|
|
|
|
|
|
|
আপনার সাহায্যে ১... |
|
জিম যাত্রা |
এক সময় বাঙালি প্রতিদিন যেত গঙ্গাস্নানে। স্নানটা এখনও আছে। কিন্তু গঙ্গাজলে নয়, ঘামে।
রোজের রুটিনে এখন জিম ঢুকে পড়েছে যে। কেন? সন্ধান করছেন ইন্দিরা বসু ও শতরূপা বসু |
বাইরে জ্যৈষ্ঠের চটচটে গরম। ভেতরে এসি-র ঝকঝকে ঠান্ডা।
তাতে কী? ভেতরে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা ঘামে ভিজে জবজবে।
সে কি?
সেটাই তো গল্প। ভেতরের তাঁরা তো নিজেদের ঠেলে ওঠাচ্ছেন চলমান কল-কব্জায়। ট্রেডমিলে। ক্রস ট্রেনারে। সাইক্লিং মেশিনে।
শরীরটাকে ভেঙেচুরে ঘাম ঝরাচ্ছেন। ১৫ থেকে ৫০। পরনে স্ল্যাকস আর টি-শার্ট। একটু বয়স্করা সালোয়ার
কামিজ। ছাত্রী। চাকুরে। গৃহবধূ। খেয়াল করুন। ভবানীপুর, লেক গার্ডেন্স, গিরিশ পার্ক, বেহালা। একের পর এক জিম।
তার মধ্যে দেশজোড়া ব্রাঞ্চ, এমন
বিখ্যাত জিমও আছে। আবার ছোটখাটো পাড়ার জিমও।
জিম যাত্রা। বাঙালির লেটেস্ট প্যাশন।
বাঙালির নতুন বিশল্যকরণী
কিন্তু কেন? আর কেন? ব্ল্যাকবেরির দুনিয়ায় কাজ থেকে ছুটি বলে তো কিছুই নেই। সঙ্গে আছে প্রতিযোগিতা। ফাস্ট ফুড। মদ্যপান। সিগারেট। শরীরের দফারফা। ডিপ্রেশন। আজ ক্লায়েন্টকে নামী রেস্তোরাঁয় খাওয়ানো। তো কাল ওই পার্টি অ্যাটেন্ড না করলে ডিল সিল করা যাবে না।
সেই জন্যই। দৈনন্দিন শুষ্কতার মধ্যে জিম হল মরূদ্যান। শরীরকে কষ্ট দিয়ে নিজেকে নতুন ভাবে ফিরে পাওয়া। |
|
উপচে পড়া এনার্জি। “শরীরকে কষ্ট দিয়ে যে এত আরাম, তা জিমে আসার আগে উপলব্ধিই করিনি,” বলছেন দেবদ্যুতি ভৌমিক। মাল্টিন্যাশনালে সিনিয়র ম্যানেজার। চল্লিশের কোঠায় বয়স। অসম্ভব ব্যস্ত। রুটিনের কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। মাস চারেক হল জিম যাচ্ছেন। “ব্যস্ততা যতই থাক, সময়টা ঠিক বের করে নিই। এবং এটুকু বলতে পারি, অলরেডি ফল পাচ্ছি। ডিপ্রেশন কেটে গেছে। কনফিডেন্স বেড়েছে।” চমকপ্রদ নিঃসন্দেহে। কারণ ব্যায়াম ব্যাপারটা কোনও দিনই সে ভাবে মধ্যবিত্ত বাঙালি কালচারে ছিল না। যার ফল ৩০ বছরের পর থেকে জানান দিত। গাঁটে ব্যথা। সারাক্ষণ ক্লান্তি আর ঘুম-ঘুম। কিন্তু এখন বাপু শরীরটাকে রাখতেই হবে। না হলে এই বাজারে যোঝাই যাবে না তো! |
ফিট থাকাটা ভীষণ জরুরি |
ফিটনেস কি প্রয়োজনীয়, না শুধুই বিলাস? একদম প্রয়োজনীয়, বলছেন চিকিৎসকরা। “এখন ফিট থাকাটা ভীষণ জরুরি। যাঁরা আমাদের কাছে এই সব সমস্যা নিয়ে আসেন আমরা সাধারণত তাঁদের হাঁটা, সাঁতার আর জিম, এই তিনটের যে কোনও একটা বাছতে বলি। আসলে বাঙালি তো একটু আতুপুতু করে মানুষ হয়।
