মুখ্যমন্ত্রীকে ইঙ্গিত করে বিরোধী বামফ্রন্টের এক বিধায়কের কিছু মন্তব্য ঘিরে শুক্রবার ধুন্ধুমার বাধল বিধানসভায়! শাসক ও বিরোধী শিবিরের বিধায়কদের মধ্যে তুমুল বচসায় বেশ কিছু ক্ষণের পণ্ড হল বাজেট-বিতর্ক। তৃণমূলের কয়েক জন বিধায়ককে দেখা গেল জুতো হাতে বিরোধী বেঞ্চের দিকে তেড়ে যেতে! তাঁর কিছু মন্তব্য সভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশের পাশাপাশিই ফরওয়ার্ড ব্লকের বিধায়ক আলি ইমরান রাম্জ (ভিক্টর)-কে এ দিনের বাকি সময়ের জন্য বিধানসভা থেকে বহিষ্কার করলেন স্পিকার। যার প্রতিবাদে আবার এ দিন বাকি অধিবেশন বয়কট করল বামফ্রন্ট।
বাম শরিক ফ ব-র তরুণ বিধায়ক ভিক্টরের মন্তব্যে এর আগেও বিধানসভায় বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তবে এ দিনের ঘটনা সাম্প্রতিক কালের মধ্যে নজিরবিহীন! উত্তেজনার সূত্রপাত পুর-বাজেট নিয়ে আলোচনার সময় ভিক্টরের বক্তব্য নিয়ে। বাজেট আলোচনায় তৃণমূল বিধায়ক অর্জুন সিংহ বলেছিলেন, বাম আমলে পুর-উন্নয়নের টাকা লুটেপুটে নেওয়া হয়েছিল! তারই পাল্টা হিসাবে ভিক্টর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রসঙ্গ এনে তৃণমূল বিধায়কদের উদ্দেশে বলেন, কেন্দ্রের থেকে টাকা চেয়ে পাননি বলেই মুখ্যমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি পদে ইউপিএ-র প্রার্থীকে ভোট দিতে রাজি হচ্ছেন না! প্রবল প্রতিবাদ আসে তৃণমূল শিবির থেকে। উর্দুতে এর পরে ভিক্টর পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের উদ্দেশে বলেন, তিনি শুধু কলকাতার মন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর ‘পাল্লু’ (আঁচল) ধরে ঘুরে বেড়ান! আঁচল ছেড়ে বেরিয়ে বাকি রাজ্যে দেখুন, পুরসভাগুলি কী ভাবে চলছে! ফের উত্তেজিত হয়ে পড়ে তৃণমূল শিবির। প্রধান শাসক দলের তীব্র প্রতিবাদের মুখে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় ভিক্টরকে ‘সতর্ক’ করেন। তাঁর বক্তব্যের কিছু অংশ কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়ারও আশ্বাস দেন। |
বিধানসভা থেকে বেরিয়ে আসছেন আলি ইমরান রাম্জ। ছবি: সুমন বল্লভ। |
কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ফ ব বিধায়কের ভাষণে ক্রমাগত বাধা দিতে থাকেন তৃণমূল বিধায়করা। গোলমাল চরমে পৌঁছয় যখন ভিক্টর বলেন, গোটা কলকাতায় সাদা-নীল রং করা হচ্ছে। কারণ মুখ্যমন্ত্রী ওই রঙের হাওয়াই চটি পরেন! উর্দুতেই মন্তব্য করেন, তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা মুখ্যমন্ত্রীর পায়ের দিকেই তাকিয়ে থাকেন (প্রকৃত অর্থে, চরণ মাথায় রাখেন)। তাই ওই রং-টাই বাছা হয়েছে। ভিক্টরকে থামিয়ে তৃণমূল বিধায়কেরা ওয়েলে নেমে পড়েন। হাওড়া এবং পূর্ব মেদিনীপুরের কয়েক জন তৃণমূল বিধায়ককে জুতো হাতে