প্রবচন সত্য। চুরির জন্য যে দায়ী, তাহার অতি নিকট ব্যক্তিই কিছু বেশি রকমের প্রতিবাদ করিয়া থাকে। সম্প্রতি রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী যে বলিয়াছেন, শিশুশ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ সরকারি অনুদান স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি অপব্যয় করিতেছে, তাহাতে প্রবচনটি মনে পড়িতে বাধ্য। তিনি যাঁহাদের দোষারোপ করিতেছেন সেই সংগঠনগুলির কর্তাদের অনেকেই দোষার্হ, সন্দেহ নাই। কিন্তু তাঁহাদের দুর্নীতি করিবার সুযোগ করিয়া দিয়াছে কে? শিশু শ্রমিকদের জন্য বিশেষ স্কুলগুলির পরিদর্শনের দায়িত্বপ্রাপ্ত যে সরকারি কর্তারা, তাঁহারা যদি বৎসরের পর বৎসর নানা দুর্নীতি চলিতে দিয়া থাকেন, তাহা হইলে কেবল চোরের উপর রাগ করিয়া কী হইবে? ইহা পরিতাপের বিষয় যে, সামান্য কিছু লাভের জন্য এ রাজ্যের দরিদ্র শিশুদের উন্নতির পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছেন গ্রামের জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্তারাই। শিশু শ্রমিকদের স্কুলগুলিতে ছাত্রদের সামান্য কিছু অনুদান দেওয়া হইয়া থাকে। সেই সুবিধাটুকু পাইবার লোভে বাস্তবে যাহারা আদৌ শ্রমিক নহে, যাহারা অন্য স্কুলের ছাত্র, তাহাদেরও শিশু শ্রমিক স্কুলের ছাত্র হিসাবে নাম লিখাইয়া দেওয়া হয়। গ্রামে যাঁহারা প্রভাবশালী ব্যক্তি, তাঁহাদের চাপ এড়াইয়া কাজ করিবার ক্ষমতা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির নাই। সংগঠন কর্তাদের অনেকের সততাও সন্দেহাতীত নহে। তাই পরিদর্শনের সময় হইলেই অন্য স্কুল হইতে শিশুদের হাজির করা হয় শ্রমিক-বিদ্যালয়ে।
এই চাতুরি ধরিতে কোনও চক্ষুষ্মান পরিদর্শকের অধিক সময় লাগিবার কথা নহে। তবু যে এই সমস্যা কখনও ধরা পড়ে না, তাহার কারণ পরিদর্শন যেমন হইবার কথা তাহা হয় না, এবং হইলেও পরিদর্শক চক্ষু বুজিয়াই থাকেন। বহু দিন ধরিয়া এই অব্যবস্থা চলিয়া আসিতেছে, এখন সহসা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে ‘বলির পাঁঠা’ করিয়া সরকার নিজের স্বচ্ছতা প্রচার করিতে চাহিলে তাহাকে হাস্যাস্পদ হইতে হইবে। অভিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে অবশ্যই শাস্তি দিতে হইবে সরকারি বরাদ্দ নয়ছয় করা, শিশুদের প্রতারণা করা, এগুলি সবই গুরুতর অপরাধ। কিন্তু জনমঞ্চে দাঁড়াইয়া শিশুশ্রমিকের দুর্দশার জন্য কয়েকটি সংগঠনকে দোষারোপ করিয়া সাধারণকে চমৎকৃত করা যাইবে না। কে চুরি করিয়াছে, তাহার অপেক্ষা কাহার সহযোগিতায় চুরি হইয়াছে, সে প্রশ্ন কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নহে।
শিশুকে শ্রমিকে পরিণত করিবার এমন একটি সক্রিয় সহযোগী হইয়া দাঁড়াইয়াছে পঞ্চায়েতগুলি। কিছু বাড়তি রোজগারের আশায় পরিবারগুলি শিশুদের পাঠাইতেছে একশো দিনের কাজের শ্রমিক হিসাবে খাটাইতে, পঞ্চায়েতও নির্দ্বিধায় তাহা মানিয়া লইতেছে। এ ভাবেই স্কুল হইতে শিশুদের নিঃশব্দ বিদায়ে মদত জোগাইতেছে সরকার। এক দিকে শিশুর ভবিষ্যৎ নষ্ট হইতেছে, অপর দিকে শিশুশিক্ষার জন্য বরাদ্দ বহু কোটি টাকা ব্যয় বৃথা যাইতেছে। ইহাও কি সরকারের দায়বোধহীনতার প্রকাশ নহে? শিশুশ্রম বিরোধী দিবসে যে প্রশ্নের উত্তর সরকার দিতে পারে নাই, তাহা হইল, রাজ্যে ঠিক কত শিশু শ্রমিক রহিয়াছে। অথচ ইহার উত্তর খুব বেশি খুঁজিবার প্রয়োজন ছিল না। যাহারা স্কুলে যায় না, সেই সকল শিশুই শ্রমিক, ইহা ধরিয়া লইলে এ রাজ্যে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আড়াই লক্ষ হইতে সাত লক্ষ। এই বিশাল ব্যর্থতার দায় গোটা কতক ক্ষুদ্র স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উপর চাপাইবার বস্তু নহে। শ্রমমন্ত্রীকে নিজের ঘর সামলাইতে ঈষৎ পরিশ্রম করিতে হইবে। |