চাঁদের কলঙ্ক প্রতি পূর্ণিমাতেই খালি চোখে দেখা যায়। এ বার কলঙ্ক দেখা যাবে সূর্যের গায়েও! আজ, বুধবার ভোরে সূর্য উঠবে গায়ে কলঙ্ক নিয়ে।
কলঙ্ক কোথা থেকে আসবে? জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা আসলে সূর্যের বুকের কাছ দিয়ে চলে যাবে শুক্র। শুক্রের ওই ‘সরণ’ই কালো টিপ হয়ে ফুটে উঠবে সূর্যের বুকে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবী এবং সূর্যের মধ্যে শুক্রগ্রহ চলে আসবে ওই সময়। সুতরাং একই সরলরেখায় সূর্য এবং অপর দু’টি গ্রহ অবস্থান করার কারণে শুক্রের ছায়া সূর্যের উপর পড়বে।
সূর্যগ্রহণের সময়ে চাঁদের ছায়া সূর্যকে ঢেকে ফেলে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শুক্রের অবস্থান এমন হবে যার ফলে শুক্রের ছায়া সূর্যকে ঢাকতে পারবে না। একটা কালো বিন্দুকে মনে হবে সূর্যের নীচের অংশ দিয়ে আড়াআড়ি চলে যাচ্ছে। ওই কালো বিন্দুটাই শুক্র। কিংবা ভোরের আকাশের শুকতারা। যতক্ষণ তা সূর্যের মধ্যে থাকবে ততক্ষণই দেখা যাবে এই মহাজাগতিক দৃশ্য। কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় সূর্যের বুকে ওই কলঙ্ক থাকবে ভোর ৪ টা ৫২মিনিট থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে। অর্থাৎ খুব ভোরে যাঁরা উঠতে পারেন না তাঁদেরও হতাশ হওয়ার কারণ নেই। কারণ, এ রাজ্যে বেলা ১০টা পর্যন্ত সূর্যের কলঙ্ক দেখা যাবে। তবে খালি চোখে নয়। কারণ, সরাসরি সূর্যের দিকে তাকালে চোখের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মহাজাগতিক দৃশ্য দেখতে হলে ১৪ নম্বর শেডের ওয়েল্ডিং গ্লাস বা অ্যালুমিনাইজড মাইলার ফিল্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। অথবা টেলিস্কোপ কিংবা বিশেষ ধরনের চশমা।
সূর্যের মধ্য দিয়ে শুক্রের এই সরণ অবশ্য কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। পজিশন্যাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের অধিকর্তা সঞ্জীব সেন বলেন, “শুক্র আর বুধের ক্ষেত্রেই এ ধরনের চলন দেখা যায়। কারণ, শুধু ওই দু’টি গ্রহের কক্ষপথই পৃথিবী এবং সূর্যের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।” তবে কিন্তু এমন ঘটনা ঘন ঘন হয় না। একটা নির্দিষ্ট ছন্দে হয়। ছন্দটা ৮, ১০৫, ৮, ১২১ বছরের হিসেবে আবর্তিত হয়। যেমন এর আগে শুক্রের সরণ দেখা গিয়েছিল ২০০৪ সালে। অর্থাৎ আট বছর আগে। এর পরেরটা হবে ১০৫ বছর পরে অর্থাৎ ২১১৭ সালে। তার পরেরটা আবার আট বছর পরে, ২১২৫ সালে। তার পরে ১২১ বছর পরে, ২২৪৬ সালে।
ইতিহাস বলছে, সপ্তদশ শতকের গোড়ায় জার্মান বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলার ১৬৩১ সালে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানিয়েছিলেন। ১৬৩০ সালে মারা যান কেপলার। কিন্তু তাঁর গণনা সত্যি হয়েছিল। ১৬৩১ সালের নভেম্বর মাসে ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়ের জ্যাসেন্ডি সূর্যের উপর বুধের চলন লক্ষ করেন। এর আট বছর পর, ১৬৩৯ সালে প্রথম সূর্যের উপর শুক্রের চলন লক্ষ করেন দুই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী, জেরেমিয়া হরকস্ ও উইলিয়াম ক্র্যাবট্রি।
এই মহাজাগতিক ঘটনা নিয়ে ভারত তো বটেই, গোটা বিশ্ব জুড়েই শুরু হয়ে গিয়েছে মাতামাতি। জ্যোতিষশাস্ত্রবিদেরা কেউ কেউ এর মধ্যে নানা ‘অলক্ষণ’ খুঁজে পাচ্ছেন। পণ্ডিত মুরারিমোহন বেদান্তাদিতীর্থ শাস্ত্রীর বিধান, “শুক্রের চলনের ফলে সূর্যপুত্র শনি সূর্যরশ্মিকে বিভক্ত করে দিচ্ছে। এটা অশুভ লক্ষণ। এর ফলে আষাঢ় মাসেও বৃষ্টি হবে কি না সন্দেহ। লোকক্ষয় হবে। রোগ, ব্যাধি বাড়বে।” তবে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার হিমাংশু স্মৃতিতীর্থ জানাচ্ছেন, “এমনিতে এর প্রভাব মানুষ বা প্রকৃতির উপরে তেমন ভাবে পড়ার কথা নয়। তবে সমুদ্রে কিছুটা জলস্ফীতি হতে পারে। ক্ষয়ক্ষতির তেমন কোনও আশঙ্কা নেই।”
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে এই ঘটনা নতুন কোনও তথ্য দেবে কি? সঞ্জীববাবু বলেন, “সূর্যের উপর দিয়ে শুক্র যখন চলে যাবে, তখন সূর্যের ঔজ্জ্বল্য সামান্য হলেও হ্রাস পাবে। সেই প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে সৌরমণ্ডলের বাইরে অন্য গ্রহের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা করা যাবে। নাসার বিজ্ঞানীরা সেই গবেষণা করবেন। শুক্রের বায়ুমণ্ডলে কী কী উপাদান রয়েছে সে ব্যাপারেও ধারণা করা যাবে।”
|
স্মরণীয় সরণ |
প্রশ্ন: শুক্রের সরণ কী?
