|
|
|
|
|
|
|
বাঙালির নববর্ষ, চিংড়িমাছ, দিদি সরকার এবং |
‘অনেক দিন আগে, যখন আমরা অসভ্য ছিলাম, মানে বিশ্বায়িত হইনি,
ভাসা ভাসা মনে পড়ে, বাংলা বছর বলে একটা জিনিস ছিল।’ এখন? নতুন বছরে
নব্য বাঙালিকে দর্শন করেছেন ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী
|
বলুন তো বাঙালির নববর্ষ কোন মাসে, মাসের কোন তারিখে? আচ্ছা, এটা কোনও একটা প্রশ্ন হল? খ্রিস্টমাসের পরেও পার্ক স্ট্রিটের রোশনাই-আশনাই আরও দু’দিন কেন চোখ ধাঁধায় তা কে না জানে? ৩১ ডিসেম্বর রাত জেগে হই-হুল্লোড়, যার মূল কথা সুরাদেবীর পূজা। মাঝে মাঝে মেয়েদের হাত ধরে টানাটানি (অবশ্যি যার অধিকাংশ দিদি-সরকারকে হেনস্থা করতে) আর গ্যাঁটে পয়সা থাকলে নামী-দামি ক্লাবে ইউরোপীয় খানা এবং ভুঁড়ি ভাসিয়ে নাচানাচির যে দৃশ্য দেখে অন্নপ্রাশনের ভাত মুক্তি খুঁজতে থাকে সেই ১ জানুয়ারি যে আমাদের পবিত্র নববর্ষ, এ কথা কি বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে? যদি কেউ বলে, ‘ওটা ভাই সাহেবদের নববর্ষ, বড়জোর খ্রিস্টানদের বলতে পারেন’, তো দশটা মানুষ নাপিয়ে উঠবে। আজ বিশ্বায়নের শুভলগ্নে, যার কৃপায় কলকাতা শহর ম্যালে ম্যালে ছেয়ে গেল, দেশি বিদেশি ব্যবসায়ীরা কালো টাকা কোথায় রাখবেন ঠিক পাচ্ছেন না, সুচিন্তিত পদ্ধতিতে নিয়মিত ঘটি উল্টে ব্যাঙ্কগুলিকে ফেল পড়িয়ে উত্তরপুরুষের আখেরের ব্যবস্থা হচ্ছে, তখন এ সব মাওবাদী অধর্মের কথা বলে কু-ডাকটা না-ডাকলেই চলবে না? আর যদি গরিবের দুঃখে অত বুক ফাটে তো বলি, শহরের বস্তিগুলি ঘুরে দেখুন, কোথায় ঈসাই নববর্ষ পালিত হচ্ছে না? তার আগে বস্তির বুড়ো দাদা সান্তা ক্লজ সেজে তড়পে গেছেন। |
|
সাহেবরা আমাদের সভ্যি করতে এসেছিল। এ কথা সবাই বুঝেছিল এক ওই পাপিষ্ঠ বুড়ো গাঁধী ছাড়া। হিন্দুকুলগৌরব নাথুরাম এক গুলিতে তাঁকে সাবাড় করলেন। শুধু বুড়োর শিষ্য জওহরলালকে শেষ করার মতো সৎসাহস কারও হল না। ‘সমাজতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্র’ করে দেশটার সর্বনাশ করলে। তবে সুখের কথা, লোকের চোখ খুলছে। নরেন মোদী পথ দেখিয়েছেন, কী করে দেশ বাঁচাতে হয়। ভারতবর্ষ জ্বলজ্বলিং বিশ্বায়ন আর মোছলমান দমন, দুই হাতে এই দুই গদা ঘুরিয়ে হিন্দুস্থানকেই স্বর্গস্থান করা হবে। শুধু দেশের সেরা সন্তান নরেনকে রাজতখ্তে বসানোটা বাকি। এমন সোনার চাঁদ থাকতে আমরা কিনা এক সর্দারকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়েছি। যত্ত সব। একটা জিনিস ভুলবেন না, নামী-দামি ক্লাবে যাঁরা ১ জানুয়ারি বিশ্বায়ন করেন, তাঁরা অধিকাংশই সনাতন ধর্মের ধারক ও বাহক। মোদী ভক্তিতে মুহ্যমান। আর বাঙালি সংস্কৃতি? আটশো টাকা সের দরে বাগদা চিংড়ি আর সাতশো টাকা সের দরে ইলিশ মাছ কিনে জিনিসটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে কারা শুনি?
