‘এই সেই লাবণ্য? ফেমাস লাবণ্য? শি ইজ ফানি...!’ ‘মেন আর ফানি। তোমার দাদার উল্টোবুদ্ধিতে এই মেয়েটাকেই মনে হয়েছে এঞ্জেল!’
২০১২-র অভিজাত ক্লাবের নাকউঁচুদের ‘দ্য আদার ওম্যান’কে নিয়ে গুজগুজ ফুসফুস? নাকি নাইট ক্লাবের টিপিক্যাল মেয়েলি পাঁচফোড়ন?
জায়গাটা সামান্য আলাদা। লাইনগুলো রবীন্দ্রনাথের লেখা। ১৯২৮-এর লেখা। কিন্তু তাতে কী? গুলিয়ে যাচ্ছে তো ২০১২ বলেই! ‘এঞ্জেল’কে দেখে, শরীরে সারাক্ষণ ‘বিলিতি কৌলীন্যের ঝাঁঝালো এসেন্স’ বয়ে বেড়ানো কেটি মিত্তিরের ‘ভিমরুল-কামড়ানো’ ঠোঁটের টকটকে রং ততক্ষণে ফিকে হতে শুরু করেছে। ঘন চোখের তারা মেঘলা।
এ যেন জুন মাসে ফোটা গোলাপের মতোই দুর্মূল্য দৃশ্য!
নরম আঙুলে হোল্ডারের সিগারেট থম মেরে আছে। গুম মেরে যাওয়া পাইন, অর্কিড, ক্যামেলিয়া, আইভি, স্ন্যাপ ড্র্যাগন, ডেইজি-ঢাকা স্বপ্নে-মোড়া কটেজটার বারান্দার মতোই।
সেই বারান্দায় বসে কেটি, লিসি, সিসি।
শিরশিরে শিলং-য়ের আকাশ ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে মুখ লুকোল বলে।
হেঁটে আসছে ‘এঞ্জেল’। ধীরে। খুব ধীরে।
কাট। |
সরু জলপাই পাড়ের ঘিয়ে পশমিনা শাড়ি। সূক্ষ্ম হাতে-এমব্রয়ডারি করা ব্লাউজ। সরু সোনার চেন। কোমর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে কালো লম্বা বেণি। কানে মুক্তোর ফোঁটা। প্রশস্ত কপালে ছোট্ট কাজলের চুমু। হাতে একটা মাত্র সরু প্লেন বালা। নিবিড় চাহনি। লাবণ্য।
শুধু কেটি মিত্তির নয়। সেই মেঘকন্যা দেখে তামাম বাঙালির হোঁচট খাওয়ার জোগাড়!
লাবণ্যর আবছায়া মেখে হেঁটে আসছেন কঙ্কনা সেন শর্মা।
তাঁর অভিনয়ে মাত ‘শেষের কবিতা’র শিলং শ্যুটের পুরো ইউনিট। প্রতি টেকেই পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ের আওয়াজ, ‘ও কে। ভেরি নাইস’।
শিলংয়ের প্রায় মেঘলা দিনেও তিনি ধরা দিয়েছেন সেই রূপে - যাঁর সৌন্দর্য ‘সকাল-বেলার মতো, তাতে অস্পষ্টতার মোহ নেই, তার সমস্তটা বুদ্ধিতে পরিব্যাপ্ত’। সেই বুদ্ধির ছোঁয়া দিয়েই কঙ্কনা বলেন, “আই অ্যাম সো গ্ল্যাড দ্যাট লাবণ্য রিফিউসড অমিত! অমিতের ওই যে সব সময় নিজের মতো করে লাবণ্যকে পড়ে চলা, গড়ে চলা... উফ্ফ্! আমি ওরিজিন্যাল বইটা পড়িনি। স্ক্রিপ্টটা ভাল লেগেছে। কিন্তু অভিনয় করতে করতে লাবণ্যকে আবিষ্কার করছি একটু একটু করে। ওর চিন্তা, অনুভুতি এত ক্ষুরধার যে চমকে যেতে হয়। মেয়েটা কিন্তু বেশ দুষ্টুও। একটা দারুণ সূক্ষ্ম