|
|
|
|
ডাকঘর |
|
গুমানির পুরস্কারের দরকার নেই |
আমার ৩১ মার্চের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে লেখা সাধনবাবুর ১৪ এপ্রিলের চিঠিটি পড়লাম। প্রথমে সাধনবাবুর অমার্জিত মন্তব্যেরই প্রতিবাদ করি। লিখেছেন ‘ভুলের তালিকাটি দীর্ঘতর করার লোভে ১,২,৩ ইত্যাদি ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করেছেন।’ সাধনবাবু মনে রাখবেন, নিছক ভুল ধরার জন্যই ভুল ধরানো হয় না। পাঠককে সঠিক তথ্য জ্ঞাত করণের জন্যই ভুল ধরিয়ে যুক্তিযুক্ত তথ্য পরিবেশন করা হয়। এটি নৈতিক কর্তব্য বলে মনে হয়। ১ নম্বর ক্রমিক এবং ২ নম্বর ক্রমিকের যুক্তিযুক্ত উত্তর না দিয়ে সাধনবাবু পাশ কাটিয়ে অবান্তর কাহিনি শুনিয়েছেন। বিশেষত ২ নম্বর ক্রমিকের তথ্যটি স্বীকার না করে একেবারেই অন্য কথা শুনিয়েছেন তিনি। সরকারি ভাবে ৭ ফাল্গুন মেলার উদ্বোধন হয়। ৭ ফাল্গুনের আগে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় না। ক্রমিক সংখ্যার বাইরেও ভুল ধরিয়ে বলেছিলাম গুমানির দু’টি গ্রন্থ মুদ্রিত নয়। একটি গ্রন্থ মুদ্রিত ‘শ্রীশ্রী বন্যেশ্বর শিব মাহাত্ম্য ও শ্রীশ্রী ধামের ইতিবৃত্ত’। ‘ছিন্ন কুসুম’ এবং ‘তিনি কে’ তাঁর অমুদ্রিত গ্রন্থ। ওই সঠিক তথ্যও তিনি একবারের জন্য স্বীকার করলেন না। উত্তর দিলেন না, কেন তিনি শুধু এ বারের মেলাকে দায়সারা গোছের বললেন। পূর্বের মেলাগুলোর কী মাহাত্ম্য ছিল যে, সে গুলোকে তিনি দায়সারা মনে করেননি? তবে সব চেয়ে বিতর্ক তুলেছেন ক্রমিক নম্বর ৩-এর তথ্য নিয়ে। যেখানে তিনি বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে গুমানি গান করার কথা তুলেছেন, অথচ আদৌ গান করেছিলেন কি না এর প্রামান্য কোনও তথ্য নেই। আমার চিঠির কথা শুনে আব্দুর রাকিব নাকি ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে সধানবাবুর দাবি! এই পত্রলেখকও আব্দুর রাকিবকে ওই প্রশ্ন করেছিল। তাতে রাকিব মহাশয়কে ক্ষুব্ধ হতে দেখিনি। তাই ধ্রুব সত্য যদি মানতে হয়, তাহলে আরও জানাই, সম্প্রতি আরও একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। লেখক রমাপ্রসাদ ভাস্কর। তাঁর ‘সঙ্গীত চর্চার ধারায় মুর্শিদাবাদ’ গ্রন্থের ২৮২ পৃষ্ঠায় তিনি ‘সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান’ (সংযোজিত) গ্রন্থের ‘রেফারেন্স’ দিয়ে লিখেছেন, গুমানি দেওয়ান পদ্মশ্রী খেতাব, অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। যেহেতু একটি গ্রন্থে প্রকাশিত এবং রমাপ্রসাদ ভাস্করের মতো সজ্জন লেখক লিখেছেন, তাহলে ওই লেখাকে ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিতে হবে? কিন্তু আসলে তো তা সত্য নয়। আর তা সত্য না হলেই কি আপনার ভাষায় তাঁদের মিথ্যাচারী বলে আখ্যা দিতে হবে? সাধনবাবু অঙ্কের মতো করে হয় এটা, না হলে ওটা ওই যান্ত্রিক নিয়মাচার করেছেন কেন? আসলে এই সব মহান ব্যক্তিত্বদের নিয়ে অনেক