|
|
|
|
না-অতি: বড় বিষম বিশেষণ |
মাঝারি গড়ন, মাঝারি উচ্চতা। মেনে নিন, মানিয়ে নিন। অর্থাৎ কিনা,
প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে যেতে হয় অস্তিত্ব। আমিও আছি স্যর।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় |
উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।” আর এই মধ্যমকে নিয়েই যত মুশকিল। লম্বা নয়, বেঁটে নয়, কালো নয়, ফর্সা নয়, ভাল নয়, মন্দ নয়, বুদ্ধিমান নয়, নির্বোধও নয় এই হল মাঝারি। আমাদের দেশে পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনে এই রকম থাকে মাঝারি উচ্চতা, মাঝারি গড়ন, মাঝারি রং, মধ্যশিক্ষিত। অর্থাৎ গড়পড়তায় আমরা তেমন চোখে পড়ার মতো নই, আবার উপেক্ষা করাও ঠিক হবে না।
বিখ্যাত বেঁটেদের কথা আমরা জানি। নেপোলিয়ন, চ্যাপলিন, মারাদোনা, ব্র্যাডম্যান, সচিন তেন্ডুলকর। বাঁটকুল জাপানিরা দুনিয়াকে ঝাঁকুনি বড় কম দেননি। আর লম্বু ব্রিটিশ, আমেরিকান, ইউরোপিয়ানরা তো আছেনই। দুনিয়াটা তাঁদেরই কব্জায়। এঁদেরই মাঝবরাবর নাতিদীর্ঘ, না শ্বেত না কৃষ্ণ, নাতিবুদ্ধিমান, নাতিসপ্রতিভ মাঝারি মাপের সংখ্যাতীত মানুষ। ‘ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে’ তারাই থিকথিক করছে প্রাচ্যে, দূর প্রাচ্যে, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, পঞ্চ মহাদেশে। বৈশিষ্ট্যহীন, গুরুত্বহীন, ইতিহাসহীন লোক। যদি জিজ্ঞেস করা যায়, আপনি কে বলুন তো? জবাব আসবে, আমি? আমি এক জন লোক। |
|
কোচবিহারের বন্যার গল্প আমি অনেক লিখেছি। যেটা লেখা হয়নি তা হল একটি কিশোর ও কিশোরীর গল্প। সেই ডুবন্ত শহরে শুধু একটু ভেসে ছিল কলেজের ক্লাসরুম আর আমাদের হস্টেল। কলেজে বন্যার্ত মানুষেরা জড়ো হয়ে আছে। জল নেই, খাবার নেই, বাচ্চাদের দুধ নেই। ফলে আমাদেরই সে সব সরবরাহ করতে হয়েছিল, হস্টেলেরই ভাঁড়ার থেকে। সাঁতার জানতাম আমরা মোটে পাঁচ জন। পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, কোমরে গামছা, এই পোশাকে দিনরাত গামলা গামলা গরম খিচুড়ি, বালতিতে পাউডার গোলা দুধ, এই সব গলা-জল, ডুবজল ভেঙে পৌঁছে দিচ্ছি। অমানুষিক ওই খাটুনিতে চেহারার যা শ্রী হয়েছিল তখন, বলার নয়। পরিশ্রমে কথা বলার পর্যন্ত শক্তি থাকত না। তবু অঘটন ঘটেছিল। একটি কিশোরী মেয়ে ভারী শ্রী ছিল তার মুখে, দিদিমার সঙ্গে ঘরের এক কোণে বসে থাকত। চোখে ভয়, মুখ শুকনো, বারকয়েক মুখোমুখি হওয়ার পর এক দিন হঠাৎ সে লক্ষ করল আমায়। চোখে যেন মায়া ঝরে পড়ল। তার পর আমি গেলে সে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত, মৃদু হাসত। সেই বয়সে কটাক্ষ চিনতে কি ভুল হয়? সেই আশ্রয়শিবিরেই কিছু রাজনীতির লোক ঢুকে ওই দুর্যোগেও লোককে খেপিয়ে তুলেছিল এই বলে যে, আমরা নাকি সরকারের দেওয়া চাল ডাল মেরে দিচ্ছি, ওদের ঠিক মতো দিচ্ছি না।
এক দিন কিছু মারমুখো লোক আমাদের ঘিরে ফেলে সে কী গালাগাল। এই মারে কি সেই মারে। আমরা তখন এমনই ক্লান্ত যে প্রতিরোধ দূরের কথা, প্রতিবাদ করার মতোও গলার জোর নেই। খিচুড়ির হাঁড়ি নিয়ে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে আছি, তখন আচমকা সেই বুড়িটাই লাফিয়ে এসে আমাদের আড়াল করে দাঁড়াল। তার গলার জোর ছিল বটে, মারমুখোরা পিছু হটল, এবং অন্য সব লোক আমাদের পক্ষ নিল বলে রক্ষা। আর সেই দিনই মেয়েটি চুপিচুপি তার নাম বলে দিয়েছিল আমাকে। কুসুম? নাকি পুষ্প? ঠিক মনে নেই আজ। সেই বয়সে অমন সুন্দর মেয়ে আর কখনও দেখিনি।
সেই রাতেই ঠিক করে ফেললাম, এই মেয়েটিকেই এক দিন আমি বিয়ে করব। বন্যার জল নেমে গেল। বিদায় নেওয়ার সময় মেয়েটা আমাকে তার ঠিকানাও বলে দিয়ে গেল। বুড়ি নেমন্তন্নও করেছিল আমাকে, এক দিন আমাদের বাড়িতে এসো বাবা।
যাব যাব করতে করতে মাসখানেক কেটে গেল বোধহয়। এক দিন বিকেলে রাসমেলার মাঠের ধারের রাস্তায় একেবারে মুখোমুখি তার সঙ্গে দেখা। রাস্তায় তেমন লোকজনও ছিল না। মেয়েটি সোজাসুজি তাকালও আমার দিকে। কিন্তু কী আশ্চর্য, একদম চিনতে পারল না। সোজা গটগট করে হেঁটে চলে যাচ্ছিল। আমি পিছু ফিরে মাঠে নেমে প্রায় দৌড়ে মেয়েটাকে ছাড়িয়ে গিয়ে ফের ঘুরে তার মুখোমুখি হলাম, একটু হেসে কথাও বলতে গেলাম। কিন্তু সে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পাত্তাই দিল না।
আমি বজ্রাহত। এটা কি সে? চিনতেই পারল না! আমার পরনে আজ ভেজা স্যান্ডো গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট আর কোমরে গামছা নেই বটে, কিন্তু এ তো আমিই!
সেই থেকেই আমার আইডেন্টিটির বড্ড সমস্যা। আমাদের মতো মাঝারিদের মনে রাখা বড় মুশকিল। এ যেন ভিড়ের অজস্র মুখের মধ্যে দেখা ও হারিয়ে যাওয়া একটা মুখ। মাঝারি হাইট, মাঝারি রং, মধ্য মেধার অজস্রের ভিড়ে গুলিয়ে যাওয়া এই যে আমি, আমাকে প্রতি দিন আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়ে একই অফিসে ঢুকতে হয়। প্রতি দিন জানান দিতে হয়, এই আমি, অমুকচন্দ্র তমুক, আমিও আছি হে! ভয় হয়, বড্ড ভয় হয়, কে কবে ভুলে যাবে আমাকে! |
|
|
|
|
|