প্রবন্ধ ১...
ডাক্তারি বিচার চলুক
বন্ধ হোক অশোভনতার মজা
কোনও কোনও বিখ্যাত মানুষের ক্ষেত্রে তাঁদের নিজের জন্মপরিচয়ের লিঙ্গ-ভিত্তি নিয়ে অসন্তোষ এবং সেই পরিচয় পেরিয়ে ‘অন্য’ কেউ হয়ে ওঠার কাহিনির সঙ্গে আমরা পরিচিত। এ বার মনে করুন, সেই মানুষটির তিন বছরের সঙ্গী বা সঙ্গিনী থানায় গিয়ে ডায়রি করলেন তাঁর উপর কী নির্মম শারীরিক অত্যাচার চলেছে তাই নিয়ে। অভিযোগ উঠল, মানুষটি যে পরিচয়ে পরিচিত তা মিথ্যে। এই সব ক্ষেত্রে কী হতে পারত? পুলিশ কি তাঁর গায়ে অশোভন ভাবে হাত দিয়ে গাড়িতে তুলত? হাসপাতালের ট্রলিচালক কি তাঁকে ঠেলতে ঠেলতে বলত, ‘বলো না, বলো না, তুমি আসলে কী?’ বোধহয় না।
অথচ এ সব ঘটনাই ঘটেছে পিঙ্কি প্রামাণিক-এর সঙ্গে। সম্ভবত তার কারণ পিঙ্কির পদবি প্রামাণিক (তার দিদি কাজল এবং অভিযোগকারিণী বলছেন ‘পরামানিক’)। কারণ, পিঙ্কির বাড়ি পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে প্রত্যন্ত বাঘমুন্ডিতে। কারণ, পিঙ্কির পরিবার দৃশ্যত দরিদ্র। তাঁর গায়ে মজা-লোটা জনসাধারণ বা পুলিশ হাত দিলে তাঁকে ঘিরে থাকে না কোনও বিশিষ্ট আইনজীবী। তাঁর পরিবার মেয়ের হেনস্থায় কাঁদে, প্রতিবাদে উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠতে পারে না।
কিন্তু পিঙ্কি তো কোনও অংশে কম নন দেশকে পরিচিত করানোর ক্ষেত্রে। তিনি ছবি আঁকেননি, চলচ্চিত্র বানাননি, কিন্তু মাঠে নেমে দৌড়েছেন ২০০৬ সালে দোহার এশিয়ান গেমস্ আর সেই বছরেই মেলবোর্ন কমনওয়েলথ গেমস্-এ ৪x৪০০ মিটার রিলে রেস-এ যথাক্রমে সোনা ও রুপো পেয়েছেন। খেলার রেকর্ডের জন্য আঠারো বছর বয়স হওয়ার আগেই রেলে চাকরি পেয়েছেন। তাঁর তিন বছরের একত্রবাসের সঙ্গিনী অভিযোগ এনেছেন, পিঙ্কি মেয়ে নন, ছেলে, এবং পিঙ্কি তাঁকে দীর্ঘদিন ধর্ষণ করে আসছেন। চাকরিদাতা রেল তাঁকে সাসপেন্ড করেছে, বলেছে মেয়ে বলে প্রমাণিত হলে চাকরি ফিরে পাবেন পিঙ্কি।
নির্লজ্জ হাতের ভিড়ে।
পিঙ্কি যত দিন খেলেছেন, দেশকে পদক এনে দিয়েছেন, তত দিন কিন্তু এ সব প্রশ্ন ওঠেনি। অভিযোগের পর এ পর্যন্ত তিন বার তাঁর লিঙ্গ পরীক্ষা হয়েছে। প্রথমে বারাসতের একটি নার্সিং হোমে, যেখানে তাঁকে ডাক্তার দেখে বলে দেন পিঙ্কি ছেলে। (আমাদের পাশ করা ডাক্তারবাবুদের মধ্যে গড়ে কত জন আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের ধার ধারেন?) তার পর বারাসত জেলা হাসপাতালের সাত জন ডাক্তারের বোর্ড এবং তারও পরে এস এস কে এম বা পিজি হাসপাতালের এগারো জন ডাক্তারের বোর্ড এ পর্যন্ত মোট আঠারো জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এখনও কোনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। বলেছেন, পিঙ্কির রক্ত ক্রোমোসোম পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে হায়দরাবাদ বা মুম্বইতে। সংবাদে প্রকাশ, পিজি হাসপাতালে যে সে ব্যবস্থা নেই, সেটাও ডাক্তাররা জানাননি, হয়রানি করেছেন পিঙ্কিকে। পিঙ্কির শরীর এখন আর তাঁর নিজের নেই। পুলিশ, জনসাধারণ, ডাক্তার সবাই এক বার তাঁকে টিপেটুপে দেখে নিজেদের মতো করে বুঝে নিয়েছেন পিঙ্কি ছেলে না মেয়ে। এ তো বিনি-পয়সার মজা। গোপনীয়তা রক্ষা? পিঙ্কির বারাসতের নার্সিংহোমের শারীরিক পরীক্ষার ছবি নাকি এখন মোবাইলে ঘুরছে। আসলে কি পিঙ্কির প্রতি আচরণ আমাদের চাপা জাতপাতের, দারিদ্রের প্রতি তাচ্ছিল্যের বহিঃপ্রকাশ? আমরা বার বার ‘প্রমাণ’ করতে চাই পিঙ্কি ঠগ, পিঙ্কির সাফল্যের পেছনে কোনও রহস্য আছে?