|
বিশ্বায়নের আগে |
অনেক দিন আগে, যখন আমরা অসভ্য ছিলাম, মানে বিশ্বায়িত হইনি, ভাসা ভাসা মনে পড়ে, বাংলা বছর বলে একটা জিনিস ছিল। নেহাতই কাঁচা জিনিস। চোদ্দোশো কিছুতে এসে থেমে আছে। এমনই কাঁচা যে প্রতি মাসের দিনসংখ্যা প্রতি বছর এক না। আরও একটা কথা আছে। সেটা শুনলেই শুদ্ধাত্মা সনাতনধর্মীরা ও দিকে আর ফিরেও তাকাবেন না। ওটা নাকি হিজরি সালেরই রূপান্তর। আ ছি ছি ছি। এতগুলি অব্দ আছে, মরতে আর অব্দ খুঁজে পেলি না। শেষে মোছলমানদের এঁটো? হিজরি সালের ভিত চান্দ্র মাস। বাঙালিদের মাস চান্দ্র-সৌর দুই-ই। তাই বাঙালি সাল ক’বছর পিছিয়ে পড়েছে। আশি-পঁচাশি বছর আগে, যখন বিশ্বায়িত কেন মানবায়িত হইনি, সাহেবদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও, তখন বছরের যে কয়েকটা দিনে সকালবেলা উঠে মা-বাবা এবং হাতের কাছে অন্যান্য গুরুজন কেউ থাকলে তাঁদের প্রণাম করতে হত, তার একটি ১ বৈশাখ। আমার থেকে আড়াই বছরের বড় দাদা এই প্রণাম আদায়ে বিশেষ উৎসাহী ছিল। আর ১ বৈশাখ পার হওয়ার আগেই ১৬ মাইল দূরে কীর্তিপাশা গ্রাম থেকে শ্রদ্ধেয় জ্যেঠতুতো দাদা মন্টুর আশীর্বাদ চিঠি আসত তুমি আমার আন্তরিক আশীর্বাদ জানিবা। ইতি ভবদীয় আ. (অর্থাৎ আশীর্বাদক) দিলীপকুমার সেনশর্মণ (ওরফে মন্টুদাদা) যিনি কিনা আমার পনেরো দিন আগে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। আমাকে কেউ কখনও প্রণাম করত না। আমার সাড়ে পাঁচ বছরের কনিষ্ঠা ভগ্নীর ওপরে এক বার দাদাগিরি ফলাতে গিয়েছিলাম। প্রণাম তো করলই না, উল্টে প্রচণ্ড খিমচে দিল। তার দাগ এখনও আছে। তদবধি শ্রীচৈতন্য প্রদর্শিত পথ গ্রহণ না-করলেও বিনয়নম্র হয়েই আছি। নিজেকে অধমাধম জ্ঞান করেই সন্তুষ্ট আছি। কারও প্রণাম দাবি করার মতো অসৎ সাহস আর হয়নি।
বাঙালির যাবতীয় উৎসবে বিশেষ বিশেষ খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। ১ বৈশাখে সে রকম কিছু মনে পড়ে না। তবে সাম্প্রতিক কালে কলকাতার এক ক্লাবে বিশেষ দিন বলে বিশেষ খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। বাঙালি খানসামা। প্রধান আকর্ষণ ভাপে সেদ্ধ ইলিশ পাতুরি, লুচি দিয়ে খেতে হলে হা হা করবেন না। খাদ্যের ব্যবস্থাপক হোটেল চালানোর ব্যাপারে ডিগ্রিপ্রাপ্ত। তাঁর ডিগ্রির পরে আর কোনও কথা