পরিবর্তনের পরে প্রত্যাবর্তন।
আমজনতার মারকাটারি নায়ক নিজেকে বদলে নিয়েছিলেন শহুরে ছবির অন্যতম আইকনে। পঞ্চাশ ছোঁয়া সেই নায়কই আরও এক বার ফিরে এসেছেন অ্যাকশন-স্টান্ট-নাচাগানায়। ‘‘অনেক দিন পর। দেখতে চাইছিলাম, পারি কি না।”
আইপিএলের ভরা মরসুমে মুক্তি পেয়েছিল ‘বিক্রম সিংহ’। আকাশে ছিল না বৃষ্টির ছিটেফোঁটা। প্রযোজকদের তরফে হিমাংশু ধানুকার দাবি, আইপিএল ফাইনালের রবিবার পর্যন্ত, অর্থাৎ মুক্তির প্রথম তিন দিন ব্যবসা একটু কম হয়েছিল স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু তার পর থেকে আর ভাবতে হয়নি। প্রথম সপ্তাহের চেয়ে দ্বিতীয় সপ্তাহে দেড় গুণ ব্যবসা বেড়েছে। হিমাংশুর আরও দাবি, প্রদর্শকরা জানিয়েছেন, অন্তত ছ’সপ্তাহ চিন্তা নেই। “রাউডি রাঠৌর নিয়ে আমাদের একটু টেনশন ছিল। কিন্তু বিক্রমের বক্স অফিসে সেটা প্রভাব ফেলতে পারেনি।”
প্রায় দু’দশক বাণিজ্যিক সিনেমায় রাজত্ব করার পরে প্রসেনজিৎ ইদানীং সরে এসেছেন অন্য ঘরানার ছবিতে। ‘অমর সঙ্গী’ বা ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ ছেড়ে বেরিয়ে ‘অটোগ্রাফ’, ‘মনের মানুষ’ আর ‘বাইশে শ্রাবণে’র প্রসেনজিতকে নতুন করে আবিষ্কার করেছে ‘জেনারেশন ওয়াই’। সবেমাত্র মুক্তি পেয়েছে বলিউডের ‘সাংহাই’। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ‘বিক্রম সিংহ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে “যে দর্শক আমাকে নায়ক বানিয়েছে, আমি তাদের বলতে চেয়েছি, প্রসেনজিৎ কিছু ভোলেনি।”
কী ভাবে ব্যাখ্যা করা হবে তারকার এই বিবর্তনকে? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বললেন, সত্তর দশকের পর বাঙালি মধ্যবিত্তের নিস্তরঙ্গ গেরস্থালি ভেঙেচুরে গিয়েছিল। সেই সময়েই বাংলা ছবিতে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের দায়িত্ব নেওয়া নায়কের উত্থান, যে আইন-বহির্ভূত পথ নিতেও পিছপা নয়। প্রসেনজিত সেই নায়ক। “একুশ শতকে ঢুকে মধ্যবিত্ত আবার থিতু হচ্ছে। উদারীকরণের সুযোগ নিচ্ছে। প্রসেনজিৎও তাল মিলিয়ে নিজেকে বদলে নিয়েছেন। ‘বিক্রম সিংহে’ সেই নতুন প্রসেনজিৎ নিজের পুরনো অবয়বকে আর এক বার ফিরে দেখলেন।” |
কিন্তু ‘অটোগ্রাফে’র আগেও ভিন ধারার ছবিতে অভিনয় কি করেননি প্রসেনজিৎ? “করেছি। কিন্তু ‘চোখের বালি’ বাদ দিলে সেগুলো এতটা বক্স অফিস সাফল্য পায়নি।” সঞ্জয়ের কথায়, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল থেকে এখানে যে পরিচালক-নির্ভর সিনেমার শুরু, অপর্ণা-ঋতুপর্ণ ঘোষেরা তারই উত্তরসূরি। “কিন্তু এখন আবার সিনেমাকে সমষ্টিগত প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে। অভিনেতার স্বতন্ত্র গুরুত্বও অনেক বেড়ে যাচ্ছে।” ‘অটোগ্রাফ’ থেকে প্রসেনজিতের একটা নতুন পর্ব শুরু হয়েছে সেই কারণেই।
