|
|
|
|
|
|
প্রতি পক্ষ |
দৃশ্য থেকে ভাবনা |
যদি এমন হয় যে দৃশ্যরূপ থেকেই গড়ে উঠছে কোনও চিন্তা, ভাবনার বীজ, এবং জন্মগ্রহণের
পরে সেই চিন্তাই হাঁটছে বিপরীত দিকে! স্টুডিও ২১-এর প্রদর্শনী দেখে লিখছেন শোভন তরফদার |
ভাবনা কাকে বলে? কী-ই বা হতে পারে তার দৃশ্যরূপ? প্রথমটি বিমূর্ত জিনিস। যদিও কোনও অবয়ব অনুযায়ী তার ঘনিয়ে ওঠা, মনের মধ্যে, কিন্তু দেখার সময় কেমন-ই বা তার আকার? প্রশ্নগুলো সহজ। উত্তরটি সংক্ষিপ্ত। যত মত, তত পথ। সেই অনেকান্ত গড়নই আধুনিক দৃশ্য-ভাবনার শিকড়। অতঃপর, আধুনিকতা ভাবনা ও দৃশ্যরূপের সেই নিহিত বিরোধকে নানা শাখায় ছড়িয়ে দিয়েছে। আবার, শুধু ভাবনা থেকেই দৃশ্যরূপের দিকে এগোব কেন, যদি এমন হয় যে দৃশ্যরূপ থেকেই গড়ে উঠছে কোনও চিন্তা, ভাবনার বীজ, এবং জন্মগ্রহণের পরে সেই চিন্তাই হাঁটছে বিপরীত দিকে! মূল দৃশ্যের বিপরীতে স্থাপন করছে নিজের অস্তিত্ব! তখন? |
|
এমনই নানাবিধ ভাবনার ফুলকি উসকে উঠতে পারে সাম্প্রতিক একটি প্রদর্শনী থেকে। ‘কনফ্রন্টেশন: কনফ্লিক্ট বিটুইন আইডিয়াস অ্যান্ড ইমেজেস’। নিবেদনে স্টুডিও ২১। শিল্পীরা যথাক্রমে অঙ্কন বন্দ্যোপাধ্যায়, অপু দাশগুপ্ত, চন্দনা মুখোপাধ্যায়, দেবস্মিতা সামন্ত, দেবতোষ কর, পাপ্পু বর্ধন, সুমন্ত্র মুখোপাধ্যায় এবং তিমির ব্রহ্ম। তাঁরা যে যার মতো করে এক-একটি সংলাপ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন কিছু দৃশ্যের সঙ্গে। ‘ইমেজ’-এর সঙ্গে। সেই সংলাপের মধ্যেই ধরা দিয়েছে তাঁদের ভাবনার ভাস্কর্য। ধরা পড়েছে সেই বিরোধ, যা তাঁদের শিল্পকর্মকে আধুনিকতার একটি বিশিষ্ট মাত্রা দিয়েছে।
‘পপুলার ইমেজ’ ব্যবহার করে তার সঙ্গে সংলাপ নির্মাণের চেষ্টা সমকালীন শিল্পের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ। দেবস্মিতা সামন্ত হিন্দি ছায়াছবি ‘পাকিজা’-র দৃশ্য ব্যবহার করেছেন তাঁর শিল্পকর্মে। অ্যাক্রিলিক এবং কোলাজে একটি কাজের নাম ‘মাই ‘হিরো’ ইন সিরিজ টু’। আছে একটি চেনা ইসলামি শিল্পের মোটিফ। বাদশাদের প্রাসাদ ইত্যাদির অন্দরসজ্জায় এই মোটিফ-এর ব্যবহার এমনকী শিল্প সম্পর্কে নিতান্ত উদাসীন ব্যক্তিরও অচেনা ঠেকবে না। অতঃপর, প্রশ্ন, ‘হিরো’ তা হলে কে? কাজটিতে কোথাও কোনও পুরুষের ছবি নেই। তা হলে?
