মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব-সহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের দার্জিলিং পাহাড়ে ঢুকতে না দেওয়ার হুমকি দিলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ। প্রয়োজনে ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (জিটিএ) প্রত্যাখ্যান করবেন বলেও জানালেন। হুঁশিয়ারি দিলেন সরকারের ‘মাথাব্যথা’র কারণ হওয়ার মতো নতুন আন্দোলন গড়ে তোলার।
গুরুঙ্গের এই ঘোষণার ‘আপাত-প্রেক্ষিত’, ডুয়ার্সের নাগরাকাটায় রবিবার মোর্চা নেতৃত্বাধীন ‘যৌথ মঞ্চ’-এর সভার জন্য প্রশাসনিক অনুমতি না মেলা। প্রশাসনের দাবি, শান্তিশৃঙ্খলাজনিত কারণে ওই সভার অনুমতি দেওয়া যায়নি। শনিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রবিবার রাত ১২টা পর্যন্ত নাগরাকাটায় ১৪৪ ধারাও জারি করা হয়েছে। এ দিনই ডুয়ার্সের বানারহাট থানার চামুর্চি বনবস্তিতে কমিউনিটি হলে এক সভায় গুরুঙ্গ বলেন, “ডুয়ার্সের মানুষকে বোঝাতে চাই, জিটিএ-চুক্তিতে তাঁরা কী সুবিধা পাবেন। সেই সভা আমাদের করতে দেওয়া না হল না! অতীতে বাম-সরকারও আমাদের সঙ্গে এমন করেছে। ‘পরিবর্তনের’ পরেও একই ধরনের ঘটনার প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী এবং উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী-সহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের পাহাড়ে ঢুকতে দেওয়া হবে না। |
এমন হলে জিটিএ প্রত্যাখ্যান করা হবে। নতুন করে আন্দোলন করব। এমন আন্দোলন হবে যে তা সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”
মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরির বক্তব্য, “পাহাড়ে তৃণমূলের কোনও দল নেই। সংগঠনও নেই। তা হলে ওঁরা পাহাড়ে গিয়ে কী করবেন?” মোর্চা নেতৃত্বের এই ‘আক্রমণে’র জবাবে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী বলেন, “উন্নয়নের কাজেই আমরা পাহাড়ে যাই। যে কোনও দুর্যোগের খবর পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীও বারেবারেই গিয়েছেন পাহাড়ে। তাঁরই নির্দেশে শুক্রবার চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে আমি গিয়েছিলাম। আমরা পাহাড়ে রাজনীতি করতে যাই না। বাকি বিষয় নিয়ে এখনই উত্তর দিচ্ছি না।” সরকারি সূত্রের খবর, পাহাড়-
তরাই-ডুর্য়াসের এই ‘পরিস্থিতি’র
খবর পৌঁছেছে মহাকরণেও।
সমাধান-সূত্র খুঁজতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার।
বাম-আমলে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং সে সময়ের পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যকে পাহাড়ে ঢুকতে না দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল মোর্চা। এ দিন মোর্চার একই রকম ‘হুমকি’র কথা জেনে অশোকবাবু
বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী বা এক জন মন্ত্রীর রাজ্যের সর্বত্র যাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ ধরনের হুমকি বা ফতোয়া অগণতান্ত্রিক।” তাঁর সংযোজন, “মোর্চাকে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তৃণমূল। সেগুলো কার্যকর না হওয়ায়, মোর্চা এখন এ ধরনের হুমকি দিচ্ছে।”