বাম আসনের দিকে তেড়ে যেতে দেখা যায়। প্রায় ধস্তাধস্তি বাধে দু’পক্ষে। এর পর বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রস্তাব’ মেনে স্পিকার প্রথমে ভিক্টরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্যের মাঝপথেই তৃণমূল বিধায়কদের হইচইয়ের জেরে স্পিকার ঘোষণা করেন, ভিক্টরকে এ দিনের মতো বহিষ্কার করা হল। এমন শাস্তিমূলক সিদ্ধান্তের নজির সাম্প্রতিক কালে বিধানসভায় নেই। প্রসঙ্গত, গোলমালের সময় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র সভাকক্ষে ছিলেন না।
মন্ত্রী সুব্রতবাবু বলেন, “ভিক্টর এর আগে যখন ভাল ভাষণ দিয়েছেন, আমি গিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করার একটা প্রবণতা ওঁর মধ্যে তৈরি হয়েছে। স্পিকারও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে এটা বেড়ে চলেছে। ভুল হয়ে থাকলে বিধানসভায় তা মেনে নিতে কোনও লজ্জা নেই। উনি হয় নিঃশর্তে ক্ষমা চেয়ে নিন। নইলে আমরা সরকার পক্ষ থেকে ওঁকে বহিষ্কার করার প্রস্তাব দেব।” এর আগেই সভার মধ্যে ফোনে কথা বলায় সুব্রতবাবুর মোবাইল জমা নেন স্পিকার। তা-ও উল্লেখ করে সুব্রতবাবু বলেন, তাঁরও ‘ভুল’ হয়েছিল বলে তিনি মেনে নিচ্ছেন।
স্পিকারের নির্দেশে ভিক্টর ব্যাখ্যা দিতে উঠলেও শাসক বেঞ্চের হইচইয়ে তাঁর বক্তব্য শেষ হয়নি। সূর্যবাবু তখন সভাকক্ষে এসেছেন। তিনি স্পিকারের ‘পক্ষপাতমূলক আচরণে’র প্রতিবাদ করে বাম বিধায়কদের নিয়ে ওয়াকআউট করেন। পরে ভিক্টর বলেন, “আমি উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর মহকুমা থেকে নির্বাচিত। সেখানে উর্দু অন্যতম প্রধান ভাষা। বাংলার চেয়ে উর্দুতেই আমি স্বচ্ছন্দ। একটাও অসংসদীয় শব্দ বলিনি। অথচ আমার কথার ভুল ব্যাখ্যা করা হল। একই দিনে আমার কথা কার্যবিবরণী থেকে বাদ, আমাকে হুঁশিয়ারি এবং বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। একই কাজে তিন বার শাস্তি!” সূর্যবাবুর বক্তব্য, “সরকারের সহিষ্ণুতার অভাব বিধানসভার ভিতরে প্রকট হচ্ছে। রসিকতাও ওঁরা বুঝতে পরলেন না। পায়ের জুতো হাতে চলে এল! এর পর মাথায় উঠবে!” তাঁর প্রশ্ন, ভিক্টরের মন্তব্যে ‘প্ররোচনা’ থাকলে জুতো নিয়ে তেড়ে যাওয়া কি ‘প্ররোচনামূলক’ নয়?
স্পিকার বিমানবাবু পরে বলেন, “আমি ওঁকে (ভিক্টর) সুযোগ দিয়েছিলাম। নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলে বহিষ্কার করতে হত না।” তাঁর আরও বক্তব্য, “দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদ হিসাবে সূর্যবাবুর ওঁকে সংযত হতে বলা উচিত ছিল। ওয়াকআউট করে বরং প্রশ্রয় দেওয়া হল।” সুব্রতবাবুরও বক্তব্য, “সূর্যবাবু ওঁকে সংশোধন না-করে সংসদীয় রীতি না-মানতে উস্কানি দিচ্ছেন। এই আচরণকে তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছি।” |