ছুটির সুযোগ, নির্জীব শহর
প্তাহের মাঝে পড়ে পাওয়া ছুটির সুযোগ! যার সদ্ব্যবহার পুরোদমে করল আমজনতা। সৌজন্য: বাঙালির মানসিকতা। ফল: বাস-অটো-মেট্রো পর্যাপ্ত যাত্রী পেল না। রাজ্য পেল আর একটা কর্মনাশা বনধ।
বৃহস্পতিবারের ভারত বনধে ‘ছুটি কাটানো’র পরিকল্পনা আগাম ছকে রেখেছিলেন সিঁথির বাসিন্দা এক সরকারি কর্মী। অফিসে হাজিরার ফরমান তাঁকে দমাতে পারেনি। আগেভাগে ছুটির দরখাস্ত জমা দিয়েছেন। শিক্ষিকা স্ত্রীর গরমের ছুটি চলছে। মেয়ে যাদবপুরের ছাত্রী, সেখানে কিছু ক্লাস চললেও তিনি বাড়ির বাইরে বেরোননি। গলদা চিংড়ি কিনে রাখা হয়েছিল। দুপুরে মালাইকারি খেয়ে এসি চালিয়ে বিশ্রাম। সঙ্গে বিনোদনও। “ভূতের ভবিষ্যৎটা দেখে উঠতে পারিনি। মেয়ে পেন ড্রাইভে এনে রেখেছিল। সবাই মিলে দেখলাম।” জানাচ্ছেন সরকারি ওই কর্মী।
উনি আসলে বাঙালির মানসিকতারই প্রতীক। যে মানসিকতা বলে, বনধ যে-ই ডাকুক, যে কারণেই ডাকুক, সুযোগ থাকলে নির্ভেজাল ছুটি কাটাতে হবে। যানবাহন চলল কি না, কর্মস্থলে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে কি না, সে সব প্রশ্ন অবান্তর।
বৈপরীত্য। বনধ-বিলাসেই গা ভাসাল মহানগর। কাজের দিনে জনশূন্য এসপ্ল্যানেড। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
এ দিন তাই বাস চালানো কার্যত বৃথা গিয়েছে বেসরকারি মালিকদের। বড়সড় গোলমালও হয়নি, যা দেখে মানুষকে ভয়ে ঘরে ঢুকে পড়তে হবে। সকালেই টিভি’তে পরিস্থিতির একটা আঁচ মিলেছিল। তা সত্ত্বেও বেলা গড়ানোর সঙ্গে বাস-মিনি-অটো-মেট্রোয় যাত্রী কমেছে। খরচে পোষাচ্ছে না দেখে ক্রমে অনেক বাস-মিনি-অটো বসে গিয়েছে। রাস্তাঘাট হয়েছে শুনশান, যেমনটি হয় ছুটির দিনে!
উল্টোটাও অবশ্য দেখা গিয়েছে। সেটা সরকারি অফিসে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারির শিল্প ধর্মঘটে অফিসে না-এসে অনেককে বিপাকে পড়তে হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতাই এ দিন কর্মীদের বড় অংশকে অফিসমুখো হতে বাধ্য করেছে। সরকারি দফতরে তাই হাজিরার ছবিটা বেশ উজ্জ্বল। মহাকরণের বিভিন্ন দফতর বেলা সাড়ে এগারোটার মধ্যে জমজমাট! কর্তারা জানাচ্ছেন, এ দিন মহাকরণের হাজিরা তুলনায় কিছুটা বেশিই। কর্মীদেরও বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী অফিসে না-এলে বেতন কাটার কথা বলায় অনেকে ঝুঁকি নেননি। সল্টলেকের বিভিন্ন সরকারি অফিসেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
‘ভূতের ভবিষ্যতে’ মজে থাকা বাঙালির ‘বর্তমান’ পরিবর্তন বলতে এটুকুই। এবং সেটা নেহাতই চাপে পড়ে।
বনধ সমর্থক নেতাদের দাবি: মূল্যবৃদ্ধির চাপে নাজেহাল মানুষ প্রতিবাদের ভাষা খুঁজেছেন এই বনধে। তা হলে দিল্লি বা আমদাবাদ এ দিন কলকাতার মতো ‘নির্জীব’ হয়ে পড়েনি কেন? এখানকার তুলনায় ওখানে তো বিজেপি সমর্থক যথেষ্ট বেশি! ব্যাখ্যা একটাই বাঙালির মতো বনধ-মানসিকতা ওখানকার মানুষের নেই।
আর তাই ভারত বনধের দিনে ‘কর্মহীনতা’র নিরিখে অন্যান্য মেট্রোপলিসের চেয়ে কলকাতা কিছুটা এগিয়েই। মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে যথেষ্ট পুলিশ রেখেও মানুষকে সে ভাবে বারমুখো করা যায়নি। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, শ্যামবাজার বা এপিসি রোড ভরা ‘অফিসটাইমেও’ বাস-ট্রাম প্রায় ফাঁকা! বড়বাজার-শ্যামবাজার-হাতিবাগান-চাঁদনি-গড়িয়াহাট-লেক মার্কেটে অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ! হাতে গোনা যে ক’টা দোকান খোলা ছিল, তারা কার্যত মাছি তাড়িয়েছে। বিমানবন্দরেও অন্য দিনের তুলনায় যাত্রী ছিল কম। বিমানসংস্থা সূত্রের খবর: ‘ঝুঁকি’ এড়াতে অনেক যাত্রী টিকিট বাতিল বা যাত্রার দিন বদল করেছিলেন। যাত্রীর অভাবে এ দিন স্পাইসজেটের গুয়াহাটি উড়ান ও এয়ার ইন্ডিয়ার ভুবনেশ্বর উড়ান বাতিল হয়েছে। আগরতলা-গুয়াহাটি রুটে ওড়েনি জেট। যাতায়াতের অসুবিধে কিন্তু বিশেষ ছিল না।