তবে পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সের রাজনীতির কারবারীদের পর্যবেক্ষণ, গুরুঙ্গের এই ‘তোপের’ পিছনে একাধিক কারণ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথমত, মোর্চা নেতাদের একাংশ এখন মনে করছেন, তাঁদের বিরোধী শিবিরের (আদিবাসী বিকাশ পরিষদ নেতৃত্বাধীন জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি) প্রতি ‘নরম’ মনোভাব দেখাচ্ছে সরকার। কারণ, কমিটির ডাকা সাম্প্রতিক বন্ধ ব্যর্থ করতে রাস্তায় নামেনি পুলিশ-প্রশাসন। সক্রিয় বিরোধিতায় দেখা যায়নি প্রধান শাসক দল তৃণমূলকে। আইএনটিইউসি আবার রাস্তায় নেমে সেই বন্ধ সমর্থন করেছিল। তার উপরে ‘যৌথ মঞ্চ’-এর প্রস্তাবিত সভার বিরোধিতায় কমিটি আজ, রবিবার ডুয়ার্সে বন্ধ ডাকলেও সরকার ‘নিশ্চুপ’। অথচ, এক সময় ডুয়ার্সে সভা করার ব্যাপারে প্রশাসনিক ‘আশ্বাস’ থাকলেও নাগরাকাটায় সভার অনুমতি পেল না মোর্চা শিবির। দ্বিতীয়ত, দার্জিলিঙের চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পরে রাজ্য সরকার বাজার পুর্নগঠনে সাহায্যের আশ্বাস দেওয়ায় ক্ষুব্ধ মোর্চা নেতৃত্বের একাংশ। তাঁরা আশা করেছিলেন, রাজ্য সরকার সরাসরি ক্ষতিপূরণের কথা বলবে। তৃতীয়ত, মোর্চার শীর্ষ নেতারা তরাই এবং ডুর্য়াসের এলাকা ছাড়াই আপাতত ‘জিটিএ’ গঠন করে দিতে পারেন বলে মোর্চার সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের একাংশে ইতিমধ্যে ‘ফিসফাস’ শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে খোদ বিমল গুরুঙ্গকে দফায় দফায় তরাই-ডুয়ার্সে দলীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠক করতে হচ্ছে।
এই ‘পরিস্থিতি’তে রাজ্যের বিরুদ্ধে ‘তোপ’ দেগে দলের নেতা-কর্মীদের মনোবল ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন গুরুঙ্গ এবং রাজ্যের উপরেও ‘চাপ’ বাড়াতে চেয়েছেন বলে মনে করছেন রাজনীতির কারবারীরা। কারণ, জিটিএ-তে তরাই-ডুয়ার্সের অন্তর্ভুক্তির দাবি খতিয়ে দেখার জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শ্যামল সেনের নেতৃত্বে যে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি তৈরি হয়েছে, সেই কমিটির রিপোর্ট আগামী জুন মাসে সরকারের হাতে আসার কথা রয়েছে। তত দিন পর্যন্ত এই ‘নতুন অবস্থান’ গুরুঙ্গকে সুবিধা জোগাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
যে সভাকে ঘিরে এই রাজনৈতিক ‘উত্তাপ’, এ দিন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকের পরে তা বাতিল করে ‘যৌথ মঞ্চ’। ওই সংগঠনের নেতা শুকরা মুণ্ডা বলেন, “ওই জনসভা আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ফের জনসভা করার জন্য প্রশাসনের অনুমতি চেয়ে আবেদন
করা হবে।”
তবে কাল, সোমবার থেকে ডুয়ার্সে অনির্দিষ্টকালের বন্ধ পালনের ব্যাপারে তাঁরা এখনও অনড়। ‘মঞ্চ’-এর সভা বাতিল হলেও তার বিরোধিতায় ডাকা বন্ধ কিন্তু প্রত্যাহার করেনি ‘জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি’। কমিটির আহ্বায়ক রাজেশ লাকড়া বলেন, “আমরা প্রশাসনের উপরে পুরোপুরি ভরসা রাখতে পারছি না। খবর পাচ্ছি, মোর্চা শিবির ডুয়ার্সের বিভিন্ন এলাকায় লোক জড়ো করছে। তাই বন্ধ হবে। তবে জরুরি পরিষেবা, পোলিও-কর্মসূচিকে বন্ধের আওতার বাইরে রাখা হবে।”
এই বন্ধকে ঘিরে সতর্ক রয়েছে প্রশাসনও। মহকুমাশাসক (মালবাজার) দেবযানী ভট্টাচার্য বলেন, “অশান্তি যাতে না ছড়ায়, সে জন্য সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” এসডিপিও (মালবাজার) অরিন্দম সরকার জানান, আজ, রবিবার সকাল থেকেই ডুয়ার্স জুড়ে নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন করা হবে। সরকারি সূত্রের খবর, গুরুঙ্গ শনিবার রাতে ভুটান সীমান্তে ডুয়ার্সের জয়গাঁয় পৌঁছন। আজ, রবিবার সেখানে তাঁর সভা নিয়েও ‘উদ্বেগ’ রয়েছে পুলিশ প্রশাসনের।
উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী বলেন, “উত্তরবঙ্গে যাতে কোনও রকম অশান্তি না ছড়ায় সে জন্য সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়েই চলার চেষ্টা করছি।” |