প্রবন্ধ ১...
ডিলার যা দেবেন, গরিবের রেশন বরাদ্দ ততটুকুই
রুন, আপনার বাড়িতে প্রতি মাসে এক জন চুপিসাড়ে ঢোকে এবং এক বস্তা চাল নিয়ে যায়। কেমন লাগবে আপনার? আপনি নিশ্চয়ই তক্কে তক্কে থাকবেন এবং চোরটিকে পাকড়াও করার চেষ্টা করবেন! অথচ, পশ্চিমবঙ্গে গরিব মানুষের জন্য বরাদ্দ চালের একটা বড় অংশ নিয়মিত লোপাট হচ্ছে, কারও ভ্রূক্ষেপ নেই!
জাতীয় নমুনা সমীক্ষার (এন এস এস) হিসেব অনুযায়ী, ভারতের অন্য যে কোনও রাজ্যের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা কম। ১৯৯৩-৯৪ সালে সারা দেশে গড়পড়তা ৫ শতাংশ পরিবারের মানুষ জানিয়েছিলেন, তাঁরা সারা বছর নিয়মিত দু’বেলা খাবার পান না; পশ্চিমবঙ্গে এই অনুপাত ছিল ১৪ শতাংশ। এক দশক পরে, ২০০৪-০৫ সালের সমীক্ষায় দেখা গেল, সর্বভারতীয় গড় অনুপাত নেমে এসেছে ২.৫ শতাংশে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সে অনুপাত তখনও ১২ শতাংশ। তালিকায় দু’নম্বরে ছিল ওড়িশা, তার অনুপাত ৫.৯ শতাংশ, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেকেরও কম।২০০৫-০৬ সালে জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষায় অপুষ্টির যে পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছে, তা-ও কম উদ্বেগজনক নয়। শিশুদের বয়সের অনুপাতে উচ্চতা কম হলে সেটা অপুষ্টির একটা লক্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে এমন খর্বকায় শিশুর অনুপাত ছিল ৬৯ শতাংশ, দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বিহারের (৫৬ শতাংশ) চেয়ে দশ শতাংশ-বিন্দুরও বেশি ওপরে, ওড়িশার (৪৫) চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ-বিন্দু বেশি।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই পশ্চিমবঙ্গে সরকারি খাদ্য বণ্টন ব্যবস্থা (পি ডি এস) এবং বিভিন্ন পুষ্টি প্রকল্পের বেহাল অবস্থার দিকে নজর দেওয়া দরকার। কয়েক মাস আগে বীরভূমে বোলপুরের কাছে একটি গ্রামে পি ডি এস কেমন চলছে, দেখতে গিয়েছিলাম। ওই এক দিনের অভিজ্ঞতা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। বেশির ভাগ মানুষ জানেনই না, পি ডি এস-এ কতটা চাল তাঁদের প্রাপ্য। স্থানীয় ডিলার যা দিচ্ছেন, সেটাই তাঁরা নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের রেশন কার্ড আছে, কিন্তু যাঁরা নতুন কার্ড পেয়েছেন তাঁদের বাদ দিলে বেশির ভাগেরই কার্ডগুলি শতচ্ছিন্ন, কিছুই পড়া যায় না। তা ছাড়া, মনে হল, রেশন কার্ড যে ভাবে দেওয়া হয়েছে তারও কোনও নিয়ম বা যৌক্তিকতা নেই। এবং, কার্ডগুলি ব্যক্তিভিত্তিক, পরিবারভিত্তিক নয়। তাতে এমনিতে কোনও ক্ষতি নেই, কিন্তু দেখে আশ্চর্য হলাম একই পরিবারের এক জনের হাতে এ পি এল কার্ড, আর এক জনের হাতে বি পি এল, আবার সেই পরিবারেরই অন্য এক জনের হাতে হয়তো অন্ত্যোদয় কার্ড! আরও চিন্তার কারণ হল, অনেক পরিবারের কোনও কার্ডই নেই।
প্রতিবাদ। রেশন বণ্টনে দুর্নীতি। মানবাজার, পুরুলিয়া। ২০০৯। ছবি: প্রদীপ মাহাতো