ট্যাক্সি কম থাকলেও বিমানবন্দর থেকে শহরে আসা-যাওয়ার বড় বাস স্বাভাবিক ভাবে চলেছে। ছিল বিলাসবহুল ট্যাক্সিও।
অথচ হাজিরার ফরমানে কর্মব্যস্ত মহাকরণ। ছবি: রাজীব বসু।
বিক্ষিপ্ত ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়। লোকাল ট্রেন অবরোধ বা যানবাহনে আক্রমণও হয়েছে। ভোরে বঙ্কিম সেতুতে দাঁড়ানো একটি বাসে আগুন লাগানো হয়েছিল। সকাল ন’টায় ইস্ট-ওয়েস্ট বাইপাসে জ্বালানো হয় ৫৭ নম্বর রুটের একটি বাস। ওই সময়েই কিছু বনধ সমর্থক হাওড়া ব্রিজ অবরোধ করে, আধ ঘণ্টা বাদে পুলিশ তাঁদের সরায়। বারাসতের চাঁপাডালি মোড়, রথতলা ও ১১ নম্বর রেলগেট এলাকায় ছ’টি বাস ভাঙচুর হয়।
কিন্তু নেহাতই বিক্ষিপ্ত ক’টি ঘটনা তো রাজ্যকে বা তামাম মহানগরকে নির্জীব করে দিতে পারে না, যদি মানুষ ‘ছুটির মেজাজ’ কাটিয়ে বার হন! তা ছাড়া প্রতিবাদ-প্রতিরোধে কি দমানো যায় না এই অশান্তির প্রবণতা?
যায় যে, বছর দুয়েক আগে বামুনগাছি স্টেশনে আটকে পড়া এক রুগ্ণ শিশুর বাবার ‘একক’ প্রতিবাদই তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। তার পরে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে এমন দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছে। এ দিনও অবরোধ-হামলার ‘সংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ উঠেছে বেশ কিছু জায়গায়। যেমন, উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগরে ট্রেন-রোখা জনা পাঁচেক অবরোধকারীকে তাড়া করেছিলেন ডাউন কৃষ্ণনগর লোকালের যাত্রী এক মহিলা-সহ কয়েক জন। অবরোধকারীরা চম্পট দেয়। কোন্নগর স্টেশনে বনধ সমর্থকেরা সকাল ছ’টা নাগাদ লাইনে বসে পড়েছিল। নিত্যযাত্রীদের ক্ষোভের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কৃষ্ণনগরের জোড়াকুঠি মোড়ে বনধ সমর্থকেরা পথচলতি গাড়িতে ইট-পাটকেল ছুড়ছিল। শেষে স্থানীয় মানুষই লাঠি নিয়ে তাদের ধাওয়া করেন।
অর্থাৎ, অল্প কিছু লোকের সঙ্ঘবদ্ধ বাধাকে যে আমজনতার সম্মিলিত প্রতিবাদের অস্ত্রে দূরে সরানো যায়, তারও প্রমাণ এ দিন বঙ্গবাসীর সামনে উঠে এসেছে। তবু পথে নামানো যায়নি ‘ছুটিবিলাসী’ আমবাঙালিকে। তবে এ হেন কর্মবিমুখ মানসিকতার উল্টো স্রোতে হেঁটে আশার ক্ষীণ আলো জ্বালিয়ে রেখেছে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে যুক্ত নবীন প্রজন্ম। কী ভাবে?
সরকারি কর্মীদের মতো চাপে পড়ে নয়, ওঁদের অধিকাংশ এ দিন অফিস করেছেন নিজের ইচ্ছেয়। আইটি’র অনেক ক্ষেত্রে এমন ‘বিশেষ’ দিনে বাড়ি বসে কম্পিউটারে কাজ করেও হাজিরা দেওয়া যায়। কিন্তু বন্ধ উপেক্ষার তাগিদেই অধিকাংশ কর্মী অফিসে এসেছিলেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির সংগঠন ন্যাসকম-এর পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা সুপর্ণ মৈত্রের দাবি, “হায়দরাবাদ, চেন্নাইয়ের মতো কলকাতায় সেক্টর ফাইভের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পাঞ্চলে এ দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম হয়েছে।” একই ভাবে বনধের পরোয়া না-করে বনগাঁর পেট্রাপোলে সীমান্ত-বাণিজ্য চলেছে পুরোদমে।
এ বারই প্রথম।
বোধোদয় হয়েছে পাহাড়েও। এনডিএ-র ডাকা ভারত বনধের বিরোধিতায় নেমে দার্জিলিং পাহাড়কে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রেখেছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। পর্যটকেরা অবাধে যাতায়াত করেছেন। মোর্চার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরাও।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.