বিজ্ঞান যত এগিয়েছে, নারী-পুরুষের বিভেদ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রটা যে কত আলো-আঁধারি, তা সামনে এসেছে। ভ্রূণ প্রথম যখন মাতৃগর্ভে জন্মায়, তখন তা মায়ের এক্স (X) ক্রোমোসোম নিয়ে জন্মায়, বাবার থেকে এক্স (X) ক্রোমোসোম পেয়ে থাকলে সে তবে মেয়ে, আর ওয়াই (Y) পেলে ছেলে। অর্থাৎ মেয়ে= এক্স-এক্স আর ছেলে=এক্স-ওয়াই। সমস্যা বাধায় প্রকৃতি। কেউ কেউ জন্মায় এক্স-ওয়াই-এক্স-ওয়াই হয়ে, কেউ এক্স-এক্স-ওয়াই, কেউ এক্স-ওয়াই-ওয়াই হয়ে। যৌনতার বিচারে হয়তো আপাতদৃষ্টিতে কারও পুরুষের মতো যৌনাঙ্গ, ভিতরে হয়তো রয়ে গিয়েছে মেয়েদের যৌনাঙ্গের অবশেষ বা অপূর্ণ নারী-জননাঙ্গ। মেয়েদের ক্ষেত্রে এর বিপরীত ঘটতে পারে। চেহারা বা যৌনাঙ্গ দেখে, তাতে সংশয় থাকলে ক্রোমোসোম পরীক্ষাও শেষ কথা বলে না, তাই তার সঙ্গে নারী-পুরুষ চিহ্নিতকরণে ব্যবহৃত হয় অণ্ডকোষ বা ডিম্বাশয়ের উপস্থিতি এবং মনোবৃত্তি সেই মানুষটি নিজেকে কী ভাবছেন। জন্মের সময় পরিবার, দাই-মা বা বারাসতের নার্সিং হোমের ডাক্তারদের মতো কারও হাতে প্রসব হয়ে থাকলে তাঁদের ফরমানে এ রকম আলো-আধাঁরি মানুষেরা ভুল লিঙ্গচিহ্নে সারাটা জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। পিঙ্কি হয়তো সেই আলো-আধাঁরি মানুষদের দলেই! সেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া নারী বা পুরুষটির ওপর সমাজের এবং পরিবারে অনুশাসন যদি চেপে বসে, তা হলে সে যা হতে চায়, তা কখনওই হয়ে উঠতে পারবে না। বরং মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হতে পারে। একেই বলা হচ্ছে জেন্ডার আইডেনটিটি ডিসঅর্ডার।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইয়োরোপের ছেলে খেলোয়াড়রা মেয়ে সেজে নানা খেলায় এসে পদক নিয়ে যাচ্ছে, এই সন্দেহে ১৯৫০ সাল থেকে পশ্চিমী দেশগুলোতে বাধ্যতামূলক হয়ে যায় মেয়ে খেলোয়াড়দের শারীরিক পরীক্ষা। ১৯৬৮ সালে অলিম্পিকে তা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। পরীক্ষার জেরে ১৯৬৮ সালে টোকিয়ো অলিম্পিকে সোনাজয়ী পোলিশ দৌড়বাজ ইভা ক্লোবুকোস্কা (Ewa Klobukowska) পরে আর খেলার অনুমতি পাননি। কিন্তু এই পরীক্ষা অনেক সময়ে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিতে পারে না। বিষয়টায় যে হেতু ধোঁয়াশা অনেক, অনেক সময়ই সুরাহা হয় না, মাঝ থেকে মেয়েটিকে এমন নেতিবাচক প্রচারে আসতে হয় যাতে সে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দোহা এশিয়ান গেমস-এ (২০০৬) দৌড়ে রৌপ্যপদক জেতা শান্তি সৌন্দরাজন মেয়ে নয় বলে ‘প্রমাণিত’ হয়ে পদক হারান, ২০০৭ সালে আত্মহত্যার