আর সেই নতুন পর্বের মাঝখানেই ‘বিক্রম’! ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘যদুবংশ’ করতে করতেই উত্তমকুমার করেছিলেন ‘অমানুষ’। ‘তারে জমিন পর’-এর পরে এসেছিল আমির খানের ‘গজনী’। হালে অমিতাভ বচ্চন করেছেন ‘বুড্ঢা হোগা তেরা বাপ’। ‘‘এই রকম ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা এই মাপের অভিনেতাদেরই থাকে”, মনে করিয়ে দিলেন ‘অটোগ্রাফ’-‘বাইশে শ্রাবণে’র পরিচালক সৃজিৎ মুখোপাধ্যায়। ‘অভিনেতা’ প্রসেনজিতের ‘খিদে’কে কুর্নিশ করে বললেন, “নিজেকে ভাঙতে বুম্বাদার কোনও ক্লান্তি নেই। ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ বা ‘উৎসব’ বা ‘বাইশে শ্রাবণ’, ওঁর মনঃসংযোগ একই রকম থাকে।”
অজিত (ব্যোমকেশ) থেকে বব বিশ্বাস (কহানি) হয়ে হাতকাটা কার্তিক (ভূতের ভবিষ্যত) পেরিয়ে এখন ঋত্বিক ঘটকের ভূমিকায় অভিনয় করতে চলা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় নিজেকে বারবার ভেঙেছেন। অগ্রজ প্রসেনজিৎ সম্পর্কে তিনি এক বাক্যে বলছেন, “বুম্বাদার মতো লড়াই করার ক্ষমতা খুব কম লোকের আছে। সেই জন্যই ওঁর সমসাময়িকরা সরে গিয়েছেন, বুম্বাদা আজও নিজের জায়গাটা ধরে রেখেছেন।”
সেই কারণেই কাঁচড়াপাড়ার গৃহবধূ থেকে বোলপুরের রিকশাচালক থেকে শহরের মাঝবয়সী চলচ্চিত্রামোদী শুধু প্রসেনজিতের দ্বিরাগমনকে উদ্যাপন করতেই হল-এ যাচ্ছেন। স্কুল-কলেজে নিয়মিত প্রসেনজিতের ছবি দেখে বড় হয়েছেন পৃথা দেবরায়। ‘বিক্রম সিংহ’ দেখে মনে হয়েছে, “আমাদের সময়ের নায়ক এখনও পারে।” বাংলা ছবির নিয়মিত দর্শক, পেশায় চাকরিজীবী পার্থ ভট্টাচার্য বেড়াতে গিয়েছিলেন বোলপুরে। সেখানে রিকশাচালকরাই তাঁকে বলে দিয়েছেন, “প্রসেনজিতের বই ব্যাপক হয়েছে দাদা!” শহরের কলেজপড়ুয়া নিলাদ্রি সেনগুপ্ত আবার প্রসেনজিতকে চিনেছে ‘অটোগ্রাফ’ থেকে। টলিউডি-মশালার দর্শক সে নয়। কিন্তু ‘বিক্রম সিংহ’ দেখতে চায়। কেন? “প্রসেনজিতকে দেখার জন্যই দেখব।” অর্থাৎ শহরের দর্শক যে প্রসেনজিতকে এখন চেনে, তাঁকে একটা অন্য অবতারে দেখার আকর্ষণ তাদের মধ্যেও ছড়াচ্ছে।
অথচ বাংলায় বাজারে এই মুহূর্তে সুঠাম নায়কের অভাব নেই। দেব-জিৎ-সোহমরা চুটিয়ে কাজ করছেন। “ওরাই করবে। একটা ‘বিক্রম সিংহ’ করেছি মানে এই নয় যে, আমি আবার পরপর এই জাতীয় ছবিই করব,” বললেন প্রসেনজিৎ। হিমাংশুর বক্তব্য, ‘‘এই ছবিটা বুম্বাদার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ। বুম্বাদা কুড়ি বছর ইন্ডাস্ট্রিকে ধরে রেখেছিলেন।” সে সময় ৫০-৬০ লাখ টাকার ছবি হত। এখন ৫-৬ কোটি টাকার ছবি হচ্ছে। “আমরা চেয়েছিলাম, বুম্বাদা এখনকার ছবিও করুন একটা।”
তাই ‘বিক্রম সিংহ’। শাশ্বত বলছিলেন, “অনেক ছবি থাকে, যা নিয়ে হয়তো তেমন হইচই হয়নি। কিন্তু এক জন অভিনেতার কাজের জায়গা থেকে দেখলে সেই ছবিটারই হয়তো একটা আলাদা জায়গা রয়েছে।” আবার উল্টোটাও হয়। “চৌরঙ্গী’ হিট করার পর দেড় বছর বাবার কোনও কাজ ছিল না। উত্তমকুমারকেও এক সময় ফ্লপ মাস্টার বলা হয়েছে! হিট-ফ্লপ না ভেবে যে অভিনেতা ক্রমাগত নিজেকে ভাঙেন, তিনিই থাকেন!”
প্রসেনজিত থেকেছেন। ‘পথভোলা’ থেকে ‘অমর সঙ্গী’ হয়ে ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘চোখের বালি’ থেকে ‘বাইশে শ্রাবণ’ হয়ে ‘বিক্রম সিংহ’! অভিনেতার এই পরিক্রমার নিরিখেই ‘বিক্রম সিংহ’ একটা নিছক রিমেক ছবি হয়ে থেকে যাচ্ছে না! প্রসেনজিতের নিজের ভাষায়, সেটা হয়ে উঠছে, ‘‘আমার ভাঙাগড়ার খেলা’’! |