সেন্স-অফ-হিউমার আছে। যেটা দিয়ে মাঝে মাঝেই সে অমিতকে খোঁচা মারে। সব থেকে বড় কথা, আমি আগে এমন সব চরিত্র করেছি যারা নিজেদের ওপর খুব কর্কশ। সেই দিক দিয়ে এই চরিত্রটা স্বপ্নের মতো। সুমন আমাকে বলেছিল, চরিত্রটা ন্যাকা নয়। ব্যস। সেটাই আমার ব্রিফ ছিল। ‘ন্যাকা নয়’। আর টিমটাও তো দারুণ। সুমন, শীর্ষ (রায়), দেবজ্যেতি (মিশ্র)...।”
কাট।
এ বই না পড়েই ঝাঁপ? তাহলে চরিত্রটা এতটা ‘ইন্টারনালাইজ’ করলেন কী করে? “আসলে একটা পিরিয়ড ফিল্ম করার খুব লোভ ছিল। ‘ইতি মৃণালিনী’তে কিছুটা ছিল। কিন্তু এটা পুরোটাই পিরিয়ড।” মায়ের কাছ থেকে নিশ্চয় অনেক টিপস পেয়েছেন? “মা তো আমার থেকেও বেশি এক্সাইটেড! এই বইটার আর চরিত্রটার ওজন মা বুঝিয়েছেন। ইন ফ্যাক্ট, এখানে শ্যুটিং-এ এসেছিলেন। রাতে আমার ছেলে হারুণকে ঘুম পাড়াবার পর আমার সঙ্গে চরিত্রটা নিয়ে বসতেন। পরিপ্রেক্ষিত বোঝাতেন। অনেক খুঁটিনাটি আলোচনা করতাম।” কিন্তু কঙ্কনা কি ফিরিয়ে দিতে পারত অমিত রায়কে? “সব সম্পর্ক তো পরিণতি পাওয়ার নয়। থ্যাঙ্ক গড, লাবণ্য সেটা বুঝেছিল। আমার অবশ্য লাবণ্যর দূরদৃষ্টি নেই। তা ছাড়া লাবণ্যর রবীন্দ্রনাথ ছিল,” হাসতে হাসতে রক্ত-মাংস’র লাবণ্যর উত্তর।
কাট। |
লাবণ্যের পাশে হেঁটে আসছে বাঙালির থমকে যাওয়ার আরেক চরিত্র। অমিত রায়।
বইয়ের পাতায় যে ‘পাঁচজনের মধ্যে ও যে-কোনও একজন মাত্র নয়, ও হল একেবারে পঞ্চম, অন্যকে বাদ দিয়ে চোখে পড়ে...ইংরেজিতে যাকে বলে ডিসটিঙ্গুইশড্’। রাহুল বসু। ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবিতে উজ্জ্বল। চোখে স্ফুলিঙ্গ। কিন্তু এখানে অমিত নিজেই করুণ হোঁচট খাচ্ছেন। রাহুল বসুর ‘অমিত্রাক্ষর’ সঠিক উচ্চারণের পরের পর টেক নিতে নিতেই, ইউনিটের একজনের মন্তব্য, “পরিচালক আর চিত্র পরিচালকের অসীম ধৈর্য।” সুমন এবং শীর্ষ নির্বিকার।
রাহুল চরিত্র অনুযায়ী অনেক পাল্টেছেন নিজেকে। ব্যায়াম ছেড়ে দিয়েছেন। খাওয়া কমিয়েছেন। প্রচুর হাঁটছেন। চেহারায় নমনীয়তা স্পষ্ট। অমিত রায়ের দুর্দান্ত স্মার্টনেস রাহুলের আছে। রাগবি খেলেন। সিরিয়াস বিষয় নিয়ে পাবলিক ফোরামে মতামত রাখেন। সবই অমিতোচিত। বাঙালির মননের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়ানো একটা চরিত্র। যাকে সে ফেলুদার মতোই লম্বা-ছিপছিপে দেখে। রাহুলের উচ্চারণও না হয় ঠিক হয়ে যাবে। সাহেবিয়ানাও পার পেয়ে যাবে। কিন্তু বাঙালিয়ানা?
