কর্মসংস্কৃতি এবং পেশাদারি মনোভাব ঠিক ভাবে মেলাতে পারলে তবেই সাফল্য মিলবে। অবশেষে সে কথা বুঝতে পারলেন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। আন্তর্জাতিক মানের পরিষেবা দেওয়ার লক্ষ্যে কলকাতার নতুন টার্মিনালের রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য বেসরকারি সংস্থার দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। পাশাপাশি, কর্মসংস্কৃতিতেও যে বদল আসছে, তা-ও স্পষ্ট এ ব্যাপারে কর্মী-ইউনিয়নগুলির বক্তব্যে। আগে বিরোধিতা করলেও এখন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত তাঁরাও।
এ দিন ভারত চেম্বার অফ কমার্সের এক অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের উত্তরে বিমানবন্দরের অধিকর্তা বি পি শর্মা বলেন, “নতুন টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমাদের কিছু কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। জুলাই মাস থেকে সেই প্রশিক্ষণ শুরু হবে। আর তাঁদের সঙ্গে পেশাদার সংস্থার কর্মীদেরও নিয়োগ করা হবে।”
এখানেই শেষ নয়। এত দিন যে কর্মী-ইউনিয়ন বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধাচরণ করে এসেছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাই এখন এগিয়ে এসেছে কর্তৃপক্ষের পাশে। ইউনিয়নের তরফেই বলা হচ্ছে, নতুন টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য কর্মীদের মধ্যে যাঁরা কম বয়সী, অনেক বেশি চনমনে, তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক। পাশাপাশি, পাঁচতারা হোটেলের পরিচ্ছন্নতা যাঁরা বজায় রাখেন, সেই পেশাদার সংস্থাকে নিয়োগ করা হোক নতুন টার্মিনালে। অথচ, মাস চারেক আগে বর্তমান টার্মিনালের পরিচ্ছন্নতার ভার এমনই এক পেশাদার সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার যে প্রস্তাব বিমানবন্দরের অধিকর্তা বি পি শর্মা রেখেছিলেন, তা এক কথায় উড়িয়ে দিয়েছিল এই ইউনিয়ন।
তা হলে কী এমন ঘটে গেল চার মাসে?
কর্মী-ইউনিয়নের সম্পাদক দীপঙ্কর ঘোষ বুধবার বলেন, “নতুন টার্মিনাল তুলনায় অনেক বড়। আমাদের কর্মীদের দিয়ে তা রক্ষণাবেক্ষণ করা বাস্তবে সম্ভব নয়। আমরা চেয়েছিলাম, বাইরের সংস্থাকে দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ না করিয়ে কর্মী নিয়োগ করে করা হোক। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সেই সময় আমাদের হাতে নেই। নিজেদের কর্মী নিয়োগ করলে আর্থিক দিক থেকেও লোকসান হবে কর্তৃপক্ষের। তাই অধিকর্তার এই সিদ্ধান্তকে আমরা এখন সমর্থন করছি।” দীপঙ্করবাবু আরও জানান, তুলনায় যাঁরা বয়স্ক, তাঁদের রেখে দেওয়া হবে বর্তমান টার্মিনালে। কারণ, সমস্ত উড়ান এখনই নতুন টার্মিনাল থেকে চালু হবে না। বর্তমান টার্মিনালও বেশ কিছু দিন চালু রাখতে হবে।
তৃণমূল ইউনিয়নের নেত্রী দোলা সেনেরও বক্তব্য, “আমরা এক বছর ক্ষমতায় এলেও বিমানবন্দরে কোনও দাবি নিয়ে একটি পোস্টার মারিনি, দলীয় পতাকাও টাঙাইনি। কলকাতা বিমানবন্দর রাজ্যের এমনই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, যেখানে পা দিয়েই মানুষ এ রাজ্য সম্পর্কে প্রথম ধারণা তৈরি করে ফেলেন। ফলে সেই বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক মান ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলেরই। কর্মীদের কোনও দাবি থাকলে তা ত্রিপাক্ষিক বৈঠক করে সমাধান করতে হবে।”
রাজনৈতিক ও শিল্প মহলের মতে, কলকাতায় নতুন টার্মিনাল চালু হলে এবং রাজ্যের শিল্পের ছবিটা একটু পরিবর্তন হলেই নতুন নতুন বিমান সংস্থা কলকাতায় আসবে। কলকাতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, ক্যাথে প্যাসিফিক এবং লুফৎহানসাও রয়েছে সেই তালিকায়। দীপঙ্করবাবু বলেন, “দিল্লি, মুম্বই-সহ দেশের অন্য বিমানবন্দরগুলি যখন বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, তখন আমরাই লড়াই করে এই টার্মিনালের দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছি। তার যদি বদনাম হয়, তা হলে দায়ভারও আমাদের উপরেই বর্তাবে।” এর অর্থ শুধু কর্তৃপক্ষই নন, ইউনিয়নও অনুধাবন করেছে যে, নতুন টার্মিনালের পরিচ্ছন্নতার চিত্রটাও যদি বর্তমান টার্মিনালের মতো দাঁড়ায়, তা হলে লজ্জার অন্ত থাকবে না কর্মীদের।
কলকাতা বিমানবন্দরের যে অভ্যন্তরীণ ভবন দিয়ে যাত্রীরা এখন যাতায়াত করেন, তার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে হাজার অভিযোগ রয়েছে। বিদেশের, এমনকী দেশের অনেক বিমানবন্দরের সঙ্গে তুলনা টেনে বলা হয়, শৌচালয় ব্যবহারের অযোগ্য। মেঝেতেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে নোংরা। কর্তৃপক্ষের যুক্তি ছিল, যাত্রীদের ভিড় এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, তুলনায় কম সংখ্যক কর্মী নিয়ে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা যাচ্ছে না। এর মধ্যেই অবশ্য বিমানবন্দরের অধিকর্তা বি পি শর্মা বাইরের পেশাদার সংস্থাকে দিয়ে এই ভবন সাফাইয়ের প্রস্তাব রেখেছিলেন। কিন্তু, কর্মী-ইউনিয়নের চাপে তা ধোপে টেকেনি। |