এইখান থেকেই উড়াল দেয় চিন্তা। আপাত দৃশ্যমান বস্তুর গভীরে, বস্তুত, তার বিপরীতেই নিজের ভাবনাকে নিক্ষেপ করেন শিল্পী। ‘হিরো’ অর্থাৎ নায়কের নির্মাণ কী ভাবে হবে, কী ভাবে হয়, তা নিয়েই ঘনিয়ে ওঠে সমস্যাপট। তার মধ্যে ঢুকে যায় সামাজিক অভ্যেস, প্রথার ঘূর্ণিপাক, ঢুকে যায় ‘হিরো’ বলতেই একটি বিশেষ লিঙ্গ-পরিচয়কে ভেবে নেওয়ার অলিখিত ফতোয়া। মোটিফের উপরে এবং নীচে সোজা এবং উল্টো করে দু’টি ছবি বসিয়েছেন শিল্পী। তা হলে কি ইশারা থেকেই যাচ্ছে এই চলতি সিস্টেমের ভিতরে অন্তর্ঘাতের? এই ছবি দু’দিক থেকে দু’রকম। দু’দিকই উল্টো, এবং দু’দিকই সোজা। অতঃপর? বুঝ মন যে জান সন্ধান।
|
|
আবার, অঙ্কন বন্দ্যোপাধ্যায় যখন একুশ শতকী প্রেম বলতে একটি বর্ণময়, ফুলেল মোটিফ-সজ্জিত ‘প্রেসার কুকার’-এ ঢুকে থাকা ব্যক্তির সিল্যুয়েট চেহারা আঁকেন, তখন চকিতে ধরা পড়ে ভালবাসার সমকালীন চেহারার গভীরে ঢুকে থাকা বিবিধ চাপ, তাপ এবং অসুখ। এক দিকে বর্ণিল, অন্য দিকে কী অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয় এই সব ভালবাসার গভীরে, হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে চিত্ত, আবার পরক্ষণেই হানা দেয় চোরা অন্ধকার, সেই টানাপড়েন, প্রেমিক ও প্রেমিকাকে ক্লান্ত করে, ক্রমাগত।
অপু দাশগুপ্ত আঁকেন গণমাধ্যমের সামনে এক আননহীন লোক। তার মাথা আছে, মুখমণ্ডল নেই। চক্ষু নেই। সে কী দেখে, আমরা জানি না। আমরা তাকে দেখি। সাদা এবং কালোয় গড়া তার অবয়ব। সামনে কিছু রঙিন মাইক্রোফোন ঝুলতে থাকে। সেই তার জীবনের একমাত্র রং। বাকি দৃশ্যপট হা হা করে ফাঁকা। এই ভাবে লোকটির অন্তর্গত শূন্যতা যেন ছড়িয়ে পড়ে সম্পূর্ণ চিত্রপটে। এই ব্যক্তিটি কে? অমল? বিমল? কমল? ইন্দ্রজিৎ? যে কেউ। সে নির্বিশেষ, ফলে সে যেন একটি বিচিত্র আধার। দর্পণের মতো যেন বা। তার মধ্যে যে কোনও ব্যক্তির ছায়া পড়তে পারে। |
|
আবার, পুরাকথার ছবি কী ভাবে অন্য দৃশ্যকল্পে দেখা দিতে পারে, তার পরিচয় তিমির ব্রহ্মের কাজে। গন্ধমাদন পর্বত হাতে উড়ন্ত হনুমান ভারতীয় গণমানসে অতি পরিচিত দৃশ্যকল্প। তাকে অন্য ভাবে দেখতে চেয়েছেন শিল্পী। ‘হনুমান’ এখানে ‘হানি-ম্যান’! তার চেহারা আধুনিকতা ও প্রাচীনত্বের একটি আশ্চর্য খিচুড়ি। চোখে গগলস। হাতে একটি ছোট্ট বাড়ি, তার মধ্যে স্নানরতা এক নারী। যেন ‘শাওয়ার’-এ স্নান করছে সে, ভঙ্গিটি এমনই। জল আসছে কোথা থেকে? যন্ত্র নয়, জল আসছে বৃষ্টির আকারে। তা হলে কি বৃষ্টিও আর অ-যান্ত্রিক থাকল না? এই ‘হানি-ম্যান’ কি পণ্য-রতি আক্রান্ত সভ্যতার নিতান্ত অনুগত ‘ডেলিভারি ম্যান’? যা হুকুম করা হবে, তৎক্ষণাৎ সেই বস্তুটি হাজির করাই যার জীবনের মোক্ষ! যে গৃহটি নিয়ে আসেন তিনি, তার ভিতরে সেই নারীটিও কি আসলে সেই পণ্যেরই একটা অংশ? আর, ওই গভীর নীল আকাশের নীচে যে অজস্র মানুষ, যারা পথবাসী, গতিহীন, গৃহহারা, তাদের দিকেও কি তাকায় সে? চক্ষুর রোদচশমা ভেদ করে সেই সব ছবিও কি হানা দেয় তার চোখে?
এমন নানা ভাবনা, দৃশ্য এবং ভাবনা, ভাবনা এবং দৃশ্য মাথার ভিতরে ছুড়ে দেবে এই প্রদর্শনী। ‘ডোভার টেরাস’-এ স্টুডিও ২১-এর কক্ষে, ১৪ জুলাই পর্যন্ত। |
|
|
|
|
|