প্রচেষ্টা করেন। ধোঁয়াশার ব্যাপারটা পরিষ্কার ভাষায় জানা যায় আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নাল থেকে। এই সব কারণে ১৯৯৬ সালের আটলান্টা অলিম্পিকের পর থেকে বাধ্যতামূলক লিঙ্গপরীক্ষা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন শুধুমাত্র বিতর্ক উঠলে তবে এই পরীক্ষা নেওয়া হবে। মেয়ে খেলোয়াড়দের এই যে ‘পুরুষালি’ ভাব, তার কারণ হয়তো বা অ্যান্ড্রোজেন হরমোন। যদি কেউ জন্মের সময় মেয়ে বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে, তা হলে তাঁর দেহে এই হরমোন একটা সীমানার মধ্যে থাকলে আন্তর্জাতিক খেলায় তাঁকে মেয়ে বলে মেনে নেওয়া হবে লন্ডন অলিম্পিকে এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অ্যান্ড্রোজেন বেশি থাকে বলেই হয়তো বহু মেয়ে খেলায় সফল হন, তাই খেলার জীবন শেষ করে অস্ত্রোপচার করে পুরুষে পরিণত হন পূর্ব জার্মানির দৌড়বাজ হেইডি ক্রিগার বা জার্মানির পোল ভল্টার ইয়োভান বুশবম। লিঙ্গক্ষেত্রে সংশয় এখন খুব নিয়মিত বিষয়। বস্টনের শিশু হাসপাতালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম জেন্ডার ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস ক্লিনিকের ডাক্তার নর্মান স্প্যাক-এর অভিজ্ঞতা বলে যে প্রতি দশ হাজারে একটি শিশু এমন সংশয় নিয়ে জন্মায়।
পিঙ্কি তাঁর সঙ্গীকে ধর্ষণ বা শারীরিক হেনস্থা করলে আইন আইনের পথে চলুক, পিঙ্কি শাস্তি পান। কিন্তু পিঙ্কিরই যদি হেনস্থা হয়ে থাকে, তাঁর সাথী, সংশ্লিষ্ট ডাক্তার, পুলিশ বা হাসপাতালের কর্মীর হাতে, এঁদের সবাই কেন শাস্তি পাবেন না? স্বামীর অকালমৃত্যুতে তাঁর জায়গায় স্ত্রী চাকরি পেলে কি সেই বিধবা স্ত্রীর পুনর্বিবাহের অধিকার চলে যায়? মেয়ে খেলোয়াড় হিসেবে চাকরি পেয়ে থাকলেও আজ যদি তিনি খেলোয়াড় জীবনের শেষে লিঙ্গচিহ্নে আলো-আঁধারির মানুষ বলে প্রমাণিত হন, তা হলে কেন তাঁকে চাকরি খোয়াতে হবে? যত ক্ষণ না বিপরীত কিছু প্রমাণ হচ্ছে, তত ক্ষণ আইনের চোখে কেন তাঁকে মেয়ে বলে ধরে নেওয়া হবে না? কেন হবে এই অশোভন আচরণ?
মনে রাখি যেন দক্ষিণ আফ্রিকার চমক সৃষ্টিকারী দৌড়বাজ মেয়ে কাস্টার সেমেনিয়া (Caster Semenya) ২০০৯ সালের বার্লিনে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ৮০০ মিটার রেকর্ড সময়ে দৌড়লে তাঁর লিঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেই পরীক্ষা হয় জার্মানিতে। তাঁকে পরবর্তী সময়ে খেলতে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁর লিঙ্গপরীক্ষার ফল আজও জনসমক্ষে আনতে দেওয়া হয়নি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.