ও বাবা, সাঁতার শিখলে আমার বাচ্চাটার যদি জলে ভিজে টাইফয়েড হয়! সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে যদি হাত-পা ভাঙে! দিন কিন্তু বদলে গেছে,” বলছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. সুকুমার মুখোপাধ্যায়। হাঁটা, সাঁতার বা জিম। মানে ঘাম ঝরাতেই হবে। না হলে শরীর বসে যাবে।
তবুও জিমেই ভিড় সবচেয়ে বেশি। কেন? “সাঁতার শেখার হ্যাপা অনেক। রোজ হাঁটতেও মাঝে মাঝে আলসেমি আসে। তার ওপর দিনে যখন-তখন হাঁটা যায় না। কিন্তু জিমটা শত ব্যস্ততার মধ্যেও টুক করে সেরে নেওয়া যায়। দিনের যে কোনও সময়। সে কারণেই জিমে এত ভিড়,” বলছিলেন রেশমী সরকার। ফার্স্ট ইয়ার এম এ। জিম করছেন এক বছর হল। |
প্রতিদিন সুন্দর হচ্ছি |
এমনও অনেকে আছেন, যাঁরা বাকিগুলো পরখ করে শেষে জিমেরই দ্বারস্থ হয়েছেন। যেমন মন্দিরা চট্টোপাধ্যায়। ক্রিয়েটিভ কনসালট্যান্ট। একা থাকেন। ব্যবসাও সামলান একা হাতে। শরীরটাকে যে এত দিন ফাঁকি দিয়ে এসেছেন, সেটা বুঝেছিলেন ৩০ পেরিয়ে। “ওজন কমাতে মিল স্কিপ করতাম। খিদে মারতে সারাক্ষণ চা-কফি খেতাম। শরীরটা দিনকে-দিন ভ্যাদভ্যাদে হয়ে যাচ্ছিল। স্বচ্ছ ভাবে ভাবতে পারতাম না। অসুস্থ লাগত। তার পর একদিন আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। এবং নিজের চেহারা দেখে নিজেরই ঘেন্না করল। সে দিনই ঠিক করলাম কিছু একটা করতে হবে। এটা আমার শরীর। তাকে সুস্থ রাখার দায়ও আমার,” বলছিলেন মন্দিরা।
প্রথমেই জিমে গিয়ে কঠিন ব্যায়াম করতে ভয় পেয়েছিলেন। যদি বে-কায়দায় লেগে-টেগে যায়! তাই শুরু করলেন যোগব্যায়াম। “চার মাস প্রতিদিন ৪৫ মিনিট করে যোগব্যয়াম করে একটা জিনিস বুঝলাম। আমায় আগের থেকে দেখতে ভাল লাগছে, নিজেকে সুস্থ মনে হচ্ছে।” সেই মন্দিরাও শেষ পর্যন্ত জিম-যাত্রী। “যোগব্যয়াম করে ফল পেলেও জিমের টগবগে ব্যাপারটা আমাকে সার্বিকভাবে অনেকটা পজিটিভ করে দিয়েছে,” বলছিলেন মন্দিরা।
আবার সমীর মল্লিকের জিম যাত্রার কারণটা অন্য রকম। “একা, একা যে কোনও জিনিস করাই খুব বোরিং। ভীষণ মনের জোর দরকার। না হলেই একদিন-দু’দিন কামাই হয়ে যাবেই। আমারই হয়েছে কত বার। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখেছি ব্যায়ামটা আর করাই হচ্ছে না,” বলছিলেন সমীর। আইটি-তে কাজ করেন। থাকেন গড়িয়ায়। অফিস সেক্টর ফাইভে। তার মধ্যেও ঠিক সময় করে এক ঘণ্টা জিমটা করেন। সপ্তাহে পাঁচদিন। “জিমে গেলে অনেকের সঙ্গে হইহই করে ঘাম ঝরানো যায়। বেশ স্কুল, স্কুল ব্যাপার।” |
অফিসে জিম |
