পুস্তক পরিচয় ১...
আন্দোলন মাটির কাছে পৌঁছয়নি
দ্য পলিটিক্স অব ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য গ্লোবাল ক্রাইসিস: মর্টগেজিং আওয়ার ফিউচার,
প্রফুল বিদোয়াই। ওরিয়েন্ট ব্ল্যাক সোয়ান, ৭৫০.০০
মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের তালিকায় ভারত পৃথিবীর মধ্যে ১৪৭ নম্বরে। আমেরিকা আর পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো সেই তালিকার একেবারে উপরের দিকে। ‘জলবায়ু পরিবর্তন’-এ দেশের ভূমিকা নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে যে কোনও আলোচনায় আমাদের নীতি নির্ধারকেরা স্বাভাবিক ভাবেই মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের ওই হিসেবটার ওপরেই বিশেষ জোর দেন। অথচ এর মধ্যে একটা চালাকি রয়েছে। আমাদের সমাজে অর্থনৈতিক অসাম্য এতটাই গভীর ও ব্যাপক যে সেখানে ধনীরা ব্যক্তিগত ভাবে যে পরিমাণ কার্বন তৈরি করে, একজন গরিব মানুষ তার এক দশমাংশও করে না। অর্থবানদের ভোগের বাড়বাড়ন্তের কারণেই এ দেশে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমণের হার দ্রুত বাড়ছে। মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের হার কম হলেও ভারত এখন মোট কার্বন নির্গমনের নিরিখে বিশ্বের চার নম্বর দেশ। প্রফুল বিদোয়াইয়ের বক্তব্য, মাথাপিছু কার্বন দূষণের তত্ত্ব খাড়া করে আমাদের দেশে বড়লোকেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষের পিছনে আড়াল খুঁজছেন। দেশের স্বল্প সংখ্যক ধনীর স্বাচ্ছন্দের জীবনযাপনের জন্য যে বিপুল পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি হচ্ছে তা বিপুল সংখ্যক হতদরিদ্র মানুষের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে তাঁরা নিজেদের দায় এড়াচ্ছেন। এই বইয়ে লেখক পরিবেশ নিয়ে এই রাজনীতির আড়ালগুলো সরিয়ে দিয়েছেন, আর ‘জলবায়ু পরিবর্তন’-এর মতো একটা বিষয়কে ন্যায্য ও নিরপেক্ষ ভাবে দেখার একটা দিশা দিয়েছেন।
লেখক জানাচ্ছেন, দেশের বেশিরভাগ শহরেই দূষণের মাত্রা ভয়ানক বেশি। যানবাহন থেকে বেরনো কার্বন, সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন আর সিসার গুঁড়ো প্রতিনিয়ত নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে ঢুকছে। শহরগুলোতে গাড়ির সংখ্যা ফি বছর ১৫ শতাংশেরও বেশি হারে বাড়ছে। তার ফলে রাস্তা যানজটে আটকে যাচ্ছে, পথচারী আর সাইকেল আরোহীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন (কলকাতাতেই ৩৮টি রাস্তায় সাইকেল চালানো নিষেধ), এবং পথ দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ১ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। অথচ স্বচ্ছল গাড়ি-মালিক এবং গাড়ি নির্মাতাদের খুশি রাখতে সরকার পার্কিং ফি বাড়ানো, গাড়ির গতিবিধির ওপর নিয়ন্ত্রণ বা দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি আরোপের দিকে হাঁটছে না। অন্য দিকে ব্যক্তিগত গাড়িতে অতি দূষণকারী ডিজেলের ব্যবহার বাড়ছে। প্রায় সব কোম্পানিরই বড় এবং দামি গাড়ির মডেলে ডিজেল ইঞ্জিনের বিকল্প থাকছে। ফলে একাধারে বিপুল ভর্তুকির ডিজেল ব্যক্তিগত গাড়িতে ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছেন ধনীরা। অন্যদিকে বায়ু দূষণ বাড়ছে।
কাঠ, কয়লা বা মাটির নিচের তেল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার ফলে তৈরি হয় কার্বন ডাইঅক্সাইড। কার্বন বায়ুমণ্ডলে থেকে যায় হাজার হাজার বছর। মূলত এই কার্বনের জন্যই গ্রিনহাউস গ্যাসের সৃষ্টি। গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবেই বিশ্বজুড়ে বায়ুমণ্ডল দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের পিছুপিছু এসেছে আবহাওয়া পরিবর্তন। বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য কোন দেশ কতটুকু দায়ী তাই নিয়ে বিশ্ব জুড়ে কাজিয়া।
‘জলবায়ু পরিবর্তন’-এর দায় ঝেড়ে ফেলার এই রাজনীতি চলছে বিশ্বজুড়ে। বায়ুমণ্ডলে কার্বনের হার কমিয়ে বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মেকাবিলায় দেশগুলোর দায় ও দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে তা রূপায়ণের জন্য কুড়ি বছর আগে রিও ডি জেনিরোয় রাষ্ট্রপুঞ্জের ব্যবস্থাপনায় প্রায় সব দেশের শীর্ষ সম্মেলনে যে চেষ্টা শুরু হয়েছিল গত বছর ডারবানের সম্মেলনেও তার নিষ্পত্তি হয়নি। তবে বিশ্বের বায়ুমণ্ডলের গড় উত্তাপ প্রাক-শিল্পায়ন মাত্রার থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না করার ব্যাপারে সব দেশ একমত হয়েছে। এর বেশি তাপমাত্রা বায়ুমণ্ডল সহ্য করতে পারবে না (বর্তমানে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন মাত্রার থেকে ০.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি)। তবে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বেঁধে রাখার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এবং বিশ্বের দেশগুলো ধীরে ধীরে ঐকমত্যে পৌঁছচ্ছে। কিন্তু এখন কার্বন নির্গমনের যে মাত্রা তাতে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিশ্বের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন মাত্রার থেকে ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি, এমনকী ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি হয়ে যেতে পারে। বলাই বাহুল্য, তার জন্য যে ভয়াবহ দুর্ভোগ তা মানুষকেই ভুগতে হবে।
জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি কাজ। আজকেই যদি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন থামিয়ে যেওয়া যায় তা হলেও বায়ুমণ্ডলে জমে থাকা কার্বন ডাইঅক্সাইড কমবে অতি ধীরে। কারণ ওই গ্যাস বায়ুমণ্ডলে হাজার হাজার বছর থেকে যায়। কার্বন নির্গমন অবশ্যই কমাতে হবে, এখনই। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাজিয়ায় শেষপর্যন্ত কোনও আম্তর্জাতিক পরিবেশ সম্মেলনই ঐকমত্যে পৌঁছয় না। মূলত ধনী দেশগুলো সিংহভাগ গ্রিনহাউস গ্যাসের জন্য দায়ী হলেও তাদের অনেকেই দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দে বা বিলাসিতায় কোনও আপস করতে রাজি নয়। আর দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কার্যকর করার জন্য ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে অর্থবরাদ্দ চায়। খানিকটা খেসারতের মতো। কারণ মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের ৫৫ শতাংশ তৈরি হয় গুটিকয় উন্নত দেশ থেকে। সেই দায় থেকেই শুরু হয়েছে ‘কার্বন ট্রেডিং’ বা কার্বন বাণিজ্য। উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের শিল্প, পরিবহণ, কৃষিকাজে কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তার জন্য আনুপাতিক হারে অর্থ দেবে ধনী দেশগুলো। যেটুকু কার্বন নিয়ন্ত্রিত হল সেইটুকু হিসেব কিনে নেবে কোনও ধনী দেশ। কিন্তু কার্বন বাণিজ্য এতটাই অনুমান এবং আন্দাজ নির্ভর যে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে ইতিমধ্যেই। অর্থাৎ কার্বন বাণিজ্যেও কোনও সমাধান নেই।
তা হলে সমাধান কি রয়েছে পরমাণু শক্তি উৎপাদনে? সেখানেও প্রফুল বিদোয়াইয়ের স্পষ্ট না। চিরকালই তিনি পরমাণু বিদ্যুতের সোচ্চার বিরোধী। পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে তাপ বিদ্যুতের তুলনায় প্রায় নামমাত্র কার্বন তৈরি হয়। পরমাণু বিদ্যুৎ তবু সমাধান নয়। কারণ এখনও পর্যন্ত সারা বিশ্বে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় তার মাত্র ২.০ শতাংশ পরমাণু বিদ্যুৎ। অন্য দিকে উইন্ডমিল, ছোট ও ক্ষুদ্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বায়োমাস, সৌর কিরণের মতো অপ্রচলিত ক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় ১২.৯ শতাংশ। এমনকী জলবিদ্যুতের ব্যবহারও পরমাণু বিদ্যুতের চেয়ে বেশি। লেখক দেখিয়েছেন, বিশ্বের ১৩০টি দেশের মধ্যে মাত্র ৩০ টি দেশ পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। তাদের অর্ধেক দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নের। তারাই বিশ্বের মোট পরমাণু বিদ্যুতের অর্ধেক উৎপাদন করে। ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া আর আমেরিকা বিশ্বের মোট পরমাণু বিদ্যুতের তিন ভাগ উৎপাদন করে। লেখক বলছেন, ফুকুশিমার ঘটনা দেখার পরে আর সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই যে, পরমাণু বিদ্যুৎ কেবল ঝুঁকিই বাড়ায়, জলবায়ু সংকটে কোনও সমাধানের পথ দেখায় না।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র থেকে স্থানীয় পর্যায়, পরিবেশের সংকট যে কত গভীর তা আমরা নিজেদের দিকে একবার তাকালেই বুঝতে পারব। হাইকোর্টের নির্দেশে কলকাতা এবং শহরতলির ১৫ বছরের পুরনো সব রকম বাণিজ্যিক গাড়ি এক বছর বাতিল করেই সরকার সে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। নিষিদ্ধ প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণে কোনও উদ্যোগ নেই প্রশাসনের। প্রতি দিন জলাভূমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদেরই মদতে। বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার গ্রামগুলো স্পঞ্জ আয়রন কারখানার দূষণে উজাড় হয়ে গেল। প্রশাসন প্রায় নীরব দর্শক। রাজ্য সরকারের পরিবেশ দফতর আছে, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আছে। কিন্তু তারা কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ। কারণ না বাম, না ডান— কোনও দলেরই পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই। কারণ এখনও পর্যন্ত ভোট পাওয়া না-পাওয়া পরিবেশের সমস্যার ওপর নির্ভর করে না।
বইয়ের ভূমিকায় প্রফুল বিদোয়াই জানিয়েছেন, ‘বিশ্ব এক ঐতিহাসিক সংকটের মুখোমুখি।’ সেই সংকট মোচনের একটা দিশাও তিনি দেখিয়েছেন। লেখকের আশা, পরিবেশ এবং উন্নয়ন একদিন তৃণমূল স্তরের আন্দোলনের বিষয় হয়ে উঠবে এবং তা শিক্ষিত ভদ্রলোকের চর্চার বাইরে মাটির কাছাকাছি পৌঁছবে। পরিবেশ সংকটের সমাধান বেরিয়ে আসবে সেখান থেকেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.