প্রবন্ধ ২...
স্রেফ ‘খিচুড়ি সেন্টার’ নয়, অনেক কাজ করতে পারে ‘অঙ্গনওয়াড়ি’
কটু জল পাওয়া যাবে?’ জল আসতে মিনিট পাঁচ-সাত লাগল। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী একটা গ্লাস থেকে আর একটাতে ঢালতে ঢালতে এমন ভাবে আনলেন, মনে হল সরবত বানিয়ে আনছেন। প্রথম জ্যৈষ্ঠের বেলা এগারোটা, সরবতের কল্পনায় উৎফুল্ল মন গ্লাসে চুমুক দিয়ে থ! সরবত কোথায়? এ তো গরম জল! এই গরমে উষ্ণ জল, এ কেমন রসিকতা?
রসিকতা নয়। তামিলনাড়ুর প্রতিটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে বাচ্চাদের ফোটানো জল দেওয়াটাই রীতি। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাও সেটাই খান নিজেরা বাড়ি থেকে জল আনেন না। ‘বাচ্চারা তো আমাদের দেখেই শেখে,’ বললেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী লতা। ‘কিছুক্ষণ আগে ফোটানো হয়েছে, একটু পরে ঠান্ডা হয়ে যাবে’, লতার স্মিত হাসি।
অঙ্গনওয়াড়িটি আরাসন কুলি গ্রামে, কন্যাকুমারী জেলার ভূতপণ্ডি পঞ্চায়েতে। টাউন পঞ্চায়েত হল বড় গ্রাম পঞ্চায়েত। কেন্দ্রে একটা হলঘর; বাচ্চাদের ছোট ছোট চেয়ার; কর্মীর চেয়ার টেবিল, কাগজপত্র রাখার জন্য লোহার আলমারি; রান্নাঘরে গ্যাসের উনুন, তার পাশে স্টোর রুম চাল, ডাল ও অন্যান্য সামগ্রী রাখার জন্য, দেওয়াল জোড়া প্রচুর রঙিন ছবি, বাচ্চাদের খেলবার রকমারি সরঞ্জাম, সামনে এক চিলতে মাঠ। সকাল আটটায় খুলে যায় কেন্দ্র সাড়ে দশটা পর্যন্ত তার কাজ তিন বছর পর্যন্ত বাচ্চা ও গর্ভবতী ও প্রসূতি মা’দের খাবার দেওয়া এবং অন্যান্য পরিষেবা। এগারোটা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটে পর্যন্ত ‘ইস্কুল’ তিন থেকে ছ’বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের। তারা সারাদিন খেলে, নাচে-গায়, খানিক লেখাপড়াও করে। গরিব-বড়লোক নির্বিশেষে সব বাড়ির বাচ্চাই আসে।
লতাও শৈশবে এই অঙ্গনওয়াড়িতে আসতেন। ‘তখন অবশ্য এত কিছু ছিল না। এত সাজ-সরঞ্জাম, কর্মী-সহায়িকাদের তুলনামূলক ভাল বেতন ও চাকরির সুরক্ষা, সারাদিন কেন্দ্র খোলা রাখা, পুষ্টির জন্য এত বরাদ্দ, এ সব ধাপে ধাপে হয়েছে।’
অন্য ছবি। অঙ্গনওয়াড়ি। মার্তাল গ্রাম, তামিলনাড়ু। ২০১২
‘আপনার বাচ্চাও এখানে আসে?’
‘আসত। এখন বড় হয়ে গেছে, ইস্কুলে যায়। আমাদের এখানে এমন বাচ্চা প্রায় নেই যে অঙ্গনওয়াড়িতে যায়নি।’
পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গনওয়াড়িগুলোর কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে গেলাম মাইল দেড়েক দূরের মার্তাল গ্রামে। কেন্দ্রটা আরও বড় বেশ লম্বা টানা হলঘর, সারসরঞ্জামও যেন বেশি। পৌঁছোই বেলা একটা নাগাদ। বাচ্চাদের খাবার সময়।
‘কী কী থাকে খাবারে?’
‘একটু খেয়ে দেখো।’ হাসতে হাসতে খানিকটা খিচুড়ি বাড়িয়ে দিলেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী জুলেখা। চাল, ডাল, আলু, গাজর, পেঁয়াজ মেশানো খাবারটা সুস্বাদু। বাচ্চাদের খেতে কোনও অনীহা দেখলাম না।
‘জুলেখা হাসিমুখে কাজ করে যাচ্ছে বটে, কিন্তু ওর কাজটাই সবচেয়ে কঠিন।’ বললেন সেভিয়ার এক জন প্রাথমিক শিক্ষক (কন্যাকুমারী গেছিলাম স্কুল টিচার ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া-র রাষ্ট্রীয় সম্মেলনে অতিথি হিসেবে। সংগঠকদের বলেকয়ে গ্রামে ঘোরার ব্যবস্থা। সঙ্গী, গাইড সেভিয়ার, বাহন তাঁর মোটরসাইকেল)।
‘জুলেখার কাজটা কঠিন কেন?’