নেই। তিনি যদি বলেন লুচি দিয়ে সর্ষে ইলিশ খাবে, তবে সুশীল বালক গোপালের মতো তাহাই খাইবে। ঘাস খেতে বললে তাই খাবে। কোনও পেঁয়াজি করার কথা চিন্তাও কোরো না। প্রসঙ্গত, মনে পড়ল বাংলাদেশে পেঁয়াজিকে পেঁয়াজু বলে। বেশ মিষ্টি শোনায়। মানে কাছের লোক মনে হয় আর কী। পেঁয়াজি কথাটার মধ্যে যেন একটু ঔদ্ধত্য, বখাটে বখাটে ভাব আছে।
|
অপ্রীতি মানে প্রীতির অভাব |
বাংলাদেশের কথায় ওঁদের নববর্ষ পালনের কথা মনে পড়ল। বাংলা ভাষাটার জন্য আক্ষরিক অর্থেই রক্ত দেওয়ার পর থেকে পয়লা বৈশাখ ওখানে শহিদ-স্মৃতি পালিত হয়। ঢাকা বা তার কাছাকাছি কোথাও থাকলে মিছিল করে সবাই শহিদ মিনার যান। আমাদের, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের ওঁরা বলেন, ‘ইন্ডিয়ান’। বিদেশে বাংলা নববর্ষের উৎসবে তাঁদের ডাক পড়ে না। অবশ্যি এ দেশে কাঁড়ি কাঁড়ি রবীন্দ্র-উৎসবে আমরাও কিছু ‘আয়েন চাচা, বয়েন চাচা’ করি না, যদিও ভদ্রলোক পূর্ববঙ্গেরই জমিদার ছিলেন। আসল কথা ওই যে, হিন্দু-মুসলমানে অপ্রীতি না হোক, প্রীতির অভাবের ব্যাপারটা কখনও মেটেনি। সম্প্রতি আমার ছাত্রস্থানীয় এক সাংবাদিক মুসলমানদের ভয়েই যে দেশ-ছাড়া হয়েছি, সে কথাটা খুলে না বলায় বিশেষ ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। মুসলমানদের গাল দেওয়ার এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে? তুলনায় নীরদচন্দ্র চৌধুরী কত সত্যনিষ্ঠা দেখিয়েছেন বলে লোকটি গদগদ। মানুষটি এক সময় প্রায় নকশালপন্থী ছিল। হঠাৎ কেন নরেন্দ্রানুগামী হয়ে শাখামৃগবাহিনীর অংশী হলেন, সে রহস্য আজও অন্ধকারাবৃত। যাক গে, কারও যদি শক্ত জমি ছেড়ে উচ্চ বৃক্ষচূড়ে উপ্ উপ্ করতে ভাল লাগে, তবে আর কার কী এল গেল? তবে একটা কথা মনে রাখা ভাল। বানর সেনায় নাম লেখালেই তো সত্যিই রাতারাতি ল্যাজ গজায় না। উঁচু ডাল থেকে পড়লে ঠ্যাং ভাঙার বিশেষ সম্ভাবনা। ল্যাজ থাকলে সামলে নেওয়া যেত। রাম পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম-র লোচ্চামি দেখে হতশ্রদ্ধ হয়ে মানুষের চেয়ে হনুদের প্রেফার করেছিলেন ঠিকই। ওদের বিয়ের ব্যাপারটা বেশ ঢিলেঢালা। আজ ভাশুরের ঘর করছে, তো কাল দেওরের শোওয়ার ঘরে। এ নিয়ে কেউ পাঁচটা কথা বলে না। তবে হনুরা কেউ ছোট বউয়ের কথায় বড় ছেলেকে বনবাসে পাঠায় না। ধর্মাধর্ম জ্ঞানটা ওদের বেশ টনটনে। আর বনবাসে পাঠাবে কী? ওদের বাসই তো বনে।
