নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
সিঙ্গুর-আইন নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে তাঁর আলোচনার কথা প্রকাশ্যে বলে রাজ্যপাল ঠিক করেছেন কি না, তা নিয়ে এ বার সরকারি মহল থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সিঙ্গুর আইনকে ‘অসাংবিধানিক ও অবৈধ’ বলে রায় দেওয়ার পর রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন সোমবার বলেছিলেন, ওই বিলে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতি জরুরি নয় এমন পরামর্শই তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। সিঙ্গুর সংক্রান্ত পরামর্শ নিয়ে মঙ্গলবারও মুখ খুলেছেন রাজ্যপাল। বক্তব্যও এক। এ ভাবে সরকারের ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয় ‘জনসমক্ষে’ এনে ফেলায় ‘ক্ষুব্ধ’ সরকার এবং রাজ্যের প্রধান শাসকদলের নেতৃত্বের একাংশ।
তবে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের মন্তব্য নিয়ে রাজ্য সরকারের তরফে কেউই প্রকাশ্যে ‘বিরূপ’ প্রতিক্রিয়া জানাতে চাননি। তবে তৃণমূলের বেশ কিছু নেতার অভিমত, সরকার ও রাজ্যপালের মধ্যে কোনও আলোচনা বা কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ মতামত জনসমক্ষে আসা বেমানান। রাজ্যের বর্ষীয়ান মন্ত্রী এবং তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার মতে, “রাজ্যপাল এক জন পরিণত ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি নিজেও পণ্ডিত। ফলে, কেউ তাঁকে ভুল বোঝাবে, এটা হতে পারে না!”
প্রকাশ্যে রাজ্যপালের মন্তব্য করা সমীচীন কি না, তার সঙ্গেই প্রশাসনিক মহল থেকে আরও বলা হচ্ছে, যে কোনও আইনি পরামর্শ বা মতামতই কখনও ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ হয় না। সেই মতের ‘গ্রাহ্যতা’ নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট মামলায় বিচারপতি বিষয়টিকে কী ভাবে দেখবেন, তার উপরে। সিঙ্গুর আইন নিয়ে আইনি লড়াই-ই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় যা মনে করেছিলেন, বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষ ও মৃণালকান্তি চৌধুরীর ডিভিশন বেঞ্চ তার বিপরীত মত পোষণ করেছে। আইনি মতামতের এই ‘আপেক্ষিকতা’ মাথায় রাখলে রাজ্য সরকার ‘ভুল পরামর্শ’ই দিয়েছিল, এমন অবস্থানে আসা যায় কী ভাবে? সে জন্যই রাজ্যপাল যে ভাবে রাজ্য সরকারের ‘পরামর্শে’র দিকে প্রকাশ্যে আঙুল তুলেছেন, তার ‘যৌক্তিকতা’ নিয়ে প্রশাসনিক মহলের একাংশে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
পাশাপাশিই, প্রশাসনিক মহলের একাংশ এমনও মনে করছে যে, রাজ্যপাল চাইলে তাঁর এক্তিয়ারের মধ্যে থেকেই অন্য আইনবিদদের কাছ থেকে মতামত নিতে পারতেন। সিঙ্গুরে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতার অবস্থানের সময় জমি ফেরানোর উপায় নিয়ে মতামত জানার জন্য তদানীন্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী যেমন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়কে রাজভবনে ডেকে আলোচনা করেছিলেন। সিঙ্গুর আইন নিয়ে রাজ্য সরকারের দেওয়া পরামর্শে ‘সংশয়’ থেকে থাকলে এই রাজ্যপাল তেমন কোনও পদক্ষেপ কেন করলেন না, সেই প্রশ্নও আছে।
মুখ্যমন্ত্রী তো বটেই, রাজ্যের অধিকাংশ মন্ত্রীই (আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক-সহ) রাজ্যপাল-সংক্রান্ত মন্তব্য এড়িয়ে গিয়েছেন। শুধু পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এক প্রশ্নের জবাবে প্রথমে বলেছিলেন, “রাজ্যপাল আমাকে বলে তো কিছু বলেননি! আমরা সমস্ত বিষয়টি নজরে রাখছি।” তারপর ঈষৎ রসিকতার সুরে বলেন, “আমি রাজ্যপালের কথা শুনিনি! রাজ্যপাল এমন কথা বলতেই পারেন না! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, উনি বলেননি। কারণ কোনও সচেতন লোক এটা করতে পারেন না!”
সুব্রতবাবুর কথা থেকে স্পষ্ট, রাজ্যপালের বক্তব্যে এখনও ‘অস্বস্তি’তে সরকার। বস্তুত, রাজ্যপালের বক্তব্য নিয়ে সরকারকে নতুন করে বিরোধীদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। সুব্রতবাবুর বক্তব্যের পাল্টা যেমন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “উনি (সুব্রতবাবু) ঠিক শুনতে পেয়েছেন। কিন্তু শুনলে অসুবিধা আছে বলে কান বন্ধ করে রেখেছেন!” সূর্যবাবুর আরও ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, “আমাদের কোনও সন্দেহ নেই রাজ্যপাল কী বলেছেন। সুব্রতবাবু শুনুন আর না-ই শুনুন! রাজ্যপাল বিচক্ষণ মানুষ। নইলে সরকার তাঁকে কী বুঝিয়েছে, সেটা বলে দিতে পারতেন না!”
প্রসঙ্গত, নারায়ণন এ দিনও সিঙ্গুর নিয়ে মুখ খুলেছেন। একটি অনুষ্ঠানের ফাঁকে তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, রাজ্য সরকার বলছে, তারা তাঁকে ‘ঠিক পরামর্শ’ই দিয়েছিল। তিনি কী বলবেন? রাজ্যপালের জবাব, “ঠিকই তো। সেই জন্যই আমি তাদের সঙ্গে একমত হয়েছিলাম।”
তবে তৃণমূলের আইনজীবী-সাংসদ এবং সিঙ্গুর-মামলার অন্যতম আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যপালের বক্তব্য নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর কথায়, “রাজ্যপাল তো সিঙ্গুর বিলটি বুঝে নিতেই রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেলকে রাজভবনে ডেকে পাঠিয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট আলোচনা করেছিলেন। বিলটির নানা দিক নিয়ে অ্যাডভোকেট জেনারেল তাঁকে বুঝিয়েছিলেন। রাজ্যপাল বুঝেই বিলে সই করেছিলেন। না-বুঝে তো করেননি। এখন এ সব বলে কী লাভ (অ্যাডভোকেট জেনারেল অনিন্দ্য মিত্র আপাতত নার্সিং হোমে ভর্তি থাকায় এই বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি)!” পাশাপাশিই নারায়ণনের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার প্রশংসা করে কল্যাণবাবু বলেছেন, “রাজ্যপাল অত্যন্ত বিচক্ষণ ও শিক্ষিত মানুষ এবং দেশের সমাদৃত আমলা। ওঁকে তো ভুল বুঝিয়ে কিছু করা যায় না!” প্রকাশ্যে না-বললেও দলীয় মহলে কল্যাণবাবু বলেছেন, কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ রাজ্য সরকারের পক্ষে রায় দেওয়ার সময় তো রাজ্যপাল বলেননি, তাঁকে ‘ভুল বুঝিয়ে’ সই করানো হয়েছিল!
রাজ্য সরকার আপাতত সুপ্রিম কোর্টে মামলা লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কল্যাণবাবু জানিয়েছেন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ-আইনজ্ঞদের সঙ্গে তাঁরা পরামর্শও করছেন। তাঁর বক্তব্য, “কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষের রায়ই আইনের শেষ কথা নয়!” |