‘পরিবর্তনের’ জমানায় দাম বাড়ানো যাবে না। টিকে থাকার তাগিদে তাই মাস ছয়েক আগে বিকল্পের সন্ধানে নেমেছিলেন রাজ্য সরকারি দুধ-সংস্থা ‘মাদার ডেয়ারি’র পরিচালকেরা। অস্তিত্বরক্ষার ‘বিকল্প’ পথ তাঁরা খুঁজেও পেয়েছেন।
আর সেই পথে হেঁটে মুমূর্ষু দশা কাটিয়ে অনেকটা ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে মাদার ডেয়ারি। খরচে রাশ টেনে, বাজারে দামি দুধ বেচে এবং কাঁচা দুধের জোগান বাড়িয়ে শুধু গত মাসে সংস্থার ব্যয়ের তুলনায় আয় হয়েছে ২২ লক্ষ টাকা বেশি। গত দু’বছরে এই প্রথম!
স্বভাবতই প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের আত্মবিশ্বাস ঊর্ধ্বগামী। তাঁরা জানাচ্ছেন, টানা দু’বছর দুধের দাম বাড়েনি। এ দিকে খরচ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ফল যা হওয়ার, তা-ই হচ্ছিল, লোকসানের বহর ভারী হচ্ছিল দিন দিন। বস্তুত গত এক বছর ধরে প্রতি মূহূর্তে সরকারি দুধের মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন মাদার ডেয়ারির অফিসারেরা। কিন্তু সরকার সেই আবেদন বারবার খারিজ করে দিয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবর্ষে সংস্থার মোট লোকসানের পরিমাণ প্রায় ২৯ কোটি টাকা।
তবে নতুন পরিকল্পনার দৌলতে ছবিটা এখন অনেক উজ্জ্বল বলে দাবি করছেন ডেয়ারির কর্তারা। রাজ্য প্রশাসনের একাংশেরও বক্তব্য: গয়ংগচ্ছ মনোভাবের ‘ঐতিহ্য’ ঝেড়ে ফেলে মানসিকতায় বদল আনতে পারলে যে সরকার-নির্ভরতা
কমানো যায়, এমনকী লাভের মুখও দেখা যায়, মাদার ডেয়ারি সেটাই হাতে-কলমে দেখিয়ে দিল।
উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গের নতুন সরকার গণ-পরিষেবার কিছু ক্ষেত্রে দাম না-বাড়ানোর নীতি আঁকড়ে থাকায় সরকারি পরিবহণের কার্যত নাভিশ্বাস দশা। বাসভাড়া বাড়েনি, অথচ জ্বালানি-যন্ত্রাংশের দাম ক্রমে বেড়েছে। রুগ্ণ হয়ে পড়া পরিবহণ নিগমগুলোয় ভর্তুকি জোগাতেও সরকার নারাজ, তাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উপায় খুঁজতে বলা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মাদার ডেয়ারির ‘উদ্ভাবনী’ পরিকল্পনা ও ‘উদ্যোগী’ মানসিকতা পরিবহণ নিগমগুলির সামনে দৃষ্টান্ত হতে পারে বলে প্রশাসনের অনেকে মনে করছেন। সামনের মাসগুলোতেও লাভের মুখ দেখার জন্য মাদার ডেয়ারি-কর্তৃপক্ষের একাধিক পরিকল্পনা। যেমন?