সময় গল্প কাহিনি তৈরি হয়ে যায়, যেখানে সত্যের লেশ মাত্র থাকে না। শুধু গুমানি দেওয়ান কেন, রবীন্দ্রনাথকে গান শুনিয়েছেন বলে দাবি করেন হরিনারায়ণ, কিশোরী কোনাই প্রমুখ কবিয়াল পরিসরের মানুষজনও। ওই সব পরিবারে গেলে অনেক গল্প কাহিনিও শোনা যায়, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে যার অনেকটা বাদ দিয়ে আসলটুকু গ্রহণ করতে হয়। ১৯৪৫ সালে কলকাতর তৎকালীন মার্কাস স্ক্যোয়ারে আইপিটিএ-এর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গুমানি দেওয়ান কবিগান পরিবেশন করেন সুধী প্রধানের উদ্যোগে। তিনিই গুমানি দেওয়ানকে প্রথম গুণিজন সংস্পর্শে নিয়ে আসেন ও তাঁর সম্পর্কে তথ্যপূর্ণ জীবনী লেখেন। ওই লেখার তথ্যের ব্যাপারে সুধী প্রধানের সহযোগী ছিলেন গৌরীচরণ ভট্টচার্য মহাশয়। এই পত্রলেখক ওই দু’জনের সঙ্গেও আলোচনা করেছে। তাঁরাও ‘রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে গুমানির গান করার ব্যাপারে’ কোনও তথ্য দিতে পারেননি। ৩০।১০।৭৬ তারিখের দেশ পত্রিকায় কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত এবং অতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘চেতনিক’ পত্রিকায় অন্নদাশঙ্কর রায় প্রমুখ ব্যক্তিত্ব গুমানি সম্পর্কে প্রামান্য লেখা লেখেন। তাঁদের লেখা থেকেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গুমানির সাক্ষাৎকারের ও গান শোনানোর কথার কোনও উল্লেখ নেই। তা ছাড়া তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলি, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখও গুণীজনেরা গুমানির গুনগ্রাহী ছিলেন। তাঁদের অনেক চিঠিপত্রও আছে। তাঁদের লেখাতেও ওই প্রসঙ্গের কোনও উল্লেখ নেই। রাকিব লিখেছেন, ১৩৪২ সাল থেকে ১৩৪৮ সাল পর্যন্ত ছ’বছর ধরে গুমানি নিয়মিত রুটিনের মতোই রবীন্দ্রনাথকে গান শুনিয়েছেন। যদিও তিনি দিন ক্ষণের উল্লেখ করেননি। ছ’বছর ধরে অন্তরঙ্গ ভাবে গান শোনালেন অথচ শান্তিনিকেতনের কোথাও তার কোনও রেকর্ড থাকল নাএ বড় আশ্চর্য! কেউ তার সাক্ষী হয়ে থাকল নাএও বড় বিস্ময়! রাকিব যে আলুবাবুর কথা বলেছেন, তিনি এখনও জীবিত। ওই মানুষটিও এ ব্যাপারে কোনও তথ্য দিতে পারেননি। তা ছাড়া যে রবীন্দ্রনাথ ঢোল কাঁসি সহযোগে উচ্চগ্রামের সঙ্গতকে একেবারেই মেনে নেননি (দ্রষ্টব্য ‘কবিসঙ্গীত’ প্রবন্ধ) সেই রবীন্দ্রনাথকে গুমানি সঙ্গত ছাড়াই গান শুনিয়েছিলেন? ওই প্রশ্নও মনে জাগে। রবীন্দ্রনাথ গুমানি সম্পর্কে এক কলমও কোথাও লিখলেন না এও বড় বিস্ময়! আমার মনে হয় তথ্য ছাড়া রবীন্দ্রনাথের থেকে এরকম অবোধ শংসাপত্র নেবার বাসনা কেন? কেনই বা তথ্যহীন নানা খেতাব ওই লোককবির গলায় ঝোলানের কুশ্রী প্রচেষ্টা। তাতে কি গুমানি দেওয়ানের আসনটা মজবুত হবে? তিনি তো লোককবি। থাকুন শুধু লোকেদের হয়ে। যেখানে কোনও খেতাব, কোনও পুরস্কারের দরকার নেই। |
দীপক বিশ্বাস, বহরমপুর। |
|
|
|
|
|