতত্র ভ্রমণের সুবিধা দিতে পারি না? কেন রাজনৈতিক দলগুলি এ বিষয়ে আর একটু সচেতন হবে না? বহু বার পাঁচ-ছয় ঘণ্টার নোটিসে পর্যটকদের পাহাড় ছেড়ে সমতলে নেমে যেতে বলা হয়েছে। পর্যটকরা বাধ্য হয়েছেন তিন-চার গুণ বেশি ভাড়ায় গাড়িতে বা ট্রেকারে গাদাগাদি করে নেমে আসতে। ফলে, পর্যটকরা পরের বার যাবার আগে দশ বার ভাবেন। বিদেশি পর্যটকেরা এড়িয়ে চলেন। এই কারণেই, নানা রাজনৈতিক টালমাটাল সত্ত্বেও, কাঠমান্ডু বা পোখরাতে যত পশ্চিমি পর্যটক দেখলাম, তার ১০ শতাংশও আমাদের দার্জিলিং পাহাড়ে বা ডুয়ার্সের জঙ্গলে আসে না। অথচ কাঠমান্ডু শহরের তুলনায় দার্জিলিং অনেক সুন্দর। গরুমারা, জলদাপাড়া বা জয়ন্তীর জঙ্গল অনেক বেশি সবুজ, অনেক বেশি মায়াবী নেপালের চিতওয়ান অরণ্যের তুলনায়।
কাঠমান্ডু শহরে ‘এয়ারপোর্ট ডাউনটাউন শাট্ল বাস সার্ভিস’ বলে কিছু বাস আধ ঘণ্টা অন্তর একটা নির্দিষ্ট টারমিনাস থেকে ছেড়ে শহরের বিভিন্ন বড় হোটেলগুলিতে ঘুরে ঘুরে পর্যটকদের সংগ্রহ করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেয় এবং এয়ারপোর্ট থেকে একই ভাবে পর্যটকদের শহরের বিভিন্ন হোটেলে নিয়ে আসে।
এই বাসগুলিও ধর্মঘটের আওতার বাইরে। এই ধরনের বাস পরিষেবা কেন আমাদের বাগডোগরা বা দমদম বিমানবন্দরে নেই? কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ন’টি দেশের বিমান ওঠানামা করে, অথচ বাগডোগরাকে আমরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করতে পারলাম না। নেপালের এই বিষয়গুলি আমরা অনুকরণ করতে পারি এবং করা উচিতও। নচেৎ আমাদের পর্যটন শিল্প যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.