মতাদর্শের নিগড় নয়, রাজনৈতিক প্রয়োজন। ‘প্রকাশ কারাট’ হয়ে থাকা নয়, সিপিএমের ‘সাধারণ সম্পাদক’ হয়ে ওঠা।
রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের ভাবমূর্তি ভেঙে বেরিয়ে এলেন কারাট। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি বরাবরই মতাদর্শের ‘কপিবুক’ অবস্থান থেকে সিদ্ধান্ত নেন। তা সে দেড় দশক আগে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাবই হোক বা হালের পরমাণু চুক্তি। কিন্তু এ বার প্রণববাবুকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত কারাট নিলেন কোনও মতাদর্শের কথা ভেবে নয়, বরং রাজনৈতিক কৌশল ও বাস্তবতার কথা মাথায় রেখে।
১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেননি যাঁরা, সেই ব্রিগেডের অন্যতম সদস্য ছিলেন প্রকাশ কারাট। সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারে সে সময় হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ। জ্যোতিবাবুর ভাষায় সেটা ছিল দলের ‘ঐতিহাসিক ভুল’। কিন্তু তার পরেও কারাটরা একই রকম অনড় থেকে যান। নিজে দলের ভার নেওয়ার পর পরমাণু চুক্তি নিয়ে একই রকম কঠোর মতাদর্শগত অবস্থান নেন কারাট। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় স্পিকারের পদ ছাড়তে রাজি না হওয়ায় তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করতেও পিছপা হননি। এ বার কিন্তু তিনি অন্য পথে হাঁটলেন। গোটা দলকে নিজের পিছনে টেনে আনার বদলে কারাট নিজে দলের সঙ্গে হাঁটলেন।
কেন? বাম দুর্গ পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম এখন ক্ষমতাচ্যুত। জাতীয় রাজনীতিতেও দলের কোণঠাসা অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে কারাট বুঝতে পেরেছেন, হিন্দি বলয়ে এলাকা দখলের ‘অ্যাডভেঞ্চার’-এর থেকেও নিজেদের ‘বেস ক্যাম্প’ মজবুত করা জরুরি। তাই গত কালের পলিটব্যুরো বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নেতৃত্ব ও নিচুতলার কর্মীদের কথাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। পরমাণু চুক্তি বিতর্কে প্রথম ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সময় এই রাজ্যের নেতাদের মতই খারিজ করেছিলেন প্রকাশ। রাজনৈতিক বাস্তবতার থেকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন নীতির প্রশ্নকে। অথচ ইউপিএ-র উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের জেরে পশ্চিমবঙ্গে বামেদের রাজনৈতিক খেসারত দিতে হয়েছে, এমন নালিশ তাঁকে বহু বার শুনতে হয়েছে। কংগ্রেস ও তৃণমূলের জোট তৈরির পথ ওই ঘটনার ফলেই প্রশস্ত হয়েছে বলে অভিযোগ তাঁকে তাড়া করেছে।
এ বার কিন্তু প্রকাশ ঠিক উল্টো পথে হেঁটেছেন। রাষ্ট্রপতি ভোট নিয়ে কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে এমনিতেই ব্যবধান তৈরি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের সেই ফাটল আরও বাড়ানোর সুযোগ তিনি করে দিয়েছেন। পলিটব্যুরো বৈঠকে নিজে অনুপস্থিত থাকলেও প্রণববাবুকে সমর্থনের পক্ষে মত জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই মতকেই সমর্থন জানিয়েছেন প্রকাশ।
অথচ পলিটব্যুরোর বৈঠকে সকলেই যে প্রণবকে সমর্থনের সপক্ষে ছিলেন, তা নয়। কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও রকম সমঝোতায় না যাওয়ার দাবি প্রবল ভাবেই ছিল। কেরলের নেতারা তাঁদের রাজ্য রাজনীতির কথা ভেবে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার বিরোধী ছিলেন। তা ছাড়া কিছু দিন আগেই কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেসে ঠিক হয়েছে, কংগ্রেস ও বিজেপির থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখা হবে। এখন রাষ্ট্রপতি পদে কংগ্রেসের প্রার্থীকে সমর্থন করলে উল্টো পথে হাঁটা হবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণবকে সমর্থন করা মানে প্রকারান্তরে কেন্দ্রের উদার আর্থিক নীতির বিরোধিতা থেকে সরে আসা কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছিল। ভোটাভুটি হলে সমান দু’ভাগে ভাগ হয়ে যেত পলিটব্যুরো।
প্রকাশই বরং স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গি ছেড়ে প্রণবকে সমর্থনের সঙ্গে ইউপিএ-র আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে এক করে দেখতে রাজি হননি। দলের যে অংশ মনে করছিল উদার আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি লড়াই বজায় থাকুক, কিন্তু আশু রণকৌশল হিসেবে প্রণবকে সমর্থন করা হোক কারাট তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। কারণ প্রণববাবু কিন্তু মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া বা সি রঙ্গরাজন নন। বরং পরমাণু চুক্তি বিতর্ক চলাকালীন মনমোহন সিংহ বামেদের বোঝানোর দায়িত্ব প্রণব মুখোপাধ্যায়কেই দিয়েছিলেন। সে সময় এক বছর ধরে প্রকাশের সঙ্গে প্রণববাবুর নিয়মিত যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
এ বার প্রণববাবুর নাম ঘোষিত হওয়ার পরে লক্ষণীয় ভাবে প্রথমেই তাঁকে শুভেচ্ছা জানান বৃন্দা কারাট। তার পরে তিনি প্রকাশের সঙ্গে প্রণববাবুর কথা বলিয়ে দেন। প্রণববাবু নিজে তাঁকে সমর্থন করার জন্য সীতারাম ইয়েচুরির কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বিব্রত ইয়েচুরি বলেছেন, কৃতজ্ঞতার কিছু নেই। এমনিতেও প্রণব জিততেন। কিন্তু প্রণব জানিয়েছেন, বামেদের ভোট তাঁর কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ বামেরা এখনও গুরুত্বপূর্ণ শক্তি এবং তাঁদের ভোট হল ইউপিএ-র বিরোধী শিবিরের ভোট।
গত কালই সিপিআই নেতারা তাঁদের এক ‘ঐতিহাসিক ভুলে’র কথা টেনে এনেছিলেন। বলেছিলেন, জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গাঁধীতে সমর্থন করার সিদ্ধান্তের ‘বোঝা’ এখনও তাঁদের বইতে হচ্ছে। সেই ‘ভুল’-এর ছত্রচ্ছায়া থেকে বেরোতেই তাঁরা প্রণবকে সমর্থন করবেন না।
কারাটের কাছে বিষয়টা ঠিক উল্টো। ‘ঐতিহাসিক ভুলে’র পুনরাবৃত্তি না করতেই প্রণবকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত। ‘সাধারণ সম্পাদক’ সেই প্রয়োজনটাই বুঝেছেন। |