“আইটি সেক্টর বা বড় কর্পোরেট হাউসে যাঁরা চাকরি করেন তাঁদের চেহারা বেঢপ হলে আজকাল আর চলে না। ঝকঝকে, সটান শরীর না হলে যে সংস্থার হয়ে আপনি কাজ করছেন তাদেরই তো বদনাম। তাই দেখবেন এই সব অফিসে জিম আছে। এবং বাঙালি সেখানে নিয়ম করে ট্রেডমিলে দৌড়চ্ছে,” বলছেন দক্ষিণ কলকাতার এক বড় জিমের ট্রেনার দীপায়ন দাস। দীপায়নের জিমেও এখন বাঙালি সদস্যদেরই রমরমা।
“আগে বাঙালির এই সচেতনতাটাই ছিল না। এখন টিভি দেখে, কাগজ পড়ে এটা মাথায় ঢুকতে শুরু করেছে যে শুধু ভাল দেখা নয়, শরীরটা ঠিক রাখতেও জিমে যাওয়াটা দরকার। মডেল আর ফিল্মস্টারই শুধু না, কলকাতার জিমগুলোতে তাই সাধারণ বাঙালির সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে,” বলছেন তিনি। |
আগে টায়ার্ড লাগত, এখন সকাল থেকেই টগবগে |
আসলে জিম-যাত্রাটা অনেকের ক্ষেত্রেই একেবারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর ঘটে। যেমন রোহন ভট্টাচার্য। সাংবাদিক। ছাত্রাবস্থায় নিয়মিত খেলাধুলো করতেন। চাকরিতে ঢোকার পর, প্রথম প্রথম সেই ঘাম ঝরানোর ফল কিছু দিন ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। তার পর? একেবারে উল্টো পরিস্থিতি। এমনিতেই সাংঘাতিক কাজের চাপ। সেই চাপ থেকে রেহাই পেতে মাঝে মাঝে আড্ডা। উল্টোপাল্টা খাবার। অল্পবিস্তর মদ্যপান। সেই ‘অল্পবিস্তর’ মাঝে মাঝেই ওভারডোজ হয়ে যেত। পার্টিতে যাওয়াও আছে। “আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম বডি ক্লকটা গণ্ডগোল করছে। সিঁড়ি দিয়ে দু’ধাপ চড়তে না চড়তেই হাঁফ। দৌড়ে ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে পেশিতে টান। শরীরে ফ্লেক্সিবিলিটি নেই। এমনকী মধ্য-তিরিশের আগেই ব্লাড সুগার, রক্তচাপ। বলতে পারেন ভীষণ ভয়, পরিস্থিতির ঠেলায় পড়ে প্রায় বাধ্য হয়েই তড়িঘড়ি জিম জয়েন করি,” বলছেন রোহন।
প্রত্যেক সপ্তাহে মেপে মেপে পাঁচদিন না পারলেও চেষ্টা করেন একটা নির্দিষ্ট রুটিন রাখার। “প্রথম দিন জিম করে, দ্বিতীয় দিনই ও মুখো না হওয়ার ইচ্ছের বিরুদ্ধে সাংঘাতিক লড়াইটাই সব থেকে বড় লড়াই। আর, এক বার যদি রোজ দাঁত মাজার মতো অভ্যেস করে ফেলতে পারেন তাহলে তো কথাই নেই! জীবাণুও মরবে, উপরি পাওনা একটা ঝকঝকে, কনফিডেন্ট মন আর শরীর,” বলছেন রোহন। আগে টায়ার্ড হয়ে বাড়ি থেকে বেরোতেন। “এখন সকাল ন’টার মধ্যেই টগবগে রেডি।” স্বীকার করছেন, আস্তে আস্তে আয়নার প্রতিচ্ছবিটাও মন্দ লাগছে না দেখতে। |
জিম যাওয়াটা ফ্যাশন নয় |