যাক গে, কী বলতে কোথায় চলে এলাম! মানে, ছেলেটা ভদ্র বাঙালির সন্তান, বাঁদর হয়ে যাচ্ছে দেখে একটু সামলে দিলাম। গাছ থেকে পড়ে যাতে হাত-পা না ভাঙে। অত যদি গরজ থাকে, প্লাস্টিক সার্জারি করে ল্যাজ গজিয়ে নিক। ওদের দলে তো দীর্ঘপুচ্ছ হনুর অভাব নেই। কেউ আধখানা ছেড়ে দিলেই এ জীবনটা চলে যাবে।
নববর্ষের কথায় ফিরে যাই। আমাদের প্রায় সব উৎসবেই একটু ধর্মের ছোঁয়া থাকে। নববর্ষের ক্ষেত্রে কিন্তু দেবদ্বিজে ভক্তিটা অত প্রকট না। সেক্যুলার বাঙালির মেজাজের সঙ্গে খাপ খায় ভাল। তবে ধর্মের ব্যাপারটা থাকলে ফলারের ব্যাপারটা বেশ ভালই থাকে। মানে, দেব-দ্বিজ নিয়ে কথা! দেবতাদের যা শুনি, আহারের চেয়ে বিহারেই উৎসাহ বেশি। ইন্দ্র তো কোনও মহিলাকেই ছেড়ে কথা বলেন না, মাস্টারের বউকেও না। আশা করি, দিদি-সরকার এ তথ্যটা সিপিএমএ-এর মিথ্যা প্রচার বলবেন না। যাক গে, কথা হচ্ছিল যে, শাস্ত্রে বলে, দেবতারা যা-ই করুন, বিপ্রগণ ভোজনে নৃত্য করেন। কিন্তু পয়লা বৈশাখে সেই নাচানাচির সুযোগ কিছু কম। এক দেখতাম, সব জন্মদিনেই পায়েস রান্না হত। বোধহয় সে কথা ভেবেই বছরের জন্মদিন নববর্ষেও পায়েস হত। ওই যাহ্! এতে আমরা খুব উত্তেজিত হতাম না।
গুরুজনদের পেন্নাম আর চিঠি লেখা ছাড়া (হ্যাঁ, হ্যাঁ, সমশ্রেণির আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কোলাকুলির ব্যাপারটাও ছিল) সাহেবি কেতার সঙ্গে পরিচয় কম, তাই জিজ্ঞাসা করছি, ক্লাবগামী বঙ্গসন্তানরা পয়লা জানুয়ারি কি কোলাকুলিও করেন না? করমর্দন আর নাচানাচিতেই উৎসবের সমাপ্তি? পয়লা বৈশাখ নববর্ষের চিঠি আমাদেরও গণ্ডা গণ্ডা লিখতে হত, ষেটের কোলে মামা-মাসি-মেসো-পিসে সংখ্যায় তো কম ছিলেন না! কাউকে না লিখলে ‘ছেলেগুলো অসভ্য হচ্ছে’ মা-বাপকে এই অপবাদ শুনতে হত। এখন অবশ্যি বাংলায় চিঠি লেখা প্রাগৈতিহাসিক যুগের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাকে ‘শ্রীচরণকমলেষু’, আর কাকে শুধু ‘শ্রীচরণেষু’ লিখতে হয় এই সব অবান্তর ব্যাপার যত্ন করে শেখার প্রশ্নই ওঠে না। কোনও কোনও সাহেবি ইস্কুলের আন্টিরা বাপ-মা’কে ডেকে বলে দেন বাড়িতে বাংলা না বলতে। তাই অনেক কোম্পানির মেজকর্তা, সেজকর্তার বাড়ি থেকেও নেটিভ ভাষা একেবারে নির্বাসিত।
