পুণ্যের টানে মাঝরাতে মাছ ধরা নৌকোয় ভাগীরথী পেরোচ্ছিলেন সতেরো জন। অতিরিক্ত যাত্রীর ভার সইতে না পেরে উল্টে গেল নৌকা। শনিবার দু’জনের মৃতদেহ মিলেছে। নিখোঁজ দেড় বছরের একটি শিশু-সহ চার জন।
হুগলির কোন্নগরে শতাধিক বছরের পুরনো শকুনতলা কালীবাড়িতে বৈশাখ মাসে কৃষ্ণপক্ষের শনিবার রক্ষাকালী পুজো হয়। আগের রাত থেকেই নানা জেলার পুণ্যার্থীরা প্রতিমার বেদিতে জল ঢালতে ও দণ্ডী কাটতে আসেন। যাত্রী বহনের উপযোগী নয় এমন বহু নৌকাতেও নদী পেরিয়ে বহু পুণ্যার্থী আসেন। তা আটকানো দূরস্থান, নজরদারিরও ব্যবস্থা নেই। হাতেনাতে তারই ফল মিলল শুক্রবার রাতে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উত্তর ২৪ পরগনার সুখচরের বাজারপাড়া ঘাট থেকে চারটি মাছ ধরার নৌকায় অবৈধ ভাবে চলছিল পারাপার। রাত সওয়া ১টা নাগাদ দুই মাঝি-সমেত একটি নৌকা ১৯ জনকে নিয়ে কোন্নগরের বারো মন্দির ঘাট থেকে প্রায় তিনশো মিটার দূরে উল্টে যায়। বেশির ভাগই সাঁতরে পাড়ে ওঠেন। |
ঘাটে থাকা কিছু লোক এবং কাছাকাছি থাকা কয়েকটি জেলে নৌকা কয়েক জনকে উদ্ধার করে। কিন্তু একটি শিশু-সহ ৬ জনের
খোঁজ মেলেনি।
এ দিন দুপুরে উত্তর ২৪ পরগনার খড়দহে শ্যামসুন্দর ঘাটের কাছ থেকে সুখচরের পঞ্চাননতলার বাসিন্দা পম্পা মণ্ডলের (১৯) দেহ মেলে। হুগলির উত্তরপাড়া কোতরংয়ে বটতলা ঘাটের কাছ থেকে মেলে সুখচরেরই কুলিনপাড়ার বাসিন্দা টুসি সর্দারের (২২) দেহ। সন্ধ্যা পর্যন্ত তল্লাশি চালিয়েও খোঁজ মেলেনি টুসির বোন তাপসী সর্দার ওরফে রুমকি, কুলিনপাড়ার মিহির দে ওরফে ভোলা, তাঁর শ্যালকের দেড় বছরের মেয়ে কঙ্কা মণ্ডল এবং সুখচরের আমবাগান এলাকার অভিজিৎ মণ্ডলের। উদ্ধার হওয়া দুই মহিলা উত্তরপাড়া স্টেট জেনারেল এবং কোন্নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মাঝিদের পুলিশ ধরতে পারেনি।
অতিরিক্ত যাত্রীর ভারে এর আগে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে কোলাঘাটের কাছে রূপনারায়ণ নদীতে, সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মুড়িগঙ্গায়, অক্টোবরে ঘোড়ামারা দ্বীপের কাছে নৌকো উল্টেছিল। কিন্তু তার পরেও পুলিশ-প্রশাসন নির্বিকার। শুধু তা-ই নয়,
সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা গড়ে তোলা যায়নি।
দেড় বছরের মেয়ে ভেসে গিয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপির বুলটি মণ্ডলের। তাঁর আক্ষেপ, “বেশি যাত্রী তোলা নিয়ে আমরা আপত্তি জানালেও মাঝিরা শোনেননি। নদীতে ঢেউ ছিল। হঠাৎ দেখি, নৌকায় জল ঢুকছে। আমরাই জল ফেলতে শুরু করি। কিন্তু টাল সামলানো যায়নি। নৌকা উল্টে গেল। মেয়েটা যে কোথায় হারিয়ে গেল, খুঁজে পেলাম না!” আর এক যাত্রী ইন্দ্রজিৎ মণ্ডলও বলেন, “মাথাপিছু ১৫ টাকা ভাড়া দিয়ে ১৭ জন নৌকায় উঠেছিলাম। ছোট নৌকায় এত যাত্রী তোলায় আপত্তি জানাই অনেকেই। মাঝিরা কান দেননি। ঘাটে ভিড় থাকায় তাঁরা তাড়াতাড়ি নৌকা ছেড়ে দেন। মাঝনদীতে দুর্ঘটনা হলে আরও বড় বিপর্যয় হত।”
এ দিন বেলা ১১টার মধ্যে কলকাতা পুলিশের ৮ জন এবং অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতরের ৬ জন ডুবুরি কোন্নগরে চলে আসেন। কিন্তু তল্লাশিতে নামতে তাঁদের প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এই বিলম্ব নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনই প্রশ্ন রয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও। শ্রীরামপুরের মহকুমাশাসক মুক্তা আর্যের বক্তব্য, নৌকার অভাবে ডুবুরি নামাতে কিছুটা দেরি হয়। হুগলির পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরীর দাবি, “রাতে জেলা পুলিশের টহলদারি লঞ্চ কোন্নগরের ঘাটের কাছে ছিল। দুর্ঘটনার কবলে পড়া দু’জনকে লঞ্চের পুলিশকর্মীরাই উদ্ধার করেন।”
পুলিশের টহলদার লঞ্চ থাকলে জেলে নৌকোয় কী ভাবে যাত্রী পারাপার চলছিল, সে প্রশ্নের অবশ্য সদুত্তর মেলেনি। হুগলি জেলা পুলিশের এক কর্তা দাবি করেছেন, বিপর্যয় মোকাবিলা এবং অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতরের কর্মীদের সক্রিয় করার জন্য জেলা প্রশাসনকে বারবার বলা হয়েছে। কিন্তু এখনও কাজের কাজ কিছু হয়নি।
বেলঘরিয়ার অতিরিক্ত ডেপুটি পুলিশ কমিশনার বিশ্বজিৎ ঘোষের বক্তব্য, “নদীতে নৌকো পারাপার দেখার কথা রিভার ট্রাফিক পুলিশের। বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলা
হবে। মাঝিদের বিরুদ্ধে খড়দহ থানায় ইতিমধ্যেই অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তার ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হচ্ছে।” |