|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় গল্প |
হেড স্যারের আয়না |
উল্লাস মল্লিক |
আশ্চর্য, আয়নাটা এখনও আছে! আধ মানুষ সমান সেই আয়নাটা। আমরা বলতাম হেড স্যারের আয়না। হেড স্যারের ঠিক পিছনে একটু উঁচু করে টাঙানো ছিল দেওয়ালে। চার ধার সেগুন কাঠে বাঁধানো, ম্যাড়মেড়ে পালিশ। ওখানে আয়না কেন, কোথা থেকে এল জানি না। জানার ইচ্ছেও হয়নি কোনও দিন। স্যরের ঘরের চেয়ার-টেবিল-আলমারির মতো আয়নাটাও ছিল। ঘণ্টা বাজানো বিশুদা চেয়ার-টেবিল ঝাড়ার সময় ওটাকেও পরিষ্কার করত। হেড স্যারের ঘরে ডাক পড়লে যখন গুটিগুটি পায়ে টেবিলের সামনে দাঁড়াতাম, কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে পেতাম আয়নায়। যদিও সময়টা তখন ঠিক নিজের রূপ দেখার মতো নয়। হেড স্যারের ‘কল’ বলে কথা। বুকের ধুকপুকুনিটা নিজের কানেই কেমন বেখাপ্পা লাগছে। স্যারের হাতে যদিও মার খাইনি কখনও; কেউ খেয়েছে বলে শুনিনি। কিন্তু ভরাট গলায় যখন সোজা তাকিয়ে বলতেন, ‘টুবলু, টিফিন আওয়ারে মুখুজ্জেদের বাগানে আম পেড়েছিস, ওরা তো তোর নামে কমপ্লেন করেছে... কী রে টুবলু, চুপ কেন...’। তখন প্রাণপণ চেষ্টা করেও হাঁটুর ঠকঠকানি থামাতে পারতাম না। ঢোঁক গিলে এমন ভাবে মাথা নাড়তাম যার অর্থ ‘হ্যাঁ’, ‘না’ দুটোই হয়।
পিন্টু অবশ্য বলত, ‘ফোট, ভয়ের কী আছে!’ পিন্টু চিরকালের বেপরোয়া। হাত দিয়ে হেলে সাপ ধরে, রাতে দামু ঘোষের নারকেল গাছে চুপিচুপি উঠে নারকেল পেড়ে আনে, অঙ্কে তিন, ইংরিজিতে সাত পেলেও চুনির মাঠে ওয়ান ডে টুর্নামেন্ট খেলতে চলে যায়। থাকে হেড স্যারের বাড়ির ঠিক পাশে। হেড স্যারকে জেঠু বলে। জেঠিমা ওকে দিয়ে বাজার থেকে কাঁচালঙ্কা, মুসুর ডাল, পাকা তেঁতুল আনায়। জেঠু নাকি একটা দুটো জিনিস ঠিক ভুলে যাবেই। জেঠিমা তখন বলে, ‘বাবা পিন্টু, আট আনার বিট নুন এনে দে তো বাবা, তোর জেঠুকে কত বার করে বললুম... এই লোকটাকে নিয়ে আমার হয়েছে জ্বালা, একটা কথা যদি মনে রাখতে পারে।’
সবই ঠিক। কিন্তু হেড স্যার ভুলে যান বিশ্বাস করি কী করে! যে মানুষটা জিরানডিয়াল ইনফিনিটিভ প্রাঞ্জল ভাবে বুঝিয়ে দেন, বই না দেখে সেলফিশ জায়েন্ট লাইন বাই লাইন বলে দিতে পারেন, ট্রাংকুইলিটি, ডায়রিয়া, কমিটি কিংবা অ্যাসাসিনেশন বানান যাঁর ঠোঁটস্থ, তিনি ভুলে যাবেন সামান্য বিট নুন! স্যার নাকি আবার জেঠিমাকে ভয়ও পান খুব। আমি বলি, ‘ভ্যাট!’ ‘কী ভ্যাট!’ পিন্টু একটু উত্তেজিত ভাবে বলে, ‘আজ সকালেই তো জেঠিমা কত কথা শোনাল তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না... একটা মেয়েরও বিয়ে দিতে পারলে না এখনও... কবে থেকে বলছি একটা টেপা কল বসাও উঠোনে, বড় বড় মেয়েরা অত দূর থেকে জল আনতে যায়...। স্যার নাকি তখন চুপচাপ সরষের তেল মাখছিল ঘষে ঘষে, একটা উত্তরও দিতে পারেনি। |