যেমন, আগ্রাসী বিপণন-কৌশল। রাজ্য প্রাণিসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী নুরে আলম চৌধুরী জানান, বাজার ধরার নতুন নতুন ছক কষা হচ্ছে। রেলে নিজেদের তৈরি মিনারেল ওয়াটার বিক্রির আবেদন যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। এটি এখন বাজারেও মিলছে। মাদার ডেয়ারি’র চিফ জেনারেল ম্যানেজার উদয়ভানু গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “রেলের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। হাওড়া ও শিয়ালদহ থেকে ছাড়া ট্রেনগুলোয় আমাদের রোজ এক থেকে দেড় লক্ষ লিটার জল সরবরাহ করার কথা।”
শুধু রেল নয়, রাজ্য সরকারের যাবতীয় অনুষ্ঠানেও মাদার ডেয়ারির জল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার প্রয়াস প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবটি আপাতত অর্থ দফতরের অনুমোদনের অপেক্ষায়।
পাশাপাশি শিলিগুড়ি, বর্ধমান, মেদিনীপুরের মতো বড় মফস্সল শহরে বেসরকারি উদ্যোগে ‘মিল্ক পার্লার’ খোলার কথা ভাবা হয়েছে। সেখানে মাদার ডেয়ারি’র যাবতীয় পণ্য বিক্রি হবে। পার্লারের মালিক চাইলে ‘কফি-শপ’ও খুলতে পারেন। তবে শর্ত, কফি বানাতে হবে মাদার ডেয়ারির দুধ দিয়ে। একই ধরনের পার্লার খোলা হবে রেল স্টেশনেও।
এবং নয়া বিপণন-কৌশলেরই অঙ্গ হিসেবে এই গরমে কলকাতার বিভিন্ন স্কুলের সামনে গাড়িতে করে বিকোবে মাদার ডেয়ারির আইসক্রিম। বাজারে আসবে ঠান্ডা ঘোল। আধুনিক টেট্রা প্যাকে মাদার ডেয়ারির ওই ঠান্ডা ঘোল এপ্রিলের গোড়া থেকে ডেয়ারির বিভিন্ন বুথে পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে তা বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে বলে কর্তাদের দাবি। কর্তারা আরও জানাচ্ছেন, গত নভেম্বরে মাদার ডেয়ারি ‘মা শক্তি’ ব্র্যান্ড-নামে বেশি দামের যে দুধ বাজারে এনেছে, তা এখন সংস্থাকে নিয়মিত লাভ দিচ্ছে। এক অফিসারের কথায়, “যখন বোঝা গেল পুরনো দুধ তুলে নেওয়া যাবে না, দামও বাড়ানো যাবে না, তখনই ‘মা শক্তি’ ছাড়ার পরিকল্পনা হয়। মার্চেই তার ফল মিলেছে। খুচরো টোন্ড দুধ বেচে ৮৪ লক্ষ টাকা, গরুর দুধের প্যাকেটে ২১ লক্ষ আর ডাবল টোন্ডে ৬ লক্ষ টাকা লোকসানের পরেও ২২ লক্ষ টাকা লাভ হয়েছে।” কর্তাদের আশা, চলতি অর্থবর্ষের পুরোটা এই ধারা বজায় থাকবে।
ওঁদের আশাবাদের পিছনে আগ্রাসী বিপণন ছাড়াও আছে আর একটা কারণ। সেটা কী?
সংস্থা-সূত্রের ব্যাখ্যা: আগে মাদার ডেয়ারি কাঁচা দুধ কিনত শুধু দুগ্ধ সমবায় থেকে। তাতে চাহিদা মিটত না। ফলে বাজার থেকে চড়া দামে ‘স্কিম্ড মিল্ক’ কিনে কাঁচা দুধে মেশানো হতো।
নভেম্বরেও দৈনিক গড়ে ১৯ মেট্রিক টন ‘স্কিম্ড মিল্ক’ লেগেছিল। এখন গ্রাম-গ্রামান্তরের বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠী থেকে সরাসরি কাঁচা দুধ কেনা হচ্ছে। এতে রোজ ৭০ হাজার লিটার অতিরিক্ত দুধ মিলছে। তাই স্কিম্ড মিল্ক লাগছে অনেক কম, প্রায় অর্ধেক। উপরন্তু স্কিম্ড মিল্কের দামও কমেছে।
সব মিলিয়ে বাড়তি আয়ের পথে যাত্রার শুভ সূচনাই এখন দেখছেন মাদার ডেয়ারি কর্তৃপক্ষ। |