নর্থ ব্লকের সদর দরজা থেকে বেরিয়ে ডান দিকে বড়জোর একশো পা হাঁটলেই রাষ্ট্রপতি ভবন। অথচ এই দূরত্বটাকেই আজ আর ‘সামান্য’ মনে হচ্ছে না তাঁর। বরং তিনি ভাবছেন, এই পথ চলাটা তো সেই কবেই শুরু হয়ে গিয়েছিল! কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কাছে পদত্যাগপত্র পেশের কয়েক মুহূর্ত আগে প্রণব মুখোপাধ্যায় তাই বললেন, “যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই মিরিটি গ্রাম থেকে।” যেন দেখতে পেলেন মিরিটির সেই ছোট্ট ছেলেটাকে। যে ছেলেটা স্কুলে যাওয়ার সময়ে বইপত্রের সঙ্গে একটা গামছাও নিত। কারণ, স্কুলে যাতায়াতের পথে দু’টো খাল পেরোতে হত তাকে! বেশ কয়েকটা দশক পরে তারই সামনে আজ সামনে দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার সম্ভাবনা। “ওই যাত্রা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এ বার,” বলছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। |
ইউপিএ সরকারের দৃশ্যত আবেগহীন ‘চাণক্য’ই আজ ভীষণ ভাবাতুর। দিন-ক্ষণ-সাল হিসেব করে তুলে আনছিলেন রাজনৈতিক জীবনের নানা স্মরণীয় মুহূর্ত। যেমন, ’৬৯ সালে প্রথম বার রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে যে দিন শপথ নিয়েছিলেন, সে দিনই নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে নেমেছিলেন! আর আজ, অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রণববাবুর বিদায়-মুহূর্তে নর্থ ব্লকের করিডর উপচে ভিড়। শীর্ষ আমলা থেকে শুরু করে অধস্তন কর্মচারীরা পর্যন্ত তাঁকে বিদায় জানাতে সদর দরজা পর্যন্ত নেমে আসেন। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যাওয়ার আগে প্রণববাবু বলেন, “আমি নিজেও আজ আবেগ-আক্রান্ত হয়ে পড়ছি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কিছু হয়তো ভুল হয়েছে। সে জন্য মানুষ যেন ক্ষমা করেন। তবে যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা মানুষের ভাল করবে বলেই নিয়েছি।”
পুরোদস্তুর ‘বিদায় সংবর্ধনা’রই আবহ। কিন্তু আসলে তো রাজনৈতিক জীবনের সম্ভবত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায়। এবং যিনি জানেন, রাইসিনা হিলসে পৌঁছনোর লড়াই এখনও বাকি। বিশেষত নিজের রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল যখন তাঁর পাশে দাঁড়াচ্ছে না। তাই ৭ রেস কোর্স থেকে নিজের বাসভবনে ফিরে বৈঠক ডেকেছেন ইউপিএ-র রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী। তার পর গুরুদ্বার রেকাবগঞ্জ রোডে কংগ্রেসের ‘ওয়াররুমে’ আলোচনায় বসেছেন দলের রাজনৈতিক ম্যানেজারদের সঙ্গে। এর মধ্যে জেনে নিয়েছেন মহাকরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পূর্ণ অ্যাজিটক সাংমার বৈঠকে কী হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে আজকের দিনটা তাঁর কাছে কিছুটা ‘স্বস্তিদায়ক’। দুপুরে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নেতা বিমল গুরুঙ্গ। প্রণব শিবিরের দাবি, গুরুঙ্গরা ইউপিএ প্রার্থীকেই সমর্থন জানাবেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রণববাবুর মনোনয়ন পত্রে প্রস্তাবক হিসাবে আজ স্বাক্ষর করেন প্রধানমন্ত্রী। তার পর সদ্য-প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীকে একটি চিঠিতে জানান, “গত আট বছর ধরে আপনার মূল্যবান পরামর্শের জন্য এই সরকার গভীর ভাবে ঋণী। আমি ও আমার সতীর্থরা বহু বার আপনার পরামর্শে উপকৃত হয়েছি। আপনার অনুপস্থিতি ভীষণ ভাবে অনুভূত হবে।” লালু প্রসাদও আজ প্রস্তাবক হিসেবে প্রণববাবুর মনোনয়ন পত্রে স্বাক্ষর করেন। তার পর প্রণববাবুকে ফোনে শুভেচ্ছাও জানান। ভাঙা হিন্দিতে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রণববাবু বলেন, “মনোনয়নের দিন কোথাও যাবেন না কিন্তু। আমাকে জিতিয়ে যাবেন।” ইতিমধ্যে জেডিইউ নেতা শরদ যাদবও ফোনে জানিয়ে দেন, প্রণববাবুরই পাশে থাকবে তাঁদের দল।
কংগ্রেস সূত্রের খবর, আগামী পরশু মনোনয়ন পেশ করবেন প্রণববাবু। সে দিন ইউপিএ-র বাকি শরিকদেরও দিল্লিতে থাকতে বলা হয়েছে। আর তার পরই শুরু প্রণববাবুর নির্বাচনী সফর। সফরের শুরুটা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ থেকে হবে না। ৩০ তারিখ চেন্নাই যাবেন প্রণববাবু। কারণ, করুণানিধি তাঁকে আগেই ফোন করে এ ব্যাপারে অনুরোধ জানিয়ে রেখেছেন। সেই প্রসঙ্গে প্রণববাবু আজ বলেন, “ওঁর সঙ্গে আমার কি আজকের সম্পর্ক! প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে গেল।” সত্যিই, ‘পথ’টার শুরু যে আজকে নয়! |