ঘরের ভিতর ঘর, তাহার ভিতরে ঘর কেন্দ্রীয় সরকারও বুঝি এই ধাঁধাটির খোঁজ পাইয়াছে, এবং অনুপ্রাণিত হইয়া অন্য একটি ধাঁধা তৈরি করিয়াছে সংরক্ষণের ভিতর সংরক্ষণ, তাহার ভিতর সংরক্ষণ। এই ধাঁধাটির উত্তর, কেন্দ্রীয় সরকারের মতে, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত ২৭ শতাংশ আসনের মধ্যে ৪.৫ শতাংশ আসন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদের জন্য সংরক্ষণ করা। এই ধাঁধাটিও হয়তো পূর্বোক্ত ধাঁধাটির ন্যায় কালজয়ী হইতে পারিত, কিন্তু বাদ সাধিয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। দেশের সর্বোচ্চ আদালত জানিতে চাহিয়াছে, কীসের ভিত্তিতে এই সংরক্ষণ? কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট কি প্রয়োজনীয় তথ্য, নথিপত্র মজুত আছে? আপাতত নথির খোঁজ চলিতেছে বটে, কিন্তু সরকারের এই সংরক্ষণেচ্ছার কারণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মঙ্গলচিন্তা নহে, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন, তাহাতে সংশয় নাই। বস্তুত, সকল রাজনীতিকের তূণেই ব্রহ্মাস্ত্রটির নাম সংরক্ষণ রাজনৈতিক ভাবে কোণঠাসা হইয়া পড়িলেই এই অস্ত্রটির প্রয়োগ জরুরি হইয়া পড়ে। তাহাকে সংখ্যালঘু উন্নয়নের মায়ামন্ত্রঃপূত করিতে পারিলে তো আর কথাই নাই।
ভারতে কেন সংরক্ষণের ব্যবস্থা হইয়াছিল, কত দিনের জন্য হইয়াছিল, সবই বহুচর্চিত। স্বাধীনতা অর্জনের পরে দেশনেতারা যে ধারণাগুলিকে কেন্দ্রে রাখিয়া নূতন ভাবে দেশটিকে গড়িতে চাহিয়াছিলেন, রাজনীতির দশচক্রে সেই ধারণাগুলির সবই ধূলিসাৎ হইয়াছে। কিন্তু, সংরক্ষণের ব্যবস্থাটির ন্যায় এমন অপব্যবহার বুঝি আর কোনও ধারণার হয় নাই। যথেচ্ছ সংরক্ষণ হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে ফল হয় নাই। হইলে, আজ আর নূতন করিয়া সংরক্ষণের প্রয়োজন হইত না। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বিস্ময় প্রকাশ করিয়া জানিতে চাহিয়াছেন, কোন আইনের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার এমন একটি সংরক্ষণের পথে হাঁটিল? আইন আছে কি না, সেই প্রশ্ন ভিন্ন। কিন্তু, ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ ভারতীয় সংবিধানের দর্শনের, অন্তর্নিহিত ভাবাদর্শের বিরোধী। স্বাধীনতা অর্জনের পর যখন নূতন ভাবে দেশ গড়িবার কাজ চলিতেছিল, তখন নেতারা সচেতন ভাবেই ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসরে আবদ্ধ রাখিবার কথা ভাবিয়াছিলেন। স্থির হইয়াছিল, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কাহারও সহিত কোনও বৈষম্য করা হইবে না, কোনও বিশেষ সুবিধাও দেওয়া হইবে না। স্বীকার করা প্রয়োজন, পরবর্তী সময়ে রাজনীতি এই আদর্শ হইতে বিচ্যুত হইয়াছে। দেশের বহু রাজ্যে ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা হইয়াছে। কিন্তু, ভারতীয় সংবিধানে সেই বিচ্যুতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনও নৈতিক যুক্তি নাই।
যে সংখ্যালঘুদের চিন্তায় আজ নেতাদের রাতের ঘুম ছুটিয়া গিয়াছে, সংরক্ষণের মাধ্যমে যে তাঁহাদের উন্নয়ন সম্ভব নহে, এই কথাটি নেতারা বিলক্ষণ জানেন। তবুও তাঁহারা সেই চেষ্টা করিতেছেন। যেমন, ইমামদের জন্য বিনামূল্যে বাড়ির ব্যবস্থা করিলে মুসলমান সম্প্রদায়ের উন্নয়ন হয় না জানিয়াও তাহাই করা রাজনীতিকদের ধর্ম। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়ন অতি জরুরি। উচ্চ শিক্ষায়, চাকুরিতে তাঁহাদের আরও অনেক বেশি উপস্থিতি প্রয়োজন। কিন্তু, তাহা সংরক্ষণের মাধ্যমে হইবার নহে। তাহার জন্য রাজনীতির পাটিগণিত ভুলিয়া আন্তরিক চেষ্টা করিতে হইবে। শিক্ষা খাতে অধিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে শিক্ষার মূলধারায় লইয়া আসা প্রয়োজন। এবং, সম্প্রদায়গুলি যে কারণের জন্য পিছাইয়া থাকে, তাহাতে রাজনৈতিক মদত দেওয়া বন্ধ করা প্রয়োজন। কিন্তু, এত ভাবিলে কি আর রাজনীতি হয়? ফলে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে, অনগ্রসর শ্রেণির মানুষকে বিভিন্ন ধাঁধায় ভুলাইয়া রাখাই ভারতীয় রাজনীতির দস্তুর। এই কু-অভ্যাসটি অবিলম্বে পরিত্যাজ্য। |