পূর্ববঙ্গে, বিশেষত আমাদের বরিশালে পয়লা বৈশাখে ছোটদের বিশেষ প্রিয় একটি অনুষ্ঠান চালু ছিল, নাম থৌল খরচা। এর মূল কথা, বড়রা প্রত্যেকেই ছোটদের এক পয়সা, দু’পয়সা করে অনুদান দিতেন। সেই পয়সাগুলি বছরের পর বছর একটি থলে বা থৌলে জমা হত। অঙ্কটা ৬৪ পয়সা বা এক টাকায় পৌঁছলে সৌভাগ্যর চূড়ান্ত। খুচরো পয়সাগুলির বদলে একটি পুরো টাকা সংগ্রহ করা হত। এবং অনতিবিলম্বে টাকাটি হারাত। আবার একটি পুরো টাকা অর্জনের প্রয়াস গোড়া থেকে শুরু হত। এতে ধৈর্য, আশা, মিতব্যয়িতা ইত্যাদি নানা সদ্গুণের চর্চা হত।
দেখুন, সময়বিশেষে সংস্কৃতিটা নিত্যবস্তু, অর্থাৎ, তার যাবতীয় আনুষঙ্গিক নিয়ে সব সময়েই উপস্থিত। সকলেরই চেনা, সর্বদাই চেনা। বাঙালি হিন্দুকে দুর্গা পুজো, সরস্বতী পুজো চিনিয়ে দিতে হয় না। যদিও ফিতে কাটা, আধুনিক বাজনদার দলের বাজনা, রক অ্যান্ড রোল জাতীয় নাচ, রেস্তোরাঁর চিনে-মোগল-কন্টিনেন্টাল এই সব খানা ঢুকে পড়ে এবং বলি প্রায় উঠে গিয়ে দুর্গা পুজোর চেহারা অনেক বদলে গিয়েছে। গ্রামেগঞ্জে বিশেষ যাওয়া পড়ে না, সেখানে বনেদি বাড়িতে অনেক জায়গায় শুনি পুজোর হাল-হকিকত একই আছে, কিছু বদলায়নি। আমাদের কিছু কিছু পুরনো অনুষ্ঠান প্রায় লোপ পেতে বসেছে। কোনও কোনও পরিবারে খামটি ঘরে এখনও পিঠেপার্বণ হয়। তবে তারা সংখ্যায় নগণ্য বলেই মনে হয়। এক ‘ভুলো না, আমরা বাঙালি’ গোছের অনুষ্ঠানে দেখলাম তরুণতরুণীরা চিতৈ পিঠের নাম শোনেনি। অথচ ওই পিঠেটাই এক সময় উভয় বঙ্গে সবচেয়ে প্রিয় ছিল। ব্যাপারটা প্রায় ইংরেজদের রোস্টেড বিফ কী, তা ভুলে যাওয়ার শামিল। আমাদের সংস্কৃতি নানা সম্পদে সমৃদ্ধ। তা নিয়ে গর্ব থাকলে কিছু অন্যায় হয় না।
|
হঠাৎ সুখী নববর্ষ |
গর্ব জিনিসটা নিচুস্তরের অনুভূতি। ওটা না থাকলেই ভাল। কিন্তু আনন্দ ও আত্মবিশ্বাস সম্বন্ধে সে কথা বলা চলে না। আমাদের ভাষা ও সাহিত্য থেকে আমরা প্রচুর আনন্দ পাই। আজ বাংলা ভাষা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষাদের একটা। এই চেতনা গর্ব না, সুখকর চিন্তা, আমাদের আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি। যদি বঙ্কিম-নজরুল-রবীন্দ্রনাথের ভাষা ভুলে গিয়ে টেঁশু মার্কা ‘আরে ইয়ার’ জাতীয় হিংরিজিকে মাতৃভাষা বলে আমরা বরণ করি, তা হলে আমাদের সাংস্কৃতিক গতিটা সভ্যতা থেকে অর্ধসভ্যতার দিকে চলমান ধরে নিতে হয়। শুভ দিনে বাংলায় গুরুজন, প্রিয়জনকে চিঠি লেখা, গুরুজনদের প্রণাম, প্রিয়জনদের আলিঙ্গন, নিজেদের ভাষায় বাক্যালাপ এই সব প্রথা জীবনকে সানন্দ করে, নিজের সভ্যতা-সংস্কৃতিতে বিশ্বাস মারফত যাবতীয় হীনম্মন্যতার পথ রোধ করে দাঁড়ায়, বিশ্বায়নের যুগে আত্মসম্মান বোধকে বাঁচিয়ে রাখে। বাঙালি বছর, মাসগুলির সঙ্গে তেরো পার্বণ, তথা অসংখ্য সুখাদ্যের স্মৃতি আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি যে কত আনন্দময়, তা স্মরণ করিয়ে দেয়। পয়লা বৈশাখ সেই বছরের শুরু। নানা আনন্দের পসরা সাজিয়ে এর পর বারো মাস আসবে। গুরুজনদের প্রণাম করে, যে সব সুহৃদ ব্যক্তি চোখের সামনে নেই, মাতৃভাষায় তাঁদের চিঠি দিয়ে নতুন বছর শুভ, তথা সানন্দ হবে, এই আশা নিয়ে আবার তিনশো পঁয়ষট্টি দিন কাটানোর জন্য প্রস্তুত হই। একটি সুন্দর দিন, যদি কাব্য করে বলি, ‘স্বপ্নের দিন’ খুব বোধহয় অন্যায় হয় না। বহু প্রজন্মের আশা-আনন্দের রেশ ওই দিনটার সঙ্গে জড়ানো। আমাদের সম্পূর্ণ অনাত্মীয় এক সভ্যতা এ দেশে তাদের নববর্ষ পালন করত। ভাল কথা। কিন্তু সেই বিদেশির উৎসব হঠাৎ আমাদের ‘সুখী নববর্ষ’ হয়ে গেল কোন সুবাদে?
যখন বিকৃতি অবাধে বেড়ে ওঠে, জনতার অন্ধ বিশ্বাস সেই বিকৃতিকে প্রশ্রয় দেয়, তখন শিল্পীরই দায়িত্ব দেখিয়ে দেওয়া যে গোটা জিনিসটা কুৎসিত। এ রকমই কিছু কথা তাঁর এক ব্যঙ্গচিত্র সঙ্কলনের ভূমিকায় লিখেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। অসামান্য দক্ষতা ও শিক্ষার প্রমাণ তাঁর শিল্পকৃতিতে, কয়েকটি সঙ্কলনে গ্রথিত ব্যঙ্গচিত্রগুলিতেও তার নির্ভুল স্বাক্ষর। বঙ্গসমাজের নানান অসঙ্গতিকে তীব্র কশাঘাত করেছিলেন তিনি। বলা চলে, হুতোম বা কমলাকান্ত যা করেছিলেন আখরে, কালি-তুলিতে তা-ই করলেন গগনেন্দ্রনাথ। শতাব্দী বদলেছে, হয়তো বাঙালিও, কিন্তু ব্যঙ্গচিত্রী গগনেন্দ্রনাথ আজও উজ্জ্বল। পাশের ছবিটি নেওয়া ‘নব হুল্লোড়’ (১৯২১) সঙ্কলন থেকে। এ ছবির পরিচিতি: ‘স্টেট ফিউনেরাল অব এইচ এইচ ওল্ড বেঙ্গল’। নীচের ছবি ‘হাইব্রিড বেঙ্গালেনসিস’। এটির উৎস ‘বিরূপ বজ্র’ (১৯১৭)। |
|
|
|
|
|