কঙ্কনা হাসতে হাসতে বললেন, “বেচারা রাহুল! দাঁত ভাঙতে ভাঙতে অস্থির।” একসঙ্গে এটা দু’জনের চার নম্বর ছবি। “রাহুল ইজ ফ্যামিলি। তা ছাড়া, ও আমার মায়ের খুব ভাল বন্ধু। আমাদের ‘কমফর্ট লেভেলটা’ খুব ভাল।”
কিন্তু রাহুল অমিত রায়ের চরিত্রে কতটা বিশ্বাস করেন? “করি না। সুমন করে। সেটাই যথেষ্ট। আমি শুধু চেষ্টা করছি কী ভাবে তার অন্যান্য খুঁটিনাটি দিকগুলো ভরা যায়। যেমন, সে কী ভাবে খায়?” ‘কর্তামা’ যোগমায়ার চরিত্র নিয়েও গোলমাল ছিল। রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, গার্গী রায়চৌধুরীর করবার কথা ছিল। শেষ পর্যম্ত করছেন তুলিকা বসু। খারাপ মানায়নি তাঁকে।
কাট।
শিলং। চেরাপুঞ্জি। ভোর সাতটা থেকে টানা রাত ন’টা-দশটা অবধি শ্যুটিং। কঙ্কনা-রাহুলকে এই টাইমলেস চরিত্রায়ণে ভাবলেন কেন? “প্রথম থেকেই ওদের কথাই মাথায় ছিল। তা ছাড়া ওরা থাকলে বাংলার বাইরেও ‘শেষের কবিতা’র একটা ইন্টারেস্ট তৈরি হবে। সেটা চেয়েছিলাম। তা ছাড়া ‘শেষের কবিতা’র ডায়নামিক্স তো এখনও একই ভাবে চলছে,” বলছেন সুমন।
রবীন্দ্রনাথ কেটি বা কেতকীকেও খুব যত্নে গড়েছেন। লাবণ্য আর অমিতকে একসঙ্গে দেখে যার সমস্ত হাই-ফ্যাশন বিলিতিপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে ‘এনামেল’ করা মুখের ওপর দরদর করে চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়ে। সে দৃশ্যের পর পর সাত বার টেক হল। কারণ অভিনয় নয়। দু’ চোখ দিয়ে কিছুতেই জল গড়াচ্ছে না! এক চোখ উথলে উঠে গাল ভরিয়ে দিচ্ছে। অন্যটা তেমনই গোঁয়ার। পরিচালকও ছাড়বেন না। শেষ পর্যন্ত হার মানল বাঁ চোখের জল! ‘এঞ্জেল’কে দেখে যার ঠোঁট কাঁপছিল সেই কেটি, অর্র্থাৎ স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের সাবলীল নাকউঁচু অভিনয় চরিত্রের সঙ্গে যেন মিশে গেছে। “উফ্ফ্, অমিতের মতো ছেলের জন্য এত চোখের জল ফেলা আমার পোষাচ্ছে না!” শটের শেষে বললেন। চোখে জল, ঠোঁটে হাসি।
কাট। |
কেটির সঙ্গে তাঁর নিজের জীবনে মনে হয় অনেক মিলই আছে? “হতে পারে। আমার জীবনটাই তো খোলা খাতা। অমিত খুব বোরিং। একটা মেয়ের দিকে আকৃষ্ট হয় সেই মেয়েটার গুণে। তার পর চায় মেয়েটি তার মতো করে চলুক। নিজের জীবনেও এ রকম পরিস্থিতির সঙ্গে কোনও দিন আপস করিনি। কিন্তু কেটিকে আমার বেশ লাগে। খুব ডায়নামিক। তার নিজের মধ্যে সব সময় একটা কনফ্লিক্ট চলে। কেঁদে ফেলেও ভাবে তার ফর্মাল বিলিতি সংস্কৃতিতে বেশি কাঁদা হয়ে গেল কি না।”
কাট।
পড়ন্ত বিকেলের কুয়াশা আস্তে আস্তে নেমে আসছে পাইন বনের গা ঘেঁষে। ঘাসের ভিজে গন্ধে ভরে যাচ্ছে চারপাশ। থামের গায়ে লতানে গাছের সাদা ছোট্ট ফুলগুলো আলোর ফুটকি। কটেজের বারান্দা নিশ্চুপ। লাবণ্য গায়ের চাদরটা অল্প টেনে নিল। মুখ তার ছায়াময়। বুকের ভেতর কষ্টটা পাকিয়ে উঠছে। পাশে অমিত। তাও কেন মন হুহু করে, ‘‘তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান; গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়। হে বন্ধু, বিদায়।” |