|
|
|
|
|
|
|
চলনবিলের সারস |
কমলেশ রায় |
চার দিকে সবুজ গাছপালা খানিকটা জঙ্গলের মতো, আদিগন্ত ফসলের মাঠ, কাঁচা-পাকা বাড়ি, দূরে হাইরোডে বাস চলে, প্রায় ঘুমন্ত গ্রাম মদনডাঙা। গ্রামের পাশ দিয়ে ছোট নদী চলন। বর্ষায় দু’কূল উপছে যায়, গ্রীষ্মে হাঁটুজল। গ্রামের শেষে মাইল দুয়েক জঙ্গল, তার পরেই আশ্চর্য সেই জায়গা চলনবিল! দু’পাড়ে জঙ্গল নিয়ে মাইলখানেক লম্বা, সারা বছর টলটলে জল।
টিটুর বড় আফসোস হচ্ছে, কেন যে সে তার স্কেচের খাতা দীপেনমামাকে দেখাতে গেল! তার পরেই তো সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল। প্রতি বছর শীতের মুখে চলনবিলে অজস্র পরিযায়ী সারসরা আসে। গত বছর টিটু আর তার বন্ধু তপু গিয়ে স্কেচ করেছে। ওই পাখিগুলো নাকি হিমালয় পেরিয়ে উড়ে আসে।
মার কাছে শুনেছিল টিটু, দীপেনমামা চাইবাসায় থাকে, অনেক দূর, সেই ঝাড়খণ্ডে। চাইবাসা শহরে দীপেনমামার কাঠগোলা আছে। এ বছর এখনও তেমন শীত পড়েনি, কিন্তু চলনবিলে পাখিরা চলে এসেছে।
মা বলেছিল, চাইবাসা থেকে দীপেনমামা আসতে পারে। মামা আসাতে বাড়িতে উৎসব পড়ে গিয়েছে, হইচই, খাওয়াদাওয়া।
স্কেচবুক দেখাতে মামা বলেছে, ‘এই সারসগুলোকে তো আমি চিনি। আমাদের চাইবাসার দিকেও আসে।’ স্কেচ করা সারসদের ওপরে মামার হাতের পেন্সিল ঘুরছিল, ‘এরা নভেম্বর থেকে জানুয়ারিতে আসে,
শীত ফুরোলে মার্চ-এপ্রিল মাসে ঘরমুখো হয়। আরে এই তো লার্জ হুইসলিং টিল মানে বড় সারস, গাগোর্নি টিল, হেরন, স্নাইপ। আর এই সারসগুলো আসে সাইবেরিয়া থেকে।’
সবই ঠিক ছিল, ব্যাপারটা ঘোরালো হয়ে উঠল অন্য ভাবে। দীপেনমামা গুলতি দিয়ে সারস শিকার করবে। সরকারি আদেশে আজকাল পাখি শিকার নিষিদ্ধ, মামা মানতে রাজি নয়। মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলে উঠেছিল, ‘নিয়ম আছে আবার বেনিয়মও হয়। গুলতিতে পাখি মারব, কে দেখছে এখানে?’
মাটির বাঁটুল খড়কুটো, পাতা দিয়ে পোড়ানো হল, পুড়িয়ে লাল। গুলতি থেকে ছটাস করে ছুটে যাবে পাখির দিকে। রেহাই পাবে না। দীপেনমামা জিদ ধরে আছে, পাখি শিকার করবেই, টিটুর একদম পছন্দ নয়। মামা না এলেই ছিল ভাল। টিটু বলেছে, সারসরা সকালের দিকে উড়ে দূরে চলে যায়, দুপুরে ফেরে। তাই ঠিক হল, দুপুরের একটু আগে দীপেনমামা টিটুকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, রাস্তাঘাট ওর জানা আছে, ও দিকে তো জঙ্গলের রাস্তা। পথ হারালে আর দেখতে হবে না। সঙ্গে কাঁধ ঝোলায় যাবে জলের বোতল, পরোটা, তরকারি আর ফ্লাস্কে চা। |
|
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
আগে টিটু, দীপেনমামা পেছনে। টিটুর সবই হাফ, সার্ট ও প্যান্ট। দীপেনমামার পাজামা, পাঞ্জাবি। এখন ওরা জঙ্গলের রাস্তায়। জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ঘন গাছপালা, ঝোপঝাড়, বনঝিঁঝির ডাক। চার দিক নির্জন। কয়েকটা হনুমানের হুপহাপ ছিল, তারাও দূরে চলে গেল।
টিটু ভাবছিল, কী করে দীপেন মামাকে পাখি শিকারে বাগড়া দেওয়া যায়। একটা রাস্তা আছে, ভুল পথে ঘুরোতে ঘুরোতে অনেক দূরে নিয়ে যাওয়া। চলনবিল এক মাইল লম্বা। শেষ মাথায় পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল নামবে, আবার ফিরে আসতে সন্ধে।
ইচ্ছে করে টিটু ভুল রাস্তা ধরল। পথ হয়ে গেল উল্টো। দীপেনমামা বুঝতেই পারল না, চলনবিল কখন দূরে চলে যাচ্ছে। সিগারেট আর গুনগুন গান, তাতেই বুঁদ হয়ে আছে দীপেনমামা। সারসরা অন্য দিকে। মুখ টিপে হাসল টিটু। বেশ হয়েছে, আর সারসদের পেছনে লাগবে?