|
তার পর থেকে স্যারকে লক্ষ করি খুঁটিয়ে। ব্যাক ব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুল, মোটা গোঁফ, পুরু চশমা, চলাফেরা কথা বলায় কোথাও ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। আমরা তো আমরা অন্য স্যারেরা পর্যন্ত কেমন থতিয়ে থাকেন সামনে, ছুটি বেলায় ‘আসছি স্যার’ বলে বাড়ি যান। ওই যে হিমাংশু স্যার, প্রচণ্ড রাগী আর ভীষণ মারকুটে, পান থেকে চুন খসলেই বেতের ঘা, সেই হিমাংশু স্যার পর্যন্ত মাথা নিচু করে কথা বলেন স্যারের সামনে। পিন্টু বলল, আরে হবেই তো, হিমাংশু স্যার হেড স্যারের ছাত্র, এই ইস্কুলেই পড়েছে যে!
তবে খুব একটা জোর সংবাদ দিল পানতুয়া। ভাল নাম অবশ্য সুজিত। কিন্তু কেউ ডাকত না সুজিত বলে। নামটার পিছনে নানা গুজব। প্রথমে শুনেছিলাম, পানতুয়া খেতে খুব পছন্দ করে ও, তাই পানতুয়া। আবার শুনলাম, ওর আধ পাগলাটে বাবা কবে নাকি কোন মিষ্টির দোকান থেকে পানতুয়া চুরি করে খেয়েছিল। বাবাই এক দিন বলল, ‘ও সব বাজে কথা, আসল কথা শোন, ওর মায়ের কাছে গণেশ হালদার এক সময় রোজ সন্ধেবেলা পানতুয়া নিয়ে যেত, তার পর পানতুয়াকে পানতুয়া দিয়ে ভুলিয়ে...’। কারও বাড়ি পানতুয়া নিয়ে গিয়ে বাড়ির ছোট ছেলেটাকে দেওয়ার মধ্যে গণ্ডগোলটা ঠিক কোথায় বুঝিনি সে দিন, তবে দেখেছিলাম শ্যামল আর অমিত এক চোখ বুজে হাসছে। নামকরণের প্রকৃত রহস্য আজও জানি না, কিন্তু একটা জিনিস দেখতাম, গণেশ হালদারকে খুব অপছন্দ করে পানতুয়া। এক দিন আমাকে বলেছিল, ‘লোকটা বহুত হারামি বুঝলি, দাঁড়া না, কারাটে ইস্কুলে ভর্তি হই, তার পর এমন দেব শালাকে...!’ সে যা-ই হোক, পানতুয়া এক দিন খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘হিমাংশু স্যার ইতিহাসের রুনাদির সঙ্গে লাইন করে।’ লাইন করার অর্থ তখন যে একদম বুঝি না তা নয়; জানি, প্রকাশ্যে গলা তুলে আলোচনা করার মতো সাবজেক্ট নয় এটা। তাই চাপা গলায় বললাম, ‘ভ্যাট!’ বললাম বটে, কিন্তু কৌতূহল হচ্ছিল খুব। একই রকম আত্মবিশ্বাসের পানতুয়া বলল, ‘পরে মিলিয়ে নিবি, হিমাংশু স্যার ডেলি বিকেলে যায় রুনাদির বাড়ি, বিলাসপুরে আমার মাসির বাড়ির পাশেই তো রুনাদির বাড়ি।’ রুনাদিদের বাড়ি নাকি বাঘের মতো অ্যালসেশিয়ান কুকুর আছে একটা, রুনাদির দাদা কোর্টের উকিল, বাড়ির উঠোনে রুনাদি কত ফুলগাছ করেছেন, পানতুয়ার মাসির বাড়ির ছাদে দাঁড়ালে নাকি রুনাদিদের উঠোন স্পষ্ট দেখা যায়। এত পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য যে দিতে পারে, তার কথা অবিশ্বাস করার উপায় থাকে না। বিশেষ করে, মন যখন চাইছে বিশ্বাস করতে। মন তো খুব করে বলছে সব, সব যেন সত্যি হয় স্যার দিদিমণিরাও তা হলে...। ‘স্যার’ মানে তো জানি বাংলা-ইংরেজি-অঙ্ক-ভূগোলের তাবৎ জ্ঞান গুলে খাওয়া, নীতিকথার বইয়ের সব উপদেশগুলো কাঁটায় কাঁটায় মেনে চলা, ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’ শপথ নেওয়া এক অলৌকিক সৃষ্টি; তাদেরও তা হলে হৃদয় দৌর্বল্য জন্মায়। পর দিন স্কুলে গিয়ে খুব মন দিয়ে লক্ষ করছিলাম, হিমাংশু স্যার অক্ষরেখা-দ্রাঘিমারেখার পার্থক্য বোঝাচ্ছিলেন; রুনাদি অজন্তা ইলোরার গুহাচিত্রের খুঁটিনাটি; দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, এঁরা রোজ বিকেলে পরস্পর ঠিক কী নিয়ে কথা বলেন!
ক্লাস নাইনে ওঠার পরেই, পানতুয়াকে অভ্রান্ত প্রমাণ করে, হিমাংশু স্যা র আর রুনাদির বিয়ে হয়ে গেল। তার পর অন্য ইস্কুলে চাকরি পেয়ে চলে গেলেন হিমাংশু স্যর। ততদিনে অবশ্য আমাদের সবার কাছে ‘লাইন’ ব্যাপারটা একেবারে ক্লিয়ার, কোথাও কোনও ঝাপসা ব্যাপার নেই। নাইন থেকেই কো-এড যে! ক্লাসে জ্বলজ্যান্ত ছাব্বিশটা মেয়ে। ক্লাসটার ভোল বদলে গিয়েছে রাতারাতি। যেমন তেমন জামা প্যান্ট পরে আর ইস্কুলে যাওয়া যায় না। চুল আঁচড়াতে অনেকটা সময় লাগে। মাঝে মাঝেই মেয়ে বেঞ্চের দিকে আড়চোখে তাকাই আর আন্দাজে মাথায় হাত দিয়ে চুল ঠিক করে নিই। আর এমনই কপাল, ঠিক রোল নাম্বার ফিফটি টু-এর সঙ্গে ঠোকাঠুকি হয়ে যায়। রোল নাম্বার ফিফটি-টু মানে অনসূয়া দত্ত। ফর্সা রং, কোঁকড়ানো মাথার চুল, আদুরে ঠোঁট, আর ঢুলুঢুলু চোখ। একেবারে সোজা তাকায়। চোখে চোখে ঠোকাঠুকি কেমন যেন একটা বুরবক গোছের মনে হয় নিজেকে। সঙ্গে সঙ্গে পিছনের দেওয়ালটা দেখি। নেহাতই সাদা চুনকাম করা আর পাঁচটা দেওয়ালের মতই দর্শনীয় কিছু নেই, তবুও খুব মনোযোগ দিয়ে দেখি। আর ওই সাদামাটা দেওয়ালই এক দিন হইচই ফেলে দিল খুব। বড় বড় করে লেখা, অনসূয়া+রণজিৎ নন্দী। রণজিৎ নন্দী মানে, ফিজিক্যাল এডুকেশনের রণজিৎ স্যার। প্যান্টের ভেতর গুঁজে জামা পরেন, কায়দা করে চুল আঁচড়ান, গায়ে সব সময় সেন্টের গন্ধ। সবাই বলত ফাঁটবাজ। কী করে কে জানে, সন্দেহভাজনদের তালিকায় আমার নামটাও ঢুকে গেল। ব্যস, অমনি হেড স্যারের ঘরে ‘কল’। গিয়ে দেখলাম, অনসূয়া দাঁড়িয়ে আছে সামনে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে। মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম সবাই। মাঝে মাঝে শুধু টুক করে আয়নায় দেখে নিচ্ছি অনসূয়াকে আর হেড স্যারের গম্ভীর গলা শুনছি ঠিক করে বল কে করেছে... কী রে টুবলু, চুপ কেন, মনে হচ্ছে তুই জানিস, না হলে সবাইকে কিন্তু রাস্টিকেট করে দেব স্কুল থেকে!
