হিল্লি ক্লিন্টার!
আমেরিকার বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টনের নামটা অনেক চেষ্টাতেও ঠিকঠাক মুখস্থ হয়নি মেয়েটির। তা বলে ডাকসাইটে ‘মেমসাব’-এর সামনে ক্যারাটের প্যাঁচ দেখাতে এতটুকু ঘাবড়ায়নি বিহারের অখ্যাত গাঁয়ের দেহাতি কিশোরী। আরারিয়ার নিষিদ্ধপল্লির ‘বন্দি-জীবনে’ মেয়েটির মা একদা ঢের কষ্ট পেয়েছিলেন। নির্ভয়ে এগিয়ে গিয়ে সেই কিশোরীই হিলারির হাতে নারী পাচার-বিরোধী প্রচারের ‘ব্যান্ড’ তুলে দিল।
খিদিরপুরের সদ্য আঠারো পেরনো তরুণীর অবশ্য একটু আফশোস থেকে গিয়েছে। তাঁর মা-ও একদা নিষিদ্ধপল্লির ফাঁদে পড়েছিলেন। ইংরেজি বলতে না-পারলেও আমেরিকা থেকে আসা ‘ম্যাডাম’কে কয়েকটি কথা বলার জন্য দুপুর থেকেই ছটফট করছিলেন ওই তরুণী। হিলারির সঙ্গে পরিচয়ের পরে মেয়েটি বলছিলেন, “ম্যাডামকে বলেছি, লাল-বাতি এলাকা কেন সব জায়গা থেকে উঠে যেতে পারে না? কিন্তু মেয়েদের বিক্রি করা বা ছোট বয়সে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলার ফুরসত হল না।”
নিষিদ্ধপল্লির ‘ফাঁদ’ থেকে লড়াই করে বেরনো আরারিয়া ও কলকাতার দুই মেয়ে এখন ক্যারাটে আর ভিডিওগ্রাফিতে চৌকস। তাদের জড়িয়ে ধরে মার্কিন বিদেশসচিব বলে গিয়েছেন, “তোমাদের সাহসটাই এক দিন দুনিয়াকে পাল্টে দেবে।” |
আইসিসিআরে। রাজীব বসুর ছবি। |
কূটনৈতিক সফরের বাঁধাধরা আদব-কায়দা ছাপিয়ে হিলারি ক্লিন্টনকে ঘিরে রবিবার বিকেলে এমন বেশ কয়েকটি ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো মুহূর্ত তৈরি হল। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস (আইসিসিআর)-এর ভবনে প্রায় ঘণ্টাখানেক ছিলেন হিলারি। ছিলেন পাচার-চক্রের শিকার এক ঝাঁক কিশোরী-তরুণী, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কয়েক জন কর্মী ও গ্রাম-বাংলার কিছু লোকশিল্পী। কার্যত জনশূন্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা পাঁচতারা হোটেলে নিরাপত্তার বেড়াজালে হিলারিকে চোখের দেখাটুকুও দুর্লভ ছিল আমজনতার জন্য। আইসিসিআর-এই বরং প্রাক্তন মার্কিন ফার্স্ট লেডির কিছুটা কাছাকাছি আসতে পারল এ শহর।
অবশ্য হিলারি ঢোকার সময়ে এখানেও নিরাপত্তা আধিকারিকদের তত্ত্বাবধানে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হল সকলকে। মার্কিন বিদেশসচিব কখন কোথায় যাবেন, কে কখন তাঁর কাছাকাছি থাকবেন বা কারা তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাবেন সব কিছুই নিপুণ চিত্রনাট্যের মতো ছকে দিয়েছিল আমেরিকার নিরাপত্তা সংস্থা। কিন্তু হিলারি নিজেই সেই ছক বারবার ওলটপালট করে দিলেন। মৌসুমী ভৌমিকের ‘আমি শুনেছি সে দিন তুমি’ গানের সঙ্গে নাচ দেখে মার্কিন বিদেশসচিব বলে উঠলেন, “দ্যাট ওয়জ ওয়ান্ডারফুল! আমি তো ঘোরের মধ্যে ছিলাম!’ ‘ডান্স মুভমেন্ট থেরাপি’-র মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানো ওই তরুণী-শিল্পীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আলাপ করলেন হিলারি। নারী-পাচার বিরোধী পটচিত্র ও নিজের বাঁধা গান নিয়ে হাজির পিংলার নয়াগ্রামের বধূ স্বর্ণ চিত্রকরের সঙ্গে আলাপচারিতাও অন্তরঙ্গ মুহূর্ত তৈরি করল। ভবনে সাজানো ধাতব দুর্গামূর্তি বা রামকিঙ্করের গড়া রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যটিও চোখ এড়ায়নি হিলারির। সাগ্রহে তাদের খুঁটিনাটি জেনে নিলেন তিনি।
নারী-শিশু পাচার বা লিঙ্গবৈষম্য রোধে কাজ করছেন এমন ন’টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীদের সঙ্গে এ দিন কথা বলে তাঁদের উৎসাহ জুগিয়েছেন হিলারি। সেখানে অবশ্য সংবাদমাধ্যমের থাকার অনুমতি ছিল না। তবে হিলারির সঙ্গে আলাপ শেষে আপ্লুত সোহিনী, রুচিরা, উর্মি-রা। হিলারি তাঁদের বলে গিয়েছেন, ‘‘তোমরা একা নও। আরও সংগঠিত হও। এই লড়াইয়ে আরও বহু চিয়ারলিডার অলক্ষে তোমাদের পাশে দাঁড়িয়ে!’’
|