ছ’বছরের অপেক্ষা আরও দীর্ঘায়িত হল। সিঙ্গুরের চোখে জল।
শুক্রবার, কলকাতা হাইকোর্টের রায় শোনার পরে সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের একাংশ দৃশ্যতই ক্লান্ত, হতাশায় বিধ্বস্ত। হতাশার ইঙ্গিত অন্য অংশের অভিব্যক্তিতেও। তবে তাঁরা এখনও বুক বাঁধছেন এই আশায়, যে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে গেলে কোর্টের রায়েই জমি ফেরত পাবেন।
কলকাতা হাইকোর্টের রায় কী হয়, তা নিয়ে ক’দিন ধরেই জোর জল্পনা চলছিল সিঙ্গুরের আনাচেকানাচে। ‘অনিচ্ছুকেরা’ আশা করেছিলেন, হাইকোর্টেই মামলার ফয়সালা হয়ে যাবে। হাতে আসবে হাতছাড়া জমি। শুক্রবারের রায় শুনে তাঁদের উপলব্ধি, জমি ‘বহু দূর’।
রায় শুনে চোখের জল বাধা মানছিল না বেড়াবেড়ি পূর্বপাড়ার শ্যামলী দাসের। জমি-আন্দোলনে জড়িয়ে স্বামী তারাপদ দাসের সঙ্গে হাজতবাসও করেছেন প্রৌঢ়া। বললেন, “যখন জোর করে আমাদের জমি নেওয়া হয়, তখন কি আদালতকে জানিয়ে নেওয়া হয়েছিল? তা হলে কেন আমরা আমাদের জমির অধিকার ফিরে পাব না?” শ্যামলীদেবীর প্রতিবেশী রেবতী মান্নার হতাশা, “আদালতের রায় বিপক্ষে গেল। কী যে করি!” পরনে শতছিদ্র কাপড়, উদাস চোখে টাটাদের পরিত্যক্ত কারখানার দিকে তাকিয়ে ছিলেন আর এক ‘অনিচ্ছুক’, বৃদ্ধা লক্ষ্মী মান্না। বিড়বিড় করছিলেন, “জমি গেল! সংসারটাও ভেঙে গেল! আর কি জোড়া লাগবে?” |
তবে এটাই সব নয়। খাসেরভেড়ির সুকুমার ঘোষ, উত্তর বাজেমিলিয়ার সমর লাঙল বা বেড়াবেড়ির পাঁচু মান্নারাও আছেন, যাঁরা আরও ধৈর্য ধরতে রাজি। সুকুমারবাবুর কথায়, “কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সঙ্গে কথা বলব। রাজ্য সরকার নিশ্চয়ই সুপ্রিম কোর্টে যাবে। আশা করছি, সুপ্রিম কোর্ট আমাদের পক্ষে রায় দেবে। এত দিন তো অপেক্ষা করলাম। দেখা যাক, কী হয়!” যাঁর ১১ কাঠা জমি গিয়েছে টাটাদের প্রকল্প এলাকায়, সেই সমরবাবু বলছেন, “দিদির (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) উপরে ভরসা রাখছি। দিদিই জমি ফেরতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিন। আদালতেই সমস্যার সমাধান হবে।” আর পাঁচ বিঘা জমি হারানো পাঁচুবাবুর সংযোজন, “এখনও সুপ্রিম কোর্ট রয়েছে। তারও উপরে ভগবান রয়েছেন। আশা করছি, একটা কিছু সমাধান-সূত্র বেরোবে।” অনিচ্ছুকদের বুক বাঁধার পক্ষে আর একটা যুক্তি, “রায় যদি রাজ্যের পক্ষে যেত, টাটারা কি ছেড়ে দিতেন? ওঁরা সুপ্রিম কোর্টে গেলেও হরেদরে ব্যাপারটা একই দাঁড়াত। জমি ফিরে পেতে সে-ই দেরিই তো হত।”
প্রশাসনিক হিসেবে, সিঙ্গুরে ‘অনিচ্ছুক’ জমিদাতার সংখ্যা প্রায় ২,৪০০। তাঁদের মধ্যে অন্যতম আলোচিত নাম মনোরঞ্জন মালিক। ২০০৬-এ যাঁর মেয়ে তাপসীর অর্ধদগ্ধ দেহ মেলে টাটাদের প্রকল্প এলাকা থেকে। এই ঘটনায় রাজ্য-রাজনীতি তোলপাড় হয়। সেই মনোরঞ্জনবাবুও মনে করছেন, “এক দিন না এক দিন জমি ফেরত পাওয়া যাবে। একটু সময় লাগছে, এই যা। রাজ্য সরকার উচ্চ আদালতে যাবে। অনিচ্ছুকরা জমি ফিরে পেলে তাপসীর আত্মা শান্তি পাবে।”