কেউ ধরা পড়ল না, কেউ রাস্টিকেটও হল না, এক দিন ইস্কুলে এসে দেখলাম সাদা চুনের এলোমেলো আঁচড় টেনে কেউ মুছে দিয়েছে লেখাগুলো। পানতুয়া শুধু চুপিচুপি আমাকে বলল, ‘হতে পারে বুঝলি, রণজিৎ স্যারটা লুজ ক্যারেক্টার, ব্যায়াম শেখানোর সময় মেয়েদের গায়ে হাত দেন। ছুটির পর এক দিন অনসূয়ার সঙ্গে সরু বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন।’ আমাদের সরু বারান্দা অবশ্য মোটেই সরু নয়। বরং অন্য দুটো বারান্দার মতোই হবে প্রস্থে। পশ্চিমমুখো বলে আলো কম। তার ওপর সামনের ঝাঁকড়া বকুল গাছ আরও অন্ধকার করে দিয়েছে জায়গাটা। ও দিকে বিশেষ যায় না কেউ। ভাঙা চেয়ার-টেবিলে ঠাসা। ছুটির পর ওই নিরিবিলি জায়গায় কেউ গল্প করলে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। হঠাৎ পানতুয়া খুব সন্দিগ্ধ গলায় বলল, ‘টাবলু, সত্যি করে বল তো, তোর কি টাল আছে অনসূয়ার ওপর?’ আমি চমকে উঠে বলি, ‘ভ্যাট!’ ‘থাকলে বল, আমি ব্যবস্থা করে দেব, আমার দিদি ওদের বাড়ি সেলাই শিখতে যায়। তোকে মনে হয় পছন্দ করতে পারে, তুই দেখতে লালটুস আছিস তো।’ পানতুয়া ভরসা দেয় আমাকে। শুনে বুকের মধ্যে টেনিস বলের মতো আনন্দ ড্রপ খেলেও মুখে বললাম, ‘ভ্যাট।’ তার পর থেকে সতর্কও হয়ে গেলাম কিছুটা। পানতুয়াটা সন্দেহ করছে। এর পর অনসূয়াকে লুকিয়ে দেখার সময় পানতুয়াটাকেও চোখে চোখে রাখতে হবে। আর একটু হলেই ধরা পড়ে যেতাম আর কী!
