জাতীয় স্তরের এক মূক ও বধির অ্যাথলিটকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার নাম করে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত যুবক এক জন অটোচালক। নাম রণজিৎ দাস। তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। রবিবার রাতে ঘটনাটি ঘটেছে উত্তর দিনাজপুর জেলার হেমতাবাদ থানার বারুইবাড়ি এলাকায়।
সোমবার সকালে তরুণীর অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করে বিকেলে পুলিশ রণজিৎকে গ্রেফতার করে। তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয় রায়গঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রমাণ মিলেছে। মঙ্গলবার ধৃতকে রায়গঞ্জ আদালতে হাজির করানো হয়। কিন্তু, ধৃতকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার কোনও আবেদন করা হয়নি। রায়গঞ্জের মুখ্য বিচার বিভাগীয় আদালতের বিচারক অঞ্জনকুমার সেনগুপ্ত ধৃতকে ১৪ দিনের জন্য জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
এই ঘটনার পরে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, পুলিশ ধর্ষণের মামলা দায়ের করলেও অভিযুক্তের বাড়ি থেকে বিছানার চাদর, পোশাক কিছুই বাজেয়াপ্ত করেনি। ধৃতকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার আর্জি জানিয়ে জেরা করা কিংবা ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হয়নি কেন, তা নিয়েও বাসিন্দারা প্রশ্ন তুলেছেন। উত্তর দিনাজপুরের পুলিশ সুপার দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেছেন, “আমি জেলার বাইরে রয়েছি। কিন্তু, অভিযোগ হয়েছে শোনামাত্র অভিযুক্তকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছি। কেন পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার আবেদন করা হয়নি তা নিয়ে খোঁজখবর নেব। পরে যা বলার বলব।” |
তবে এই মামলায় অভিযুক্তকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার দরকার নেই বলে দাবি করেছেন হেমতাবাদ থানার ওসি অভিজিৎ দত্ত। তিনি বলেন, “হাসপাতালে তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রমাণ মিলেছে। সে জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার আবেদন করা হয়নি। পরে জেল হেফাজত থেকে নিয়ে ধৃতের ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হবে।” রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর সাধারণ সম্পাদক ও প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “ওই মেয়েটির পরিবার খুবই দুঃস্থ। মেয়েটির পড়াশোনা ও ক্রীড়াচর্চার সব রকম দায়িত্ব রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী গ্রহণ করেছে। কলকাতায় ই এম বাইপাসের হেলেন কেলার স্কুলে তাঁর পড়াশোনা ও ক্রীড়াচর্চার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে মেয়েটির পরিবারকে আর্থিক সাহায্যও করা হবে।” পুলিশ জানায়, ২২ বছর বয়সী ওই তরুণীর বাড়ি হেমতাবাদ থানার পূর্ব ইসলামপুর এলাকায়। তিনি স্থানীয় ভোগ্রাম হাইমাদ্রাসায় নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করেন। বর্তমানে তিনি সমাজকল্যাণ দফতরের অধীন রায়গঞ্জের একটি মূক-বধির আবাসিক হোমে খেলাধূলার প্রশিক্ষণ দেন। ২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ওই হোমের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত মাদুরাই, শিলিগুড়ি, ঝাড়খণ্ড, দিল্লি, বর্ধমান ও রায়গঞ্জে রাজ্য ও জাতীয় স্তরের বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে মোট ৩০টি সোনা ও ১৫টি রুপোর পদক পেয়েছেন। ক্রীড়াক্ষেত্রে তাঁর ধারাবাহিক সাফল্যের জেরে গত বছরের ৩ ডিসেম্বর রাজ্যের নারী ও সমাজকল্যাণ দফতর তাঁকে ‘২০১১ সালের রোল মডেল’ পুরস্কার দেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী হলে রাজ্যপাল তাঁর হাতে ওই পুরস্কার তুলে দেন।
পুলিশ জানায়, রবিবার দুপুরে মূক ও বধির ওই তরুণী রায়গঞ্জে খাতা কিনতে যান। সন্ধ্যায় তিনি শহরের শিলিগুড়ি মোড় এলাকায় গাড়ি ধরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেই সময় হেমতাবাদগামী একটি অটো সেখানে দাঁড়ালে তিনি তাতে উঠে পড়েন। অটোটি হেমতাবাদে পৌঁছলে ওই তরুণী ভাড়া দিতে গেলে চালক রণজিৎ বুঝতে পারে, ওই তরুণী মূক ও বধির। ঘটনাচক্রে সেই সময় প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়। রণজিৎ অটো থেকে সমস্ত যাত্রীকে নামিয়ে দিলেও ওই তরুণীকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার ইশারা করে গাড়িতেই বসে থাকতে বলে। এর পরে ফাঁকা অটোয় চাপিয়ে রণজিৎ তাঁকে নিয়ে যায় শালবাড়ি এলাকায়। সেখান থেকে হাঁটিয়ে তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। ওই যুবকের বাড়ির লোকজন কেউই ছিলেন না। এর পরে ওই তরুণীকে বাড়িতে আটকে তাঁকে একাধিকবার ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ। সোমবার সকালে ওই তরুণীকে বাড়ি থেকে বার করে দেয় রণজিৎ। তিনি কাঁদতে কাঁদতে এলাকার একটি রাস্তা দিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলে বাসিন্দাদের সন্দেহ হয়। কী হয়েছে জানতে চাইলে ওই তরুণী ইশারায় সমস্ত কিছু জানান। এর পর বাসিন্দারাই তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দেন। তাঁকে হেমতাবাদ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
পুলিশের পরামর্শে এর পর ওই তরুণী থানায় রণজিতের বিরুদ্ধে লিখিত ভাবে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করেন। ওই তরুণীর বাবা-মা ছাড়াও দুই বোন রয়েছে। ওই তরুণীর বাবা পেশায় দিনমজুর। তিনি বলেন, “আমার মেয়ের যে সর্বনাশ করেছে, পুলিশের কাছে তার কঠোর শাস্তি দাবি করেছি।” |