‘ছুটি নেই। অঙ্গনওয়াড়ি খোলা সারা সপ্তাহ। শনি-রবি শুধু খাবার দেওয়া হয়, তাই কর্মীর ছুটি। কিন্তু সহায়িকাকে আসতে হয়। রান্না ও খাবার দেবার জন্য। যে সবচেয়ে নীচে থাকে, যার খাটনি যত বেশি, দুঃখও তত বেশি, সে টাকাও পায় তত কম।’
‘কত মাইনে?’
‘সাড়ে চার-পাঁচ হাজার; কর্মী পান সাড়ে ছয়-সাত হাজার। সরকারের এটা বাড়ানো উচিত। কী বিরাট দায়িত্ব ওদের! কিন্তু ওরা মেয়ে বলে সরকার ওদের এত কম টাকায় খাটায়। মিড-ডে-মিল রাঁধুনিকে দেখুন না বেতন মাত্র চার হাজার।’
হায়, আমাদের রাজ্যে এঁদের পারিশ্রমিক যদি জানতেন? এখানে তো মিড-ডে-মিল রাঁধুনি এক জন সহকারী পান যদি স্কুলে ৫০-এর বেশি বাচ্চা থাকে; সহকারীও দু’হাজার টাকা পান। আছেন তিন-চারটে স্কুল নিয়ে মিড-ডে-মিল সংগঠক, যাঁর বেতন পাঁচ হাজার। আর আমাদের পোড়া কপালে, গলদঘর্ম রাঁধুনি পান হাজার টাকা, তা-ও নিয়মিত না। সংগঠনের পুরো কাজ ‘মাস্টারের’!
সেভিয়ার জানালেন, তাঁদের সংগঠন তামিলনাড়ু প্রাইমারি টিচার্স ফেডারেশন এই সব প্রশ্নে আন্দোলন করছেন। প্রাথমিক শিক্ষকরা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, মিড-ডে-মিল রাঁধুনি নিয়ে চিন্তিত কেন? কারণ, খাদ্য ও পুষ্টি ব্যাপারটা সেখানে স্রেফ সুব্যবস্থিত মিড-ডে-মিল, অঙ্গনওয়াড়ি বা পরিবারপিছু বিনামূল্যে মাসে কুড়ি কিলো চাল দেওয়ার মতো সরকারি খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পেই সীমিত নেই। এটা নিয়ে লোকে ভাবে, খবর রাখে, কথা বলে।
ফেরার সময় সেভিয়ার এক জায়গায় দাঁড়ালেন রাস্তার ধারে দু’জন মহিলা তালের রস বিক্রি করছিলেন; প্রতি বোতল চল্লিশ টাকা। সেভিয়ার কিনলেন এক বোতল। তাড়ি ভ্রমে বিনয়ে প্রত্যাখ্যান করতে সেভিয়ার হাসতে হাসতে বললেন, ‘তাড়ি নয়, শুদ্ধ টাটকা রস।’ বাস্তবিকই তাই। আগ্রহে চটজলদি একটা হিসেব নিলাম: সারা দিনে একই গ্রামের দুই মহিলা হাজার বোতল রস বিক্রি করেন, অর্থাৎ এক এক মরসুমে দু’মাসের মরসুম একটা গ্রামে দৈনিক চল্লিশ হাজার টাকা ঢুকছে। যদিও তার বাঁটোয়ারাতে যারা সবচেয়ে বেশি খাটে, তারা সবচেয়ে কম পায়। কিন্তু অর্থনৈতিক সচলতার একটা ফল হিসেবে সবচেয়ে কম যারা পায়, তাদেরও আয় দিনে চার-সাড়ে চারশো টাকা। আর সেখানে, এই বাংলার মজুররা খাটতে যায় দিনে তিনশো টাকায়।
কৃষিতে বৈচিত্র আছে কলা, তুলো, ধান, ফুল বিভিন্ন নগদি ফসল একটা বিপর্যয়রোধী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। একটা ফেল হলে অন্যটা আছে (হিসেবটা সামগ্রিক অর্থে। ক-এর ফসল ফেল হলে তার ক্ষতিটা থাকছেই, কিন্তু যেহেতু ‘খ’ ‘গ’দের ফসলটা থাকছে, তাই গ্রামের মোট উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ কম)। কৃষি সমৃদ্ধি থেকে অন্যান্য সচলতা দৃষ্ট হয়, প্রচুর ইটভাটায়। কাছেই একটা ভাটা ছিল, সেখানে হিন্দি-বাংলা শুনে ঢুকলাম। সেভিয়ার বারণ করছিলেন, ভাটা-মালিকরা নাকি চায় না দেশান্তরী মজুররা অন্যদের সঙ্গে কথা বলুক। দেখা হল দক্ষিণ দিনাজপুরের একদল যুবকের সঙ্গে, যাঁরা স্থানীয় মজুরদের চেয়ে এক-দেড়শো টাকা কম মজুরিতে খাটেন। থাকেন নিচু, ঘুপচি ব্যারাকে। ‘অসুখ-বিসুখ হলে দেখার কেউ নেই, ডাক্তার দেখানোও সমস্যা ভাষা বলতে পারি না। গাঁয়ে এক-দেড়শো টাকা পেলেও কেউ আসত না। কিন্তু, আমাদের সরকারও নাকি ভিখারি। আমাদের জন্য কিছু করার নেই তার,’ বলতে বলতে ছেলেটির গলা ধরে আসছিল। সে গেল বছর হায়ার সেকেন্ডারি ফেল করেছে।