এক দিন ধরা পড়ে গেল সুকুমার। চিরুনি সমেত হেড স্যারের ঘরে। এটা নিয়ে ক্লাস নাইনে ওর তিন বছর। বেশ শক্ত সমর্থ চেহারা, ঘন দাড়ি গোঁফ, মাথাটা বেশ বড়। কিন্তু অত বড় মাথাতেও কিছু ধরে রাখতে পারে না। তবে এ বার নাকি খাটছে খুব, রাত জাগছে, সকালে ব্রাহ্মীপাতার রস খাচ্ছে রোজ। হেড স্যারের ক্লাসে, কেন কে জানে, রোজই একটু দেরিতে ঢোকে সুকুমার। এ দিন হাতেনাতে ধরে ফেললেন রণজিৎ স্যার। ফাঁকা হেড স্যারের ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল সুকুমার। খুব হইচই। ওর ছোট্ট নীল রঙের চিরুনিটা বাজেয়াপ্ত হল। চড়চাপ্পড়ও খেল রণজিৎ স্যারের হাতে। গার্জেন কল হল। গার্জেন কেউ এল না, এমনকী সুকুমারও আর এল না ইস্কুলে। রাস্তায় দেখা হলে কথা হত। দেখতাম, রণজিৎ স্যারের ওপর রেগে আছে খুব। বলত, ‘দাঁড়া তালে পাই এক দিন, ইট ছুড়ে মাথা ফাটিয়ে দেব। শালা আলুবাজ!’
‘আলুবাজ’ শব্দটা সেই প্রথম শুনি। যদিও মানে বুঝে নিতে এতটুকু অসুবিধে হয়নি। রণজিৎ স্যারের ওপর কেন কে জানে, আমরাও রাগ ছিল খুব। মনে মনে খুশি হলাম তাই। মুখে অবশ্য বললাম, কী দরকার, ছেড়ে দে না ভাই!
কাবেরী ছিল আমাদের কুসুমপুর বিদ্যামন্দিরের সেরা সুন্দরী আর প্রচণ্ড ডাঁটিয়াল। কোনও ছেলেকেই পাত্তা দিত না। গৌতমটা কেবল অবুঝের মতো পিছনে পড়ে থাকত। ওটা আবার তোতলা আর ন্যালাখ্যাপা টাইপের। জামার পাঁচটা বোতাম মিনিমাম তিন রকমের, তার মধ্যে একটা আবার নিশ্চিত ভাবেই প্যান্টের। সেই গৌতম পোশাকআশাকে হঠাৎ ভয়ানক যত্নবান হয়ে উঠল। এক বোতামের ইস্তিরি করা জামা, কোমরে বেল্ট। মুশকিল হচ্ছে কথা বলার সময় চোখ বুজে যেত ওর, আর যথেষ্ট সময় পেলেও কথা শেষ করতে পারত না। তবু বেপরোয়ার মতো কথা বলার চেষ্টা করত কাবেরীর সঙ্গে।
টেনে ওঠার কিছু দিনের মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেল কাবেরীর। বর ইঞ্জিনিয়ার। দেখতেও দারুণ। সেই দুঃখেই বোধ হয় বেল্ট বাঁধা ছেড়ে দিল গৌতম। মুখে অবশ্য ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখাত একটা। কিন্তু দেখালে কী হবে, তোতলামিটা বেড়ে গেল আরও।
মাসখানেক পরে আবার ইস্কুলে এল কাবেরী। এত সুন্দরী হয়ে গেছে যে বেশিক্ষণ তাকানো যাচ্ছে না যেন। কাবেরী ক্লাসে ঢুকতেই একেবারে কাঁঠালে মাছি দশা। বাকি পঁচিশটা মেয়েই একেবারে ছেঁকে ধরেছে ওকে, তার পর সারাক্ষণ চাপা গলায় গুজগুজ ফিসফাস আর হিহিহিহি...। পল্লবের মেয়ে মহলে অবাধ গতিবিধি। বলল, ‘ব্যাপারটা বুঝেছিস, সবাই কাবেরীর কাছে নাইট এক্সপিরিয়েন্স শুনছে।’ নাইট এক্সপিরিয়েন্স কথাটার মধ্যে কেমন একটা নিষিদ্ধ হাতছানি; শুনলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে যেন!