ঘণ্টাখানেক পরে দুপুর যখন একটু একটু করে ফুরিয়ে আসছে, তখন হুঁশ হল দীপেনমামার, ‘এই টিটু, তোর চলনবিল আর কত দূর রে?’ টিটু মাথা চুলকাল, ‘বোধ হয় আমরা ভুল পথে চলে এসেছি।’
‘তাই তো এ দিকে লোকজনও নেই কাউকে জিজ্ঞেস করব। বিলে সারসরা থাকলে দূর থেকে তাদের ডাক শুনতে পাওয়া যায়। আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিল। এক কাজ কর, একটা ফাঁকা জায়গায় বসে টিফিনটা খেয়ে নিই।’
একটা ফাঁকা জায়গায় গাছতলায় বসল ওরা। খেতে খেতে দীপেনমামা যেন চিন্তিত। ‘এর পরে তো বিকেল নামবে, ফেরার পথ চিনতে পারবি তো? না হলে সারা রাত জঙ্গলে ঘুরতে হবে।’
ঠিক এই জায়গাটাই ধরে নিল টিটু। বুঝতে পারল মামা ভয় পেয়েছে। ‘এ দিকের গাঁয়ের লোকজন একটা কথা বলে মামা। এই জঙ্গলে দেবতা আছে। কেউ পাখি শিকার করতে চাইলে, রাস্তা ভুলিয়ে দেয়। সারা রাত জঙ্গলে ঘোরাতে থাকে। আমরা কোন দিকে চলে এসেছি বুঝতে পারছি না। বিলের শেষ মাথা তো অনেক দূর। এ দিকে গেলে ফেরার রাস্তা জানি না।’
‘এক কাজ কর। বাড়িতে মাকে বলবি, মামা গুলতি দিয়ে পাখি মেরেছিল, পাখিটা বিলের মাঝখানে পড়ে ভাসতে ভাসতে চলে গিয়েছে। অত জলে নেমে পাখি তোলা যায়নি। আমরা রাস্তাগুলিয়ে ফেলেছি, এ কথা বলবি না।’
‘ঠিক আছে তাই বলব।’ মুখের হাসি লুকিয়ে টিটু পরোটা খেতে লাগল। ভাগ্যিস বুদ্ধিটা ঠিক সময়ে বেরিয়ে ছিল। না হলে মামার হাতে একটা সারসের নির্ঘাৎ মৃত্যু ছিল। ভগবান, তুমি ওদের বাঁচিয়ে দিলে। মামা তো ঠিক করে ছিল, সারস মেরে গাছের ডালে ঝুলিয়ে কাঁধে নিয়ে ঘরে ফিরবে।’
বিকেল নামার আগেই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল ওরা। বেরিয়েই মামা টিটুকে ধরল, ‘এ বার সত্যি করে বল, কেন ইচ্ছে করে উল্টো রাস্তায় নিয়ে গিয়েছিলি? আমি কিছু বুঝি না, না?’
‘ওরা কত দূর থেকে আমাদের গাঁয়ে বছরে এক বার আসে, কেন তুমি ওদের মারবে?’
‘ধুর বোকা, আমি ওদের মারতাম না। এদিক ওদিক গুলতি মেরে উড়িয়ে দিতাম। তখন আকাশে কী সুন্দর রঙের মেলা হত!’
‘ইস, এ কথা তুমি আগে বলোনি কেন? আমি ঠিক চলনবিলের সারসদের কাছে নিয়ে যেতাম।’
‘আমিও তো একটা সারস রে। উড়তে উড়তে তোদের মদনডাঙায় এসেছি, আবার চলে যাব। একটা সারস অন্য সারসকে মারে নাকি?’
টিটু এখন দীপেনমামার হাত ধরে কেঁদে ফেলল, ‘না তুমি যাবে না।’
কী আশ্চর্য, বাতাসে ভেসে এল, চলনবিলের সারসদের ডাক! |
|
|
|
|
|