‘তোমাদের রাজ্যের কী অবস্থা?’ জিজ্ঞাসা করলেন সেভিয়ার। কী উত্তর দেব? আমাদের উদ্যোগহীনতা, অদূরদর্শিতা, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে শাসকীয় বৈরাগ্য এ সবের কথা তাঁকে বলি কী করে? কী করে বলি, আমাদের অঙ্গনওয়াড়ি মানে খিচুড়ি সেন্টার? সিডিপিও সুপারভাইজারদের অর্ধেকেরও বেশি পদে লোক নেই, সরবরাহ অনিয়মিত, চাল ডালের মান পশুখাদ্যের চেয়েও খারাপ, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর ঘাড়ে সার্ভে আর খাতা পূরণের বোঝা? কোন মুখে বলি, আমাদের শিশুদের বিপুল অংশ জন্মায় অপুষ্টি নিয়ে, বড় হয় অর্ধমানব হয়ে; অর্ধাসন, অনশন, রক্তাল্পতা এ রাজ্যের মায়েদের ‘স্বাভাবিক’ ভবিতব্য? আমরা কন্যাকুমারীতে বিবেকানন্দ শিলা দেখে যত গর্বিত হই, তার এক কণা বিস্ময়ও জাগে না তামিলনাড়ুর মানব সুরক্ষার বিরাট কর্মকাণ্ড দেখে এ কথা কোন মুখে স্বীকার করি সেভিয়ারের কাছে?
কথা ঘোরাই, ‘এখানে ‘তাড়ি’ বিক্রি হয় না? শুধু টাটকা রস?’
‘না, যে কোনও রকম দেশি সুরা বানানো বা বিক্রি করা বেআইনি। যত খুশি মদ খাও, কিন্তু লাইসেন্সড দোকান থেকে কিনে খাও।’
‘কেন?’
‘সরকারের শুধু আবগারি রাজস্ব বছরে আঠারো হাজার কোটি টাকা। এখানে মদের দামও বেশি। লোকে প্রচুর মদ খায়, কিন্তু তার জন্য সরকারকে টাকা দিতে হয়। মদ খেয়ে গাড়ি চালালে স্পট ফাইন দু’হাজার টাকা,’ সেভিয়ার হাসতে হাসতে বলেন।
সেভিয়ারকে বলা যায়নি, আমাদের রাজ্যে মদ থেকে সরকারের আয় তো দূর, লোকে মদ খেয়ে মরলে লাখ-লাখ টাকা মুআব্জা ঘোষণা হয়।
করুণানিধি বা জয়ললিতা যিনিই মুখ্যমন্ত্রী থাকুন তামিলনাড়ু রাজ্য সরকার সামাজিক খাতে যে টাকা খরচ করে, তার জোগাড় কোথা থেকে হচ্ছে, সে সম্পর্কেও যে সেভিয়ার-এর মতো ‘প্রাইমারি মাস্টার’ ওয়াকিবহাল। কারণ, এখানে এই সুরক্ষার ব্যাপারটা লোকেদের সংস্কৃতির অঙ্গ। অঙ্গনওয়াড়ির গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে সেভিয়ার বলছিলেন, ‘সিরো-ডু-সিক্সে, ইডিজ-দি-বেজ্।’ ছয় বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চারাই হচ্ছে ভিত্তি, সেভিয়ারের তামিল ইংরাজি থেকে এটা উদ্ধার করতে কয়েক মুহূর্ত লাগেনি তা নয়। কিন্তু ‘কুইনস ইংলিশ’ জানা গর্বিত বাঙালি নানাবিধ ইংরাজিতে এত স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠতে পারলেও, তামিল ইংরাজিতে বলা সহজ কথাটা তাঁদের কাছে কেন এত দুর্বোধ্য, সেটাই বোঝা মুশকিল। এবং সেটাই পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্যের অন্যতম কারণ।

লেখক প্রতীচী ট্রাস্ট-এ কর্মরত। মতামত ব্যক্তিগত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.