অনসূয়াকে নিয়ে মাঝে মাঝেই নতুন গল্প আসে। এক দিন শুনলাম ওদের পাশের বাড়ির সৈকতের সঙ্গে নাকি ওর গভীর মেলামেশা। রাজু বলল, ‘ফোট, ওর মামাতো দাদার বন্ধুর সঙ্গে সব ফাইনাল; মাধ্যমিক পাশ করলেই বিয়ে।’ ব্যাপারটা আরও ঘোরালো হয়ে উঠল, যখন শুনলাম, অরন্ধনে ওদের বাড়ি নেমন্তন্ন ছিল রণজিৎ স্যারের।
এ সব শুনি, দীর্ঘশ্বাস ফেলি আর মনে মনে একটা চিঠির খসড়া বানাই। এক দিন সাহস করে চেয়েও নিলাম ওর জ্যামিতি খাতাটা। বাড়িতে গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। সরলরেখা-বৃত্ত-ত্রিভুজের মধ্যে যদি কোনও গোপন সংকেত থাকে। তেমন কিছু চোখে পড়ল না। এমনকী ফেরত দেওয়ার সময় চিঠিটাও ভেতরে গুঁজে দেওয়ার সাহস হল না।
রণজিৎ স্যারের বিয়ে হয়ে গেল হঠাৎ। হেড স্যারের মেজ মেয়ের সঙ্গে। পিন্টুর চৈতালিদি। পিন্টুদের হোল ফ্যামিলির নেমন্তন্ন। হেড স্যার কামাই করল দু’দিন, পিন্টু চার দিন। ওর ওপর প্রচুর দায়িত্ব কিনা! মনে মনে খুশি হলাম খুব, যাক একটা কাঁটা অন্তত সরল। এ বার চিঠিটা দিয়েই দেব। ঠিক দেব। যা থাকে কপালে! তার আগে এক বার নতুন করে লিখতে হবে চিঠিটা। দুটো ভাল করে কোটেশন ঢোকাতে হবে।
এই সব প্যাঁচপয়জারের মধ্যেই হুড়মুড় করে এসে গেল টেস্ট পরীক্ষা। চিঠি মুলতুবি রইল আপাতত। সে বার শীতটাও পড়ল খুব। নভেম্বরের শেষেই যেন কাঁপিয়ে দেওয়া ঠান্ডা। বাংলা ফার্স্ট পেপারের দিন টুকতে গিয়ে ধরা পড়ল রাহুল। মুচলেকা দিতে হল হেডস্যরের কাছে।
সেকেন্ড পেপারের দিন গিয়ে দেখি সবাই কেমন উত্তেজিত। স্যরেদের চোখমুখ কেমন থমথম করছে। কাল রাতে অনসূয়া নাকি সুইসাইড করেছে। মনে হল বুকের মধ্যে ধপ করে কী একটা পড়ল। স্পষ্ট শব্দ পেলাম। অনসূয়া, মানে, আমাদের অনসূয়া! যাহ, তাই আবার হয় নাকি। এই তো বাংলা পরীক্ষা দিল। আমার সামনের বেঞ্চে সিট পড়েছিল। দেখলাম, আমার প্রিয় ঋতু শীত রচনা লিখছে। পরীক্ষার পর বলল, মোটামুটি হয়েছে, শীতের উপসংহারটা শেষ করতে পারেনি, ঘণ্টা বেজে গেল। পানতুয়া কানে কানে বলল, ‘পেটে বাচ্চা এসে গিয়েছিল, তবে মালটা কে এখনও জানা যাচ্ছে না, খবর ঠিক আমি পেয়ে যাব। দুটো দিন একটু টাইম দে।’
পরীক্ষা দিতে দিতে বার বার চোখ পড়ে যাচ্ছিল। সামনের বেঞ্চটা ফাঁকা। খালি মনে হচ্ছে, দেরি হয়ে গিয়েছে, আগের দিনও দেরি করে এল, এক্ষুনি তাড়াতাড়ি এসে বসে পড়বে অনসূয়া, কোশ্চেন পেপারটা নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করবে। হেডস্যর এক বার এলেন আমাদের ঘরে। কেন এলেন কে জানে। এসে ফাঁকা জায়গাটার পাশে চুপ করে দাঁড়ালেন কিছুক্ষণ। যেন মন দিয়ে দেখেছেন, কেমন লিখছে মেয়েটা।