তবে মুম্বই-দিল্লি-র বেশির ভাগ মানুষ যে ভাবে ওয়ার্কআউট করা আর জিমে যাওয়াটাকে জীবনের অঙ্গ করে ফেলেছেন কলকাতার বাঙালি এখনও সেটা করে উঠতে পারেনি বলে আক্ষেপ জিমে যাওয়া মানুষজন আর ট্রেনারদের। “বাঙালি জাগছে ঠিকই। তবে জেগে উঠে দৌড়তে শুরু করতে হবে তো! সেটা কবে হবে কে জানে? এখনও তো দেখি আজ এল তো কাল এল না গোছের অ্যাটিটিউড। আরে জিমে যাওয়াটা ফ্যাশন নয়। নিয়ম করে, ঘাম ঝরিয়ে করতে হয়,” বলছেন সপ্তাহে ছ’দিন দু’ঘণ্টা
করে জিম করা মধ্য-তিরিশের
গৃহবধূ তানিয়া চক্রবর্তী। |
সতর্ক থাকুন |
এতটা উৎসাহের মধ্যে অবশ্য একটু সাবধানবাণীও আছে। সে কথাটাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন সুকুমারবাবু। “কুড়ি থেকে চল্লিশ আর চল্লিশোর্ধ্ব লোকজনের জিমের ব্যায়ামের ধরন একেবারে আলাদা। এটাকে বলা হয় ‘এলিজিবিলিটি অফ এক্সারসাইজ।’ কারণ বয়সের সঙ্গে শরীরের চাহিদাও আলাদা হয়ে যায়। তাই ট্রেনারের কাছে স্পষ্ট করে জেনে নিতে হবে কার কী রকম ব্যায়াম জরুরি।” সতর্কবাণীও থাক। ট্রেডমিলও থাক। সবই জিম দেবতার দয়া। |
আনাড়ির জিম গাইড |
• জুতোজোড়া যেন একদম ঠিক হয়। খরচের ভয়ে বাজে জুতো কিনবেন না। ভাল ব্র্যান্ডের জুতো, আর সঙ্গে সঠিক জিমের পোশাক কিনুন। সালোয়ার কামিজ পরে জিম করেন অনেকেই। কিন্তু তাতে জিমের মেজাজে ঢোকাটা কষ্টকর। |
• কোন জিম জয়েন করবেন, সেটা ঠিক করুন আগে। ট্রেনার যেন ভাল হয়। এমন একজন, যিনি আপনার ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো বুঝবেন, আপনাকে খাটিয়ে মারার থেকে সাহায্য করবেন বেশি। আপনি পয়সা খরচ করে জিম করছেন। সবচেয়ে ভালটাই আপনার প্রাপ্য। |
• খালি পেটে বা ভরপেটে জিম করা যায় না। জিম করার আগে ফলের রস, ঘোল বা টোস্ট জাতীয় কিছু খেয়ে শুরু করুন। |
• জিম করার সময় মোবাইল ফোনটা সুইচ-অফ রাখুন। মায়েরা জিমের সময়ে বাচ্চাদের বিশ্বাসী কারও জিম্মায় রেখে যান। ওই দু’ ঘণ্টা আপনার শরীরেই একমাত্র মনোনিবেশ করুন। |
• জিম কেন করছেন, সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা রাখুন। এক মাসে পাঁচ কেজি ওজন কমিয়ে এমন টায়ার্ড হয়ে গেলেন যে তারপর আর জিমমুখোই হলেন না, এমন যেন না হয়। ওজন কমবে ধীরে, ধীরে। ভাল থাকার পাসওয়ার্ড হল নিয়মানুবর্তিতা। |
• দিনের রুটিন অনুযায়ী জিমের রুটিন তৈরি করুন। না হলেই দেখবেন সংসারের কাজ বাকি পড়ে থাকছে, অফিসের কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। |
• ছুটিতে বেড়াতে গেলে কী করবেন ইন্সট্রাক্টরের কাছ থেকে জেনে নিন। ছুটির দিনগুলোয় ব্যায়ামে কামাই দেবেন না। |
|
|
|
|
|
|