স্থানীয় ডিলার যে এই অবস্থার পুরোপুরি সুযোগ নেবেন, সে আর বিচিত্র কী? তাঁকে খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধে হল না চার পাশে মাটির বাড়ির মধ্যে তাঁর দোতলা পাকা বাড়িটি সহজেই চোখে পড়ে। নাদুসনুদুস মানুষটি, গলায় পৈতে, এমনিতে দিব্যি হাসিখুশি, তবে তাঁর রেজিস্টারটি এক বার দেখতে চাইলে অমায়িক ভাবে ‘না’ বলে দিলেন। রেশন দোকানের বাইরে কোনও বোর্ড টাঙানো নেই। বোঝাই গেল, ইনস্পেক্টর আসবেন, তদারকি করবেন, এমন কোনও ভয়ই নেই তাঁর। তিনি আমাকে জানালেন, সাতাশ বছর এই দোকান চালাচ্ছেন। আগে সি পি এমকে সমর্থন করতেন, এখন করেন তৃণমূলকে। তিনি যে চুরি করে ফাঁক করে দিচ্ছেন, গ্রামের মানুষ সেটা বিলক্ষণ জানেন, কিন্তু তাঁরা নিরুপায়।
আর একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম। সাম্প্রতিক কালে অন্য নানা রাজ্যের সরকার পি ডি এস-এর পদ্ধতিতে কিছু কিছু সংস্কার আনার ফলে ভাল কাজ হয়েছে, এখানে সে সব কিছুই হয়নি, তার কোনও চেষ্টাই করা হয়নি। দেখে মনে হল, গোটা ব্যবস্থাটাই মান্ধাতার আমলের। স্থানীয় ডিলার সব কিছু চালাবে, সে যা দেবে, লোকে চুপচাপ তা-ই নিয়ে যাবে।
মাত্র একটা গ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে কোনও সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছনো কঠিন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে পি ডি এস-এর বেহাল অবস্থার যে ছবি পাওয়া যায়, আমার অভিজ্ঞতা তার সঙ্গে মিলে যায়। যেমন ধরা যাক ‘লিকেজ’ বা লোপাট খাবারের পরিমাণ। এই পরিমাণ কী ভাবে হিসেব করা হয়? এক দিকে থাকে পি ডি এস-এর জন্য কত খাদ্য বরাদ্দ হয়েছে তার সরকারি পরিসংখ্যান, অন্য দিকে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা থেকে জানা যায়, বিভিন্ন পরিবার পি ডি এস-এর খাদ্য কতটা পেয়েছেন। দুটোর মধ্যে যে ফারাক থাকে, সেটার ভিত্তিতেই ‘লিকেজ’ মাপা হয়। রীতিকা খেড়া’র করা একটি সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে এই ফারাকটা বিরাট ২০০৭-০৮ সালে ‘লিকেজ’ ছিল ৭৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা বিল (এন এফ এস বি) পশ্চিমবঙ্গের সামনে একটা সুযোগ এনে দিয়েছে পি ডি এস-এর গোটা ব্যবস্থাটাকে ঢেলে সাজার সুযোগ। যে ভাবে অন্য অনেক রাজ্য ইতিমধ্যেই এই ব্যবস্থাটিকে অনেকটা শক্তপোক্ত করে ফেলেছে, পশ্চিমবঙ্গও এই সুযোগে তেমনটা করে নিতে পারে। তবে সে জন্য রাজ্য সরকারের হাতে অনেকটা ক্ষমতা থাকা দরকার। নিজের নিজের রাজ্যে পি ডি এস ব্যবস্থা কেমন হবে, সেটা ঠিক করার অধিকার রাজ্য সরকারের হাতে থাকা উচিত। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের বিলটি একেবারেই সন্তোষজনক নয়। এতে রাজ্যের এক্তিয়ারে নানা দিক থেকে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের বন্দোবস্ত আছে, আছে রাজ্যের ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা।
প্রথমত, কেন্দ্রের হাতে নিজের মত চাপিয়ে দেওয়ার অত্যধিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বিলটিতে। যেমন, আইনের বিভিন্ন অংশ কোনটি কখন কার্যকর হবে, খাদ্য সংক্রান্ত প্রকল্পের ব্যাপারে কী কী নির্দেশ মানতেই হবে, প্রকল্পের খরচের কতটা কেন্দ্র বহন করবে, কতটা রাজ্য, এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র। এই সব ক্ষমতা অপব্যবহার করা খুব সহজ। তা ছাড়া, এই সব প্রশ্নে কেন্দ্র ও রাজ্যের বিরোধ বাধলে আইনটি কার্যকর করা কঠিন হবে।
দ্বিতীয়ত, এই বিল অনুসারে, পি ডি এস সংস্কারের পথ বলে দেবে কেন্দ্র। অথচ, এই দায়িত্ব রাজ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়াই বিধেয়। যেমন, রাজ্য সরকারগুলিকে পি ডি এস-এর ‘প্রয়োজনীয় সংস্কার’ করতে হবে, এই প্রসঙ্গে বিলটিতে বলা হয়েছে, ‘খাদ্য-স্বত্ব বরাদ্দ করার বদলে’ রাজ্য সরকারগুলি দরিদ্রদের ‘নগদ অর্থ দেওয়ার মতো বিকল্প ব্যবস্থা’ করবে, এবং সেটা করতে হবে ‘কেন্দ্র যেমন নির্দেশ দেবে সেই অনুসারে’। এ তো রাজ্যের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপেরই আয়োজন। রাজ্যগুলিকে নিজের নিজের খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা গড়ে তোলায় সাহায্য করাই এই আইনের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল, খাদ্য নিরাপত্তার গোটা আয়োজনটাই কেন্দ্রীয় সরকার অধিগ্রহণ করে নেবে, এটা কাম্য ছিল না।
শেষ সমস্যা হল, খাদ্য নিরাপত্তার সুযোগ কাদের কাছে পৌঁছতে হবে, সেই ‘লক্ষ্যগোষ্ঠী’ নির্ধারণের ব্যাপারে এই বিলে খুব জটিল সূত্র তৈরি করা হয়েছে এবং সেই সূত্র প্রয়োগের দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের ওপর। সূত্রটির মূল কথা হল, সমস্ত পরিবারকে তিনটি বর্গে ভাগ করা হয়েছে: অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত, সাধারণ এবং বহির্ভূত। পি ডি এস-এর প্রধান সুবিধা পাবে প্রথম বর্গটি, দ্বিতীয় বর্গকে কিছু প্রতীকী সুবিধা দেওয়া হবে, তৃতীয় বর্গটি কিছুই পাবে না। কিন্তু কী ভাবে এই বর্গ তিনটিকে চিহ্নিত করা হবে, সেটা একেবারেই পরিষ্কার নয়। ধরে নেওয়া হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা অনুসারে রাজ্যগুলি এই কাজটি সম্পাদন করবে। কোন বর্গে পরিবারগুলিকে কী অনুপাতে স্থান দিতে হবে, সেটাও কেন্দ্র বলে দেবে। এমন আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে যে, গোটা প্রক্রিয়াটাই বিশৃঙ্খল হয়ে উঠবে এবং এই নিয়ে নানা বিরোধ দেখা দেবে। কেন্দ্রীয় সরকার সুস্পষ্ট এবং পরিচ্ছন্ন নির্দেশিকা তৈরি করতে পারেনি। ফল ভুগতে হবে রাজ্যকে।
রাজ্য সরকারগুলির উচিত তাদের অধিকারে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের এই উদ্যোগকে প্রতিহত করা, ন্যায্য সীমার মধ্যে নিজস্ব পি ডি এস ব্যবস্থা নিজেরা গড়ে তোলার স্বাধীনতা দাবি করা। পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে এটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ রাজ্যে ক্ষুধার প্রকোপ খুবই প্রবল। তবে কী ভাবে রাজ্যের স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করা যায় এবং পি ডি এস-এর লুঠ বন্ধ করা যায়, সেটাই আসল চ্যালেঞ্জ।

অর্থনীতিবিদ, ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.