আজ
আমার প্রথম দিন। কুসুমপুর বিদ্যামন্দিরে হেডমাস্টারের পোস্টে আজ জয়েন করেছি আমি। প্রথম দিন বলে একটু তাড়াতাড়িই চলে এসেছি। কেউ আসেনি এখনও। শুধু যে ছেলেটা ঘণ্টা বাজায় সে এসেছে, একটা একটা করে ঘর খুলছে।
আমি সরু বারান্দার দিকে এলাম। এখানেই লুকিয়ে সিগারেট খেয়েছিল পানতুয়া, ভজা আর সুন্দর। সে দিনের সেই ধোঁয়া এখনও কিছুটা যেন থেকে গিয়েছে। একটু দূরে সেই গন্ধরাজ ফুলের গাছটা একটু বুড়ো হয়ে গিয়েছে। এখানেই দাঁড়িয়ে গৌতম কাবেরীকে বলেছিল, ‘তোকে মাইরি একদম ডিটো ডি-ডি-ডি-ডি...!’ মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার আগেই হেসে চলে গিয়েছল কাবেরী। পরে গৌতমের কাছে জানতে পারি, ও প্রকৃতপক্ষে ডিম্পলের নামটা উল্লেখ করতে চেয়েছিল সে দিন; আগের দিনই টাটকা ‘ববি’ দেখেছে কিনা। এই সেই কলতলা, এখানে পা হড়কে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গিয়েছিল সুতপার। ওই যে সেই দক্ষিণ দিকের পুকুর, জলে ছায়া ফেলে হেলে থাকা পাড়ের নারকেল গাছ, টেস্টের পর অ্যাডমিট কার্ড নিতে এলাম যে দিন, সে দিন একা একা দাঁড়িয়ে পুকুরে ঢিল ছুড়ছিলাম, আকারণেই ছুড়ছিলাম, ছুড়ছিলাম আর মনে হচ্ছিল, এই ইস্কুলে আজই শেষ দিন...।
হেড স্যারের ঘরে ঢুকলাম আমি। এই ঘরটাই এখন আমার ঘর। অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। চেয়ার-টেবিল ঝকঝকে, নতুন স্টিলের আলমারি। কিন্তু আশ্চর্য; আয়নাটা এখনও আছে। সেই আয়না। সেগুন কাঠে বাঁধানো আধ মানুষ সমান সেই আয়নাটা। ধুলো পড়ে একটু কালচে হয়ে গিয়েছে পালিশ।
একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম। দাঁড়ালাম আয়নাটার সামনে। আয়নার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম খুব। ভেতরে একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে। তাকিয়ে দেখছে আমার দিকে। কুসুমপুর বিদ্যামন্দিরের সেই টুবলু বলে ছেলেটা। গায়ে সে দিনেই সেই আধ ময়লা সুতির শার্ট, ইস্তিরিবিহীন প্যান্ট। মিটমিট করে হাসছে, আর দেখছে আমায়। ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি আমি। ছেলেটার পিছনে একে একে এসে দাঁড়াচ্ছে পিন্টু, পানতুয়া, গৌতম, কাবেরী, টুম্পা, পলাশ, সুতপা...। ভিড় জমে যাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে আমি অনসূয়াকে খুঁজি। খুব আকুলিবিকুলি খুঁজি। জানি, ও আসবে ঠিক। অপেক্ষা করি অনসূয়ার জন্যে।
|
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
|
|
|
|
|