বিদেশ সফর সেরে ফেরার পথে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আর্থিক সংস্কার হবে। বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে এসে বাণিজ্য ঘাটতি ও রাজকোষ ঘাটতিতে রাশ টানা হবে। স্থিতিশীল হবে টাকার দাম। আর্থিক বৃদ্ধির পথে ফিরবে দেশের অর্থনীতি। এ বার অর্থমন্ত্রী হিসেবে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করার পালা। আর তা করার জন্য পরিকাঠামোয় লগ্নিকেই সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছেন মনমোহন।
আজ অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে প্রণব মুখোপাধ্যায় পদত্যাগ করলেন। অর্থনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রীর হাতে অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব এল এমন একটা সময়ে যখন আর্থিক বৃদ্ধির হার ন’বছরে মধ্যে সব থেকে কম। গত কাল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দাওয়াইয়েও চাঙ্গা হয়নি শেয়ার বাজার। সরকারি সূত্রের বক্তব্য, ফলে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আরও কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকেই এ বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত হতে পারে।
চলতি মাসের শুরুতে পরিকাঠামো বিষয়ক মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন মনমোহন। পরিকাঠামো ক্ষেত্রের বড় প্রকল্পগুলি দ্রুত রূপায়ণ করার জন্য নজরদারি ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আজ থেকেই সেই ব্যবস্থা চালু করার কথা ঘোষণা করেছে অর্থ মন্ত্রক। বিনিয়োগের পরিমাণ হাজার কোটি টাকার বেশি, এমন সব সরকারি, যৌথ, এমনকী বেসরকারি প্রকল্পের দ্রুত রূপায়ণ চাইছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি পরিকাঠামো ক্ষেত্রে সহজে ঋণ দেওয়ার জন্য ন’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও আর্থিক সংস্থা এক জোট হয়ে একটি তহবিল তৈরি করেছে। তাতে প্রতিটি সংস্থা ১ হাজার কোটি টাকা করে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মনে করছেন, চলতি অর্থবর্ষে শুধু পরিকাঠামো ক্ষেত্রেই অন্তত ২ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রয়োজন। তা হলেই আর্থিক বৃদ্ধির হার ফের ৯%-এর কাছে পৌঁছনোর সম্ভাবনা তৈরি হবে। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় মনে করছে, শুধু সহজে ঋণ পাওয়ার বন্দোবস্ত করলেই হবে না। জমি অধিগ্রহণ সমস্যা, জ্বালানির অভাব এবং পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র পেতে দেরি হওয়াতেও অনেক পরিকাঠামো প্রকল্প আটকে রয়েছে। কয়লা খনি বণ্টন এবং জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন বিলের বিষয়েও দ্রুত এগোতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী জানেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে পাওয়াটা একান্ত জরুরি। শুধু দেশি নয়, বিদেশি লগ্নিকারীরাও আস্থা হারাচ্ছেন ভারতের অর্থনীতিতে। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে ভোডাফোন-হাচিসনের মতো বিদেশি সংস্থাগুলির মধ্যে চুক্তিতে কর বসানোর ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রকের কড়া মনোভাব। তার জেরে বিদেশি লগ্নিকারীরা পিছু হঠতে শুরু করায় প্রণববাবু নতুন নিয়ম চালু আগামী বছর পর্যন্ত পিছিয়ে দিয়েছেন। শিল্পমহল আশা করছে, প্রণববাবুর এই সিদ্ধান্ত মনমোহনের জমানায় পুরোপুরি প্রত্যাহার হবে।
সরকারের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তহীনতারও অভিযোগ তুলেছে দেশের শিল্পমহলের। টাকার পতন রুখতে নানা পথে বিদেশি বিনিয়োগ টানার চেষ্টা চলছে। কিন্তু খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত আটকে রয়েছে। বিমায় বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। দুই ক্ষেত্রেই বহুজাতিক সংস্থাগুলি বিপুল বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শরিকদের আপত্তিতেই খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ আটকে রয়েছে। সেখানে অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রণববাবুর সামনে যে সমস্যা ছিল, প্রধানমন্ত্রীর সামনেও একই সমস্যা থাকবে। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান প্রতীপ চৌধুরী আজ যুক্তি দিয়েছেন, শেয়ার বাজারে আরও বিনিয়োগের প্রয়োজন। রফতানি বাড়ানোর ক্ষমতাও তৈরি করতে হবে। অর্থনীতিবিদরা দাবি তুলছেন, শিল্পমহলকে ইতিবাচক বার্তা দিতে পেট্রোপণ্যে ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। ডিজেলের দামও আংশিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হোক। কিন্তু সেখানেও শরিকি সমস্যা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সরকারের তরফে বারবার দাবি করা হয়েছে, ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০১২ সালের অর্থনীতির অবস্থা অনেকটাই ভাল। তবু অর্থমন্ত্রী থাকার সময় সংস্কারের গতি ও সিদ্ধান্তহীনতা নিয়ে অভিযোগের মুখে বারবারই শরিকি বাধার কথা উঠে এসেছে প্রণববাবুর মুখে। অর্থ মন্ত্রকের হাল ধরে মনমোহনকে কী কী করতে হবে, তা সকলেরই জানা। অর্থমন্ত্রী হিসেবে নরসিংহ রাওয়ের জমানায় ‘ভেলকি’ দেখিয়েছিলেন তিনি। এ যাত্রায় শরিকি বাধা উজিয়ে কতটা এগোতে পারেন মনমোহন, সেটাই প্রশ্ন। রার চেষ্টা হচ্ছে।” |