উত্তর: এটি মহাজাগতিক ঘটনা। এ ক্ষেত্রে সূর্যের উপর দিয়ে চলতে দেখা যাবে শুক্রকে।
প্রশ্ন: এমনটা কত দিন অন্তর ঘটে?
উত্তর: এই ঘটনা একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে হয়। সময়ের ব্যবধানটা ৮ বছর, ১০৫ বছর, ৮ বছর, ১২১ বছর এই ভাবে আবর্তিত হয়। যেমন এর আগে ওই সরণ দেখা গিয়েছিল ২০০৪ সালে। পরেরটা হবে ১০৫ বছর পরে অর্থাৎ ২১১৭ সালে।
প্রশ্ন: সরণ কত ক্ষণ চলবে?
উত্তর: সূর্যকে পেরোতে শুক্রের প্রায় সাত ঘণ্টা সময় লাগবে। কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় সূর্যের বুকে ওই গ্রহকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে দেখা যাবে ভোর ৪ টা ৫২ মিনিট থেকে।
প্রশ্ন: নিরাপদে এই ঘটনা দেখতে হলে কী করতে হবে?
উত্তর: ছোট টেলিস্কোপ বা দূরবীনের সাহায্যে একটি স্ক্রিনের উপরে এই দৃশ্যের প্রতিফলন দেখা যেতে পারে। ১৪ নম্বর শেডের ওয়েল্ডিং গ্লাস বা অ্যালুমিনাইজড মাইলার ফিল্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে খালি চোখে একেবারেই নয়।
প্রশ্ন: শুক্রের সরণ কেমন দেখতে?
উত্তর: সূর্যের উত্তর ভাগ দিয়ে চলতে দেখা যাবে শুক্রকে। চওড়ায় এটি সূর্যের ব্যাসের ১/৩২ ভাগ। তাই সূর্যের উপরে একটি কালো বিন্দুর মতো দেখতে লাগবে শুক্রকে। সরণের শুরু ও শেষে বিন্দুটিকে একটু লম্বাটে দেখাবে, মনে হবে যেন টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একে ‘ব্ল্যাক ড্রপ এফেক্ট’ বলা হয়।
প্রশ্ন: এই ঘটনা থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কী শিক্ষা নেবেন?
উত্তর:সৌর মণ্ডলের বাইরে অন্য গ্রহের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা করা যাবে। নাসা এই গবেষণাটি করবে। তা ছাড়া শুক্রের বায়ুমণ্ডলে কী কী উপাদান রয়েছে সে ব্যাপারে ধারণা করা যাবে।
প্রশ্ন: প্রথম কবে দেখা গিয়েছিল শুক্রের এই সরণ?
উত্তর:১৬৩৯ সালে সর্বপ্রথম সূর্যের উপর শুক্রের চলন লক্ষ করেন দুই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেরেমিয়া হরকস্ ও উইলিয়াম ক্র্যাবট্রি। |
|
আজ সূর্যের বুকে শুক্রের বিরল সরণ
নিজস্ব সংবাদদাতা • মেদিনীপুর |
মহাজাগতিক বিরল দৃশ্য দেখার প্রস্তুতি কোলাঘাটের স্কুলে। —নিজস্ব চিত্র। |
ভোর থেকেই আজ চোখ রাখুন আকাশে। শুক্র-গ্রহের সূর্য অতিক্রমণের বিরল ঘটনা ঘটতে চলেছে আজ, মঙ্গলবার। এ দিন ভোর থেকেই সূর্যের উপর একটি ফোঁটার মতো কালো দাগ দেখা যাবে। যেটি এক দিকে থেকে আরেক দিকে সরে সরে যাবে। সেটিই শুক্র-গ্রহ। এই শতাব্দীতে শুক্র -গ্রহের এটাই শেষ সূর্য-অতিক্রমণ। এই বিরল দৃশ্য যাতে সাধারণ মানুষ দেখতে পারেন, বিভিন্ন এলাকায় তার বন্দোবস্ত করেছে বিভিন্ন সংস্থা। মেদিনীপুর কলেজ ক্যাম্পাসে এন সি রাণা আকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের উদ্যোগে এই বিরল ঘটনা দেখানোর বন্দোবস্ত হয়েছে। ভোর থেকে সকাল ১০টা ২০ পর্যন্ত দেখানো হবে। ফের এ ঘটনা ঘটবে ২১১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর। |