আদালতের রায় তৃণমূল নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের বিপক্ষে গেলেও তা নিয়ে মন্তব্য করতে নারাজ এক সময়ে সিঙ্গুরের ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ সিপিএম নেতা তথা তাপসী-হত্যায় মূল অভিযুক্ত সুহৃদ দত্ত। তিনি বলেন, “আমার বিরুদ্ধে মামলা চলছে। দল এবং আইনজীবী মন্তব্য করতে বারণ করেছেন।” তবে মুখ্যমন্ত্রীর নাম না করে সিপিএমের হুগলি জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলেন, “রাজনৈতিক মুনাফার জন্যই সব কিছু করা হয়েছে। সিঙ্গুরে শিল্পের প্রতি, কৃষকদের প্রতি, অনিচ্ছুকদের প্রতি ওঁর দায়বদ্ধতা ছিল না। প্রথম থেকেই বামফ্রন্ট বলে এসেছে, যা হচ্ছে, তা পুরোটাই অসাংবিধানিক। কর্ণপাত করা হয়নি। যা হওয়ার তা-ই হল।”
অনেকটা একই বক্তব্য ‘ইচ্ছুক’ জমিদাতাদেরও। তাঁদের কথায়, “যা চলছে, তাতে সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এতে কারও ভাল হচ্ছে না।”
যদিও এখনই হাল ছাড়তে রাজি নয় তৃণমূল নেতৃত্বাধীন সিঙ্গুরের ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’। ২০০৬ সাল থেকে ‘অনিচ্ছুক’দের জমি ফেরতের দাবিতে তারা আন্দোলন করছে। বহু দিন পরে, এ দিন বিকেলেও জমি ফেরতের দাবিতে এবং আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কমিটির উদ্যোগে বড় মিছিল হয় সিঙ্গুরে। তাতে সিঙ্গুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের প্রতিমা দাস, জেলা পরিষদের তৃণমূল সদস্য করবী মান্না, মানিক দাস-সহ সামিল হন কয়েকশো মানুষ। মিছিলটি বেড়াবেড়ি বাজার থেকে বাজেমিলিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে শেষ হয়। মিছিল শেষে সভাও হয়। রাতে কামারকুণ্ডুতে তৃণমূলের পক্ষ থেকেও আলাদা ভাবে সভা হয়। উপস্থিত ছিলেন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়।
কৃষিজমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক তথা হরিপালের তৃণমূল বিধায়ক বেচারাম মান্না বলেন, “দিদি আন্দোলনে প্রথম থেকেই ছিলেন। পরবর্তী পদক্ষেপ তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেই ঠিক করা হবে। এর পরে আদালতের অন্য পর্যায়ও রয়েছে। সিঙ্গুরের মানুষ এখনই হাল ছেড়ে দেবেন না।” কমিটির অন্য নেতা তথা রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, “চাষিরা ছ’বছর অপেক্ষা করেছেন। প্রয়োজনে আরও ছ’মাস অপেক্ষা করবেন। চাষিদের সে কথা বোঝানো হয়েছে। আদালতে হার-জিৎ হতেই পারে।”
মন্ত্রী-নেতারা আশ্বাস দিচ্ছেন। সিঙ্গুর বুঝছে কি?
|
ছবি: প্রকাশ পাল, দেশকল্যাণ চৌধুরী |