সম্পাদকীয় ১...
খিড়কি পথে নয়
রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল ৩৫ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির দণ্ড মকুব করিয়াছেন। রাষ্ট্রপতি আগ বাড়াইয়া এমন কাজ করেন না, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের লিখিত সুপারিশের ভিত্তিতেই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের মার্জনাভিক্ষার আবেদন মঞ্জুর করা হয়। রাষ্ট্রপতি ভবন হইতে এক লিখিত বিবৃতিতেও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ভূমিকা এবং রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক বাধ্যতার কথা জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে। ঘৃণ্যতম অপরাধীরাই সচরাচর আদালত কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। মৃত্যুদণ্ডের রায় নিম্ন আদালতে চূড়ান্ত হয় না, বিচারপতিরা সহসা চরম শাস্তির রায় দিতেও চাহেন না। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও অতিশয় নিকৃষ্ট ও জঘন্য শ্রেণির অপরাধীদের জন্যই এই শাস্তি ধার্য থাকে। এক বার সেই দণ্ডাদেশ ঘোষিত হইয়া গেলে রাষ্ট্রপতি যদি ‘নিজের বিবেচনা ও এক্তিয়ার’ বলে (অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পরামর্শে) তাহা মার্জনা করিয়া দেন, তবে সেটা কিন্তু বিচারবিভাগের ক্ষমতা, মর্যাদা ও বৈধতাকেই ক্ষুণ্ণ করে। বিচারপ্রক্রিয়া তথা দেশের সমগ্র আইনি ব্যবস্থাও আপন গুরুত্ব হারায়। গুরুত্ব হারায় গণতন্ত্র। এক দিন প্রভাতে ঘুম ভাঙিয়া রাজার মনে ফুর্তি হইলে তিনি সব খুনিকে মুক্তি দিয়া দিলেন কিংবা মন খারাপ থাকিলে সর্বপ্রথম যাহার মুখদর্শন করিলেন তাহাকেই শূলে চড়াইবার হুকুম দিলেন এমন স্বেচ্ছাচার মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রে মানানসই হইলেও আধুনিক গণতন্ত্রে নয়। সেখানে একটি বিচারব্যবস্থা থাকে, যাহা অপরাধের লঘু-গুরু বিচার করে। সেই বিচারের রায়কে শাসনবিভাগের মর্জিতে উল্টাইয়া দেওয়া কোনও গণতান্ত্রিক প্রবণতা নয়। রাষ্ট্রপতি তথা শাসনবিভাগের ‘মার্জনা’র অধিকারই থাকা উচিত নয়।
শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে প্রশ্ন থাকিতেই পারে। বিশ্বের বহু দেশ আর চরম শাস্তি অনুশীলন করে না। এই শাস্তি অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ হইতে বঞ্চিত করে, এই তর্ক সুবিদিত। প্রাণ দিবার ক্ষমতা যাহাদের নাই, তাহারা কেন প্রাণ হরণ করিবার অধিকারী হইবে, এমন তর্কও অপ্রাসঙ্গিক নয়। আবার মৃত্যুদণ্ডের মধ্যে অপরাধীর কৃতকর্মের প্রতি সমাজের প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার একটা নিহিত কামনা সক্রিয়, অথচ প্রতিশোধের অধিকার তো কেবল দত্তাপহারক ঈশ্বরের, মানুষের নয় এমন তর্ক বা যুক্তিও মৃত্যুদণ্ড রদের জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে। ভারতেও এই মর্মে বিতর্ক শুরু করা যাইতে পারে। বস্তুত, ভারত সরকার যে আর মৃত্যুদণ্ড দিতে চাহে না, এমন লক্ষণ একেবারে অনুপস্থিত নয়। বিচারপতিরা কেবল ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ অপরাধের ক্ষেত্রেই এই দণ্ডাদেশ দিয়া থাকেন। সে ক্ষেত্রেও সেই দণ্ডাদেশ কার্যকর করার নজির দেশে ক্রমেই হ্রাসমাণ। রাষ্ট্রপতির কাছে জীবনভিক্ষা চাহিয়া জমা-পড়া আবেদনের সংখ্যা নেহাত কম না হইলেও সেগুলির নিষ্পত্তির হার নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। ইহাতেই বুঝা যায়, দ্রুত ফাঁসির দড়িতে লটকাইয়া দিবার মধ্যযুগীয় প্রবণতা কমিতেছে। পরিবর্তে দণ্ডাদেশ অনন্ত কাল ঝুলাইয়া রাখিয়া অবশেষে তাহাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করার উপরেই সরকারের জোর বেশি।
কিন্তু মৃত্যুদণ্ড ফৌজদারি দণ্ডবিধি হইতে রদ করিতে হইলে খোলাখুলি ভাবে তাহা করা হউক। সে জন্য প্রকাশ্যে জাতীয় স্তরে বিতর্ক সূচিত হউক। রাষ্ট্রপতির মার্জনা মঞ্জুরের খিড়কি-দরজা দিয়া মৃত্যুদণ্ডের বন্দোবস্তটিকে এ ভাবে অস্তিত্বহীন করিয়া দেওয়া ঠিক নয়। অবাধ গণতন্ত্র সর্বদাই সকল বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা ও বিতর্ক দাবি করে। গণঘাতক ও ধর্ষকদের মতো অপরাধীদের চরম শাস্তি না দিবার সিদ্ধান্ত যদি ভারতীয় সমাজ গ্রহণ করিতে চায়, তবে সাহসের সহিত, কল্পনাশক্তির প্রয়োগে মতবিনিময়ের মাধ্যমে সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা চলুক। কিন্তু যত দিন তাহা না হইতেছে, তত দিন দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধীদের দণ্ডবিধানই বিধেয়, আইনের নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া রাষ্ট্রপতির প্রসাদে গুরুদণ্ড হইতে অব্যাহতি দেওয়